নিবন্ধ

রায়-রাজ্যে ভাষান্তর

সৃজিতা সান্যাল Oct 31, 2020 at 10:51 am নিবন্ধ

.....................................................

হিরে মানিক জ্বলে : ত্রয়োদশ পর্ব 


...................................................... 


হযবরল-র সেই লোকটার কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, যে সব জিনিসের নামকরণ করত! জুতোর নাম দিয়েছিল অবিমৃষ্যকারিতা, ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর গাড়ুর নাম পরমকল্যাণবরেষু। একটু খতিয়ে ভাবলে কিন্তু বোঝা যায় সে আসলে আমাদের খুব চেনা কয়েকটি জিনিসের সিগনিফায়ার হিসেবে নিয়ে এসেছিল কয়েকটা কঠিন ধ্বনিপ্রতীক। প্রচলিত ধ্বনিপ্রতীককে অস্বীকার করে যে কাণ্ডটা সে ঘটিয়েছিল তা কি আসলে একপ্রকারের অনুবাদ নয়? জুতো-ছাতা-গাড়ুর সোর্স-ভাষাক্ষেত্র থেকে সে তো পৌঁছে যেতে চেয়েছিল অবিমৃষ্যকারিতা-প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব-পরমকল্যাণবরেষুর টার্গেট-ভাষাক্ষেত্রে, যা কানে ভয়ানক খটোমটো শোনালেও মানের দিক থেকে মোটেই দুর্বোধ্য কিছু নয়। 


যে কোনও অনুবাদই প্রকৃতপক্ষে সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। সত্যজিতের অনেকান্ত প্রতিভার অন্যতম দিক যদি এই অনুবাদ হয়, তবে তার একদিকে থাকবে আর্থার কনান ডয়েল, রে ব্র্যাডবেরির মতো বিখ্যাত রহস্য ও কল্পবিজ্ঞান লেখকদের একাধিক গল্পের সুদক্ষ ভাষান্তর, যেগুলি সংকলিত হয়েছে ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য’ বইটিতে। আরেকদিকে থাকবে এডওয়ার্ড লিয়ার, লুই ক্যারল, হিলেয়ার বেলক প্রমুখের ননসেন্স রচনার পৃথিবীকে বাংলা ভাষায় জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা থেকে উঠে আসা আশ্চর্য ছড়া-গল্প-লিমেরিকগুলি, যারা একসঙ্গে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ নাম নিয়ে। আজকের আসরের বিষয় অবশ্য ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’ নয়, লিয়ারের লিমেরিকও নয়। আজ ‘হিরে মানিক’-এর স্পটলাইট ঘিরে থাকবে লিয়ারের অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দুই জোড়া-কবিতাকে, যারা সত্যজিৎ-অনূদিত ননসেন্সের ‘তোড়া’-র একেবারে প্রথম দুই ‘ঘোড়ার ডিম’!


  

উনিশ শতকে এডওয়ার্ড লিয়ারের ‘The Jumblies and Other Nonsense Verses’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল ‘The Jumblies’ এবং ‘The Dong with a Luminous Nose’। সত্যজিতের অনুবাদে এ দুটি কবিতার নাম দাঁড়ায় যথাক্রমে ‘পাপাঙ্গুল’ এবং ‘ডং’। এই দুই কবিতার ক্ষেত্রেই কিন্তু বেশ স্পষ্ট স্টোরিলাইন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম কবিতার বিষয়বস্তু পাপাঙ্গুলদের ছাঁকনি চেপে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এবং সেই দুঃসাহসী অভিযানে সফল হওয়ার ইতিবৃত্ত। আর দ্বিতীয় কবিতায় ট্রাজিকমেডির চালে বলা হয়েছে ডং-এর ব্যর্থ প্রেমের করুণ কাহিনি। গাছের ডাল দিয়ে মস্ত বড় নাক বানিয়ে, তাতে লন্ঠন ঝুলিয়ে, হারিয়ে-ফেলা প্রেমাস্পদাকে অক্লান্তভাবে খুঁজে ফেরার গল্পে কৌতুক আর করুণ রসের যে অসামান্য ককটেল রয়েছে, তার উদ্ভটত্বই একে নিয়ে আসে ‘সেন্স’ থেকে ‘নন্‌সেন্স’-এর কিনারে। 

