টিভিএফ পঞ্চায়েত : সহজ কথা সহজভাবে
.....................
সিরিজ : পঞ্চায়েত
পরিচালনা : দীপক কুমার মিশ্র
প্রযোজনা : দ্য ভাইরাল ফিভার
মাধ্যম : আমাজন প্রাইম
অভিনয় : জিতেন্দ্র কুমার, রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, চন্দন রায়, ফয়জল মালিক, সাংভিকা প্রমুখ
..................
সহজ কথা যায় না বলা সহজে। ভারতবর্ষের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’ অবশ্য সহজ কথা বড্ড সহজে বলে দিতে পারে। গোটা সিরিজে লোকগীতির প্রাঞ্জল সুরের মত বেজে ওঠে মানুষের ছোট ছোট সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ-বেদনার খতিয়ান। এবং লোকগানের মতোই তা সোজা এসে দোলা লাগায় আমাদের মনের গভীরে।
প্রথম সিজনে আমরা দেখেছিলাম শহুরে জৌলুসের পরিমণ্ডল থেকে ছোট্ট গ্রাম ফুলেরায় এসে তরুণ অভিষেক ত্রিপাঠীর মানিয়ে নেবার চেষ্টা। ভুল বোঝাবুঝি, রাগ-অভিমান, সন্দেহ-বন্ধুত্বে ভরা সেই অধ্যায় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল দর্শকের কাছে, মনে করিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের কথা। একেবারে শেষ দৃশ্যে গ্রামপ্রধানের মেয়ে রিঙ্কির সাথে অভিষেকের সাক্ষাৎ হওয়াতে দর্শকের মনে চড়ছিল প্রত্যাশার পারদ - তবে কি রিঙ্কির সঙ্গে অভিষেকের কোনো সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে? অধীর আগ্রহ এবং অনেক আশার মাঝে অবশেষে এসে হাজির দ্বিতীয় সিজন। বেআইনি সম্প্রচারজনিত গোলমালের কারণে নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই। প্রথম সিজনের ঘটনাবলীর পরে মাস দুয়েক কেটে গেছে, অভিষেক এখন অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে ফুলেরার জীবনযাত্রার সাথে। প্রধানপতি ব্রিজভূষণ দুবে, উপপ্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডে এবং সহকারী বিকাশের সঙ্গে এখন তার রীতিমত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কাহিনিতে নাটকের উপাদান আনবার জন্য তাই নতুন বিরোধীপক্ষের আমদানি হয়। মঞ্জুদেবীর বদলে নিজের স্ত্রীকে প্রধানের পদে দেখতে চায় অবস্থাপন্ন গ্রামবাসী ভূষণ, দস্তুরমতো আদাজল খেয়ে সে লেগে পড়ে পঞ্চায়েতের বর্তমান মাথাদের কাজে ব্যাগড়া দেবার জন্য। মুশকিল হচ্ছে যে, বর্তমান প্রধানপতি দুবেজি মানুষ ভালো হলেও মোটেই খুব একটা করিতকর্মা নন। অভিষেকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্কের ভিত্তি যত না পেশাদারি তার থেকে অনেক বেশি বন্ধুত্বের - যে সম্পর্কের জোরে দুবেজি নিয়মিত তাকে খেতের লাউ দেন, উৎসব পার্বণে বাড়িতে খেতে ডাকেন, একসঙ্গে গোল হয়ে বসে মদের বোতলে চুমুক দেন। কিন্তু তাঁর অপেশাদারি মনোভাব এবং কৃপণ স্বভাবের সুযোগ নিয়ে বালিয়ার বিধায়কের কান ভাঙিয়ে আসে ভূষণ, রাস্তা তৈরির টাকা চাইতে গিয়ে বিপাকে পড়েন প্রধানজি, প্রহ্লাদ এবং বিকাশ। ফান্ডের লোভ দেখিয়ে তাঁদের যেভাবে ফকৌলি স্টেশনের দাবিজনিত আন্দোলনে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়, সে ছবি আমাদের খুব চেনা। মাংস-ভাতের লোভে ব্রিগেড বা ডিম-ভাতের লোভে ধর্মতলা ভর্তি করানোর কৌশল