লকডাউনে পড়াশোনা : কেমন ভাবে চলছে মার্কিন দেশের ইউনিভার্সিটি
দেখতে দেখতে বছর দুই কেটেই গেল এই বিদঘুটে লকডাউনের। সেই ২০২০-র মার্চ মাসে স্প্রিং ব্রেকের আগে কানাঘুষো শুনছিলাম, চিনে নাকি এক ভয়ানক জ্বর শুরু হয়েছিল, তা বিমানযোগে পৌঁছে গেছে মার্কিন দেশে, আর ছড়িয়ে পড়ছে হু হু করে। মার্কিন বন্ধুবান্ধব সবাই দেখছিলাম খুব উৎকন্ঠিত, এই জ্বর একমাত্র ছাড়বে লোকে বেশি মেলামেশা না করলে। তা এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে বছর বছর ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার মহামারি দেখা এই অধমের মনে হয়েছিল, কতই বা আর হবে, কয়েক সপ্তাহ হয়তো স্কুল বন্ধ থাকবে। ও, বলা হয়নি, এদেশে সবই স্কুল, প্রাথমিক থুড়ি এলিমেন্টারি স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা থুড়ি গ্র্যাজুয়েট স্কুল। সেই যে বন্ধ হল স্কুল করোনা-আবহে, দু'বছর হয়ে গেল, অধমের পি এইচ ডি শেষ হয়ে গেল, করোনার ভূত আর গেল না।
যাই হোক, যা লিখতে আজ কলম ধরা, এই প্রবাসে লকডাউনের মধ্যে কেমনভাবে চলে পড়াশুনা। মার্কিন মুলুকে গবেষণা করার সুবাদে আমাকে ক্লাসও নিতে হয়। হঠাৎ লকডাউন শুরু হওয়াতে সেই সময়ে ক্লাস করানো শুরু হল ভিডিও কল মারফৎ, জুম নামক এক সফটওয়্যারের মাধ্যমে। অধুনা বহুল প্রচলিত এই সফটওয়্যার তখন ছিল নিতান্তই অচেনা, তাই অনেক সময়েই ক্লাসে ব্যাঘাত ঘটত। তবে প্রথম বিশ্বের দেশ হওয়ায় এখানে কম্পিউটার, ট্যাবলেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার প্রচুর, এবং সব ছাত্রছাত্রীদের কাছেই ভালো ইন্টারনেট সংযোগ আছে। তাই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ হয়ে গিয়েছিলাম এই ধরনের পড়াশুনায়। ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবহারও করা যেত আইপ্যাড বা ট্যাবলেট কম্পিউটারের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যাতে স্টাইলাসের মাধ্যমে কিছু লিখলে সেটা তৎক্ষণাৎ ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত সব ছাত্রছাত্রীই দেখতে পায়। গোল বেঁধেছিল অবশ্য অন্য বিষয় নিয়ে। ক্লাসরুমের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বোঝালে আমরা যারা পড়াচ্ছি তারা বুঝতে পারতাম ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা কোথায়। এটাও বোঝা যেত যে কেউ কোনো জটিল ধারণা ভুলভাবে বুঝেছে কিনা। ফলিত গণিত সংক্রান্ত বিষয় যা এমনিতেই অনেকের কাছে রসকষবিহীন হিসাবে কুখ্যাত, সেখানে ক্লাসের মধ্যেই 'ঘুম ঘুম ক্লাসরুম' হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভিডিও কনফারেন্স ক্লাসে সবাই ভিডিও বন্ধ রাখায় আরওই বোঝা যেত না তারা কতটা আয়ত্ত করছে। তাই একমাত্র তাদের জমা দেওয়া বাড়ির কাজ (হ্যাঁ, স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশুনাতেও এদেশে বাড়ির কাজ দেওয়া হয়) দেখে সেই সম্পর্কে ধারণা করতে হত। এই বিদঘুটে সমস্যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় ছিল অফিস-আওয়ার, এক-দুই ঘণ্টার নির্ধারিত সময় যখন ছাত্রছাত্রীরা তাদের সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক/অধ্যাপিকা টিচিং অ্যাসিসট্যান্টের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। সেই ব্যবস্থাও জুমেই হয়েছিল বলাই বাহুল্য। তাতে খাতা কলম নিয়ে অঙ্ক কষতে একটু সমস্যা হলেও ট্যাবলেট কম্পিউটারের ব্যবহারে অনেকটাই সুবিধা হয়েছিল।