আসলে লিয়ারের ননসেন্স রাইমের জগৎটাই ছিল গতেবাঁধা, নিয়মের অনুশাসনে জর্জরিত সময় ও সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ। পরবর্তীকালে লুই ক্যারলের মতো লেখকরাও সামিল হলেন সেই বিদ্রোহে। রোজকার চেনা পৃথিবীর বাইরে তাঁরা তৈরি করতে চেয়েছিলেন এক বিকল্প পৃথিবী। পরিচিত যুক্তির বন্ধন নস্যাৎ করে গড়ে তুলেছিলেন এক উল্টো-যুক্তির পরিসর। যেখানে আমাদের কাছে অসম্ভব বলে প্রতিপন্ন জিনিসও অনায়াসে সম্ভব হতে পারে। পাপাঙ্গুল কিংবা ডং – এরা সকলেই সেই অসম্ভব পৃথিবীর বাসিন্দা। 


এ প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় বেশ লক্ষ করার মতো।  ‘The Jumblies’-এ যে ননসেন্স-দুনিয়ার গল্প বলা হয়, তার সঙ্গে Dong-এর ননসেন্স-দুনিয়ার একটা মজাদার যোগসূত্র বা চলাচলের রাস্তা রেখে দেন লিয়ার। যেভাবে টম সয়ারের অভিযানে চরিত্র হিসেবে দেখা দেয় হাকলবেরি ফিন, যেভাবে আমাদের রামায়ণের হনুমান উঁকি দিয়ে যায় মহাভারতে, প্রমাণ করে একই অবিচ্ছিন্ন পরিসরে তাদের যৌথ-অস্তিত্ব, ঠিক সেভাবেই ‘Dong with a Luminous Nose’-এর চরিত্র হিসেবে আসে ‘Jumbly Girl’। ডং-এর মর্মান্তিক হৃদয়ভঙ্গের কারণ বস্তুত সেই-ই। Jumbly-দের সাগর-অভিযানের সময় তাদের ছাঁকনি এসে ঠেকেছিল ডং-এর দেশে। সেখানে দিনকয়েকের জন্য ঘাঁটি পাতে তারা। আর সেইসময়েই পাপাঙ্গুলের মেয়ের প্রেমে পড়ে ডং।  


দুই দুনিয়ার এই চলাচলকে কতটা সাফল্যের সঙ্গে সত্যজিৎ তুলে ধরেছিলেন তাঁর অনুবাদে? কীভাবেই বা বঙ্গীকরণ করলেন বিদেশি আবহে গড়ে ওঠা ননসেন্স শব্দবন্ধের? কখনো কখনো স্যুররিয়ালিজমকে ছুঁয়ে ফেলা যে কাব্যিকতা মূলের অন্যতম সম্পদ, ভাষান্তরে তার কতখানি ধরা পড়ল? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজবে এই নিবন্ধ।    

যে কোনও অনুবাদের ক্ষেত্রেই সোর্স থেকে টার্গেট ভাষাক্ষেত্রে যাত্রার সময়ে অনুবাদক কেবল ভাষাগত ব্যবধানই অতিক্রম করেন না। অতিক্রম করেন সামাজিক ও সংস্কৃতিগত ব্যবধানও। অনুবাদক সর্বদাই “inevitably a product of his/her society.” সত্যজিৎ নিজেও এ তত্ত্বের ব্যতিক্রম নন। মূল কবিতায় Jumbly-দের ঘরে ফেরার পর পরস্পরের স্বাস্থ্যকামনা করে পানের বিবরণ ছিল (‘they drank their health’)। সংস্কৃতিগত কারণেই পাপাঙ্গুলদের ভোজসভা থেকে বাদ যায় এই অংশ। একই যুক্তিতে পাপাঙ্গুলেরা বিদেশভ্রমণে গিয়ে ‘Cranberry Tart’-এর বদলে নিয়ে আসে ‘পাউরুটি এক কাঁড়ি’। ‘Forty bottles of Ring-Bo-Ree’ হয়ে যায় ‘রংবেরঙা পানি’। ‘Stilton Cheese’-এর বদলে আসে ‘ঢাকাই বাখরখানি’। খেয়াল করার মতো বিষয় হল, Jumblies কবিতার আর কোথাও কিন্তু আমাদের চেনা কোনও ভৌগোলিক স্থানের উল্লেখমাত্র নেই। আলোচ্য দুটি কবিতাই ‘আজগুবি’ কয়েকটি স্থাননামের প্রয়োগে তৈরি করেছে এক স্বতন্ত্র ভৌগোলিকতা। ব্যতিক্রম কেবল Stilton Cheese। এই বিশেষ ধরনের চিজ-উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের লেস্টারশায়ারের নাম। ঠিক তেমনি ‘পাপাঙ্গুল’-এর কোথাও আমাদের পরিচিত কোনও স্থাননামের