আমরাও তো কম দেখি নি! মাত্র কয়েক আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিধায়কের ঔদ্ধত্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহারের ছবি। অভিষেকের সঙ্গে রিঙ্কির দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তার দৃশ্যগুলোও বড্ড মিষ্টি। উগ্রতা বা আগ্রাসনের লেশমাত্র নেই। মার্কিন সংস্কৃতির দাপটে যখন উথালপাথাল শারীরিক মিলন ছাড়া পর্দায় প্রেম জমে না, সেই সময়ে এই দু’জনের লাজুক দৃষ্টি বা বাক্য বিনিময় দেখতে বেশ লাগে বইকী। মঞ্জুদেবীর চরিত্র গত সিজনের বেশিরভাগ সময়টাই পিছনের সারিতে থেকে শেষ এপিসোডে এসে ডানা মেলেছিল, এবারে তিনি আরো বেশি সপ্রতিভ, এবং শেষলগ্নে অসাধারণ সাহস এবং ব্যক্তিত্বের পরিচয় রাখেন। ছোটখাটো নানা মুহূর্তের মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, প্রধানপতি যতই বাইরে হম্বিতম্বি করে বেড়ান, সংসারের আসল চালিকাশক্তি মঞ্জুদেবী। মজলিসের নর্তকী, সরকারি গাড়ির মাতাল চালকের মত ছোট্ট ছোট্ট চরিত্রগুলো কয়েক পলকের জন্য পর্দায় এসে গভীর কিছু কথা বলে চলে যায়, তার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ।
কেন এত জনপ্রিয় ‘পঞ্চায়েত’? আসলে সহজ ছন্দে বয়ে চলা যে জীবনের ছবি এখানে আঁকা হয়, তা মনে মনে কর্পোরেট ধনতান্ত্রিক জীবনযাত্রার টানাপোড়েনে অভ্যস্ত শহুরে জনগণের মনে এক তীব্র আকর্ষণ তৈরি করে। মনে মনে আমরা অনেকেই এমন একটা জীবন চাই যেখানে নাগরিক জীবনের কোলাহল নেই, বসের মুখঝামটা নেই, ট্যাক্সের তাড়না নেই, ডেডলাইনের আতঙ্ক নেই, জীবন বাজি রেখে টার্গেট পূরণের প্রতিযোগিতা নেই। বরং আছে মাথার উপর খোলা আকাশ, প্রধানজির পরিবারের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, বিকাশের নিঃশর্ত বন্ধুত্ব, রিঙ্কির মিষ্টি হাসি। এ এমন এক গ্রামীণ অবকাশ যাপন, যেখানে গতল নাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে রিসর্ট দৌড়বার প্রয়োজন অবধি নেই, শুধু নেট চালু করে বসে পড়লেই হল। তবে একথা বলতেই হবে, শুধু শহুরে মানুষের মন ভোলাবার জন্য গ্রামকে আগাগোড়া রোমান্টিসাইজ করে না ‘পঞ্চায়েত’, অভিষেকের বিদেশে কর্মরত বন্ধু সিদ্ধার্থের ছোট্ট আগমনের মাধ্যমে আমরা বুঝি, শহুরে মানুষের চোখে আপাতদৃষ্টিতে এ জীবন স্বর্গীয় মনে হলেও, কয়েকবার হ্যান্ডপাম্পে জল তোলা বা রান্নাঘরে সাপ ঢুকবার মত ঘটনা ঘটলে তাদের ভাবালুতা আপনি ঘুচে যায়। এবং এই সিজনের অন্তিম এপিসোডের শেষ কুড়ি মিনিট বড্ড বেশি বাস্তব, ভাবাবেশের লেশমাত্র সেখানে নেই। নির্মাতাদের কুর্ণিশ, বর্তমান ভারতবর্ষে যেখানে সেনাদের দেশপ্রেম সেলুলয়েডে মাহাত্ম্য প্রচার এবং ভোটের ময়দানে ফায়দা লোটার জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে তাঁরা সেনাবাহিনির নির্মম সত্যিটা তুলে ধরতে পেছপা হননি। জনৈক সাংবাদিক যখন প্রশ্ন তোলে যে সেনাবাহিনির বেশিরভাগ ছেলে গ্রামাঞ্চল থেকে আসে কেন, তার বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী সোজাসাপটা উত্তর দেন, ‘এই কটা টাকার জন্য প্রাণ দিতে আর কে রাজি হবে বলো তো?’ ‘উরি’, ‘শেরশাহ’ বা ‘বেলবটম’ ছবির বগল বাজানো দেশপ্রেমের পাশে এধরনের বিশ্বাসযোগ্য কাজ দেখলে ভরসা জাগে।