এবার আসি সবথেকে বড়ো ঝামেলার প্রসঙ্গে। সেটা অবশ্যই হল পরীক্ষা। ক্লাসের মধ্যে পরীক্ষা চলাকালীন টোকাটুকির সমস্যা বোধহয় পৃথিবীর সর্বত্র। গড় হিসেবে এখানে এই সমস্যাটা একটু কম হলেও একদম নেই এরকম বলতে পারি না। এখন ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে পরীক্ষার সততা কীভাবে বজায় থাকবে (বা আদৌ বজায় থাকবে কিনা) সেটাই ছিল বিরাট প্রশ্ন। এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল খুবই চমকপ্রদ ভাবে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, বিশেষত বিজ্ঞান ও গণিতে মুখস্থ করা জ্ঞানের উপর কোনো গুরুত্ব নেই বললেই চলে। পরীক্ষার প্রশ্নও বেশিরভাগই থাকে অজানা অঙ্ক সমাধান করার উপর। তাই এক্ষেত্রে 'টেক হোম এক্স্যাম' বা বাড়ি বসে দেওয়ার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল ভার্চুয়াল ক্লাসে। প্রশ্নপত্র এমন ছিল যার উত্তর কোনো বই বা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যাবে না, কিন্তু ক্লাসের পড়ানো না বইয়ের থেকে সমাধানের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে উত্তরপত্র স্ক্যান করে বা টাইপ করে ফেরত দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সব মিলিয়ে নির্বিঘ্নেই মিটেছিল পরীক্ষা পর্ব।
এখন করোনার প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে কমায় এবং প্রচুর পরিমাণ টীকাকরণের ফলে আবার ক্লাসরুমের মধ্যেই পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। তবে ভার্চুয়াল পড়ানোর ব্যাপারটা একবার জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার ফলে ক্লাসের অনেক জিনিসই এখন অনেকেই ভিডিও কলে করতে পছন্দ করে। অনেক ইউনিভার্সিটিতে 'হাইব্রিড ক্লাস'ও শুরু হয়েছে যেখানে অধ্যাপক/অধ্যাপিকা ক্লাসে পড়ালেও সেই পড়ানোর ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে স্ট্রিম করা হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীরাও তাদের কম্পিউটার থেকে ক্লাসরুমের টিভির পর্দায় তাদের প্রশ্ন করতে পারছে। এর ফলে আরা ক্লাসে আসতে চাইছে না (করোনার ভয়ে বা আলস্যের কারণে) তারাও ক্লাস করতে পারছে। স্কুলবেলায় আইজ্যাক আসিমভের লেখা একটা গল্প পড়েছিলাম যেখানে সমস্ত বাচ্চা বাড়িতে বসে টিভির মাধ্যমে রোবট শিক্ষকের থেকে ক্লাস করে৷ কম্পিউটারের পর্দায় জুম ক্লাস করতে এবং করাতে গিয়ে মনে হয় লেখকের সেই দূরদর্শিতাকে। যদিও রোবট এখনও শিক্ষকের ভূমিকা পুরোপুরি নিতে পারেনি, তবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেনসের গবেষণা সেই পরিস্থিতির দিকে আগামী দুই দশকে আমাদের পৌঁছে দেবে কিনা সেটা আগামীই বলবে।
Asimov, Isac, "The Fun They Had", The Magazine of fantasy and science fiction, Earth is Room Enough, Hoboken, NJ, USA, 1954.
(লেখক প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট)
আরও পড়ুন: ঘুমপাড়ানি গান কিংবা বাংলার শিক্ষা/ পূর্বা মুখোপাধ্যায়