আরও পড়ুন : সহজ ভাষায় প্রান্তিক মানুষের গল্প বলে ‘সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর’ / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
অভিনয়ের ক্ষেত্রে সবার প্রথমেই আসবে টিভিএফের সম্পদ জিতেন্দ্র কুমারের কথা। ‘কোটা ফ্যাক্টরি’ সিরিজের পাশাপাশি এখানেও প্রাণকেন্দ্র তিনিই, বড় বড় চোখের অভিব্যক্তি আর সাবলীল সংলাপে চরিত্রকে নিমেষে জীবন্ত করে তুলতে তার জুড়ি নেই। রঘুবীর যাদব আর নীনা গুপ্তার অভিনয় ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের দক্ষতা নিয়ে নতুন কিছু বলতে যাওয়া নিরর্থক। ভূষণের চরিত্রে দুর্গেশ কুমার, তার স্ত্রীর চরিত্রে সুনীতা রাজওয়ার, রিঙ্কির ভূমিকায় সাংভিকা, বিনোদের ভূমিকায় অশোক পাঠক বা বিধায়কের চরিত্রে পঙ্কজ ঝা, প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায় মানানসই। তবে আলাদা করে বলতেই হবে বিকাশের ভূমিকায় চন্দন রায় এবং প্রহ্লাদ পাণ্ডের ভূমিকায় ফয়জল মালিকের কথা, সম্পূর্ণ মিশে গিয়েছেন তাঁরা চরিত্রদের সঙ্গে। সিনটা একা খেয়ে নেবার জিনিস নয়, প্রত্যেকের সঠিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই একটা পরিবেশনা যথার্থভাবে সুন্দর হয়ে ওঠে- এই সিরিজের কলাকুশলীদের দেখলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। চন্দন কুমারের চিত্রনাট্য এবার আরো বেশি টানটান, নাটকীয় উপাদানের পরিমাণ বেশি। অনুরাগ সইকিয়ার আবহ সঙ্গীত সুন্দর, সম্পূর্ণ পরিবেশনাকে এত পরিচ্ছন্ন করে তোলার জন্য পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন। তবে ফাঁকফোকর কিছু রয়েছে তো অবশ্যই। বারংবার একই ড্রোন শটের ব্যবহার একটা সময়ের পর চোখকে ক্লান্ত করে। এছাড়া একটা খটকা রয়েই যায়, ফুলেরা গ্রামের পঞ্চায়েত একেবারেই উচ্চবর্গীয় একটা ব্যাপার, দুবে, পাণ্ডে, ত্রিপাঠী এবং শুক্লার অবাধ বিচরণক্ষেত্র। বিনোদ নামের গরিব মানুষটির শৌচাগারের অভাবকে যেভাবে আগাগোড়া হাসিঠাট্টার মোড়কে উপস্থাপন করা হল, তাতে বিষয়টা লঘু হয়ে গেল কি না সে বিতর্ক উঠতেই পারে। ছাগল হারানো অসহায় চাষীটির প্রতি অভিষেকের আচরণও প্রশ্ন তুলতে পারে। তবে এসব সংশয়, বাদানুবাদ পেরিয়ে শেষ অবধি ‘পঞ্চায়েত’ হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের গল্প, সহমর্মিতার গল্প, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গল্প, যে সম্পর্কের টানে বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুকথা শুনিয়ে দেওয়া যায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়ককে, অথবা প্রিয়জন হারানো সঙ্গীকে তিনদিন বাদে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় জীবনের মূলস্রোতে, মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে এই পৃথিবীতে সে মোটেই একা নয়। কর্পোরেট সংস্কৃতির হিংস্র প্রতিযোগিতার বৃত্তে এসব আর হয় কি?
..................
#web series #panchayat #review #Jitendra kumar #Amazon Prime #TVF #রিভিউ #ওয়েব সিরিজ #silly পয়েন্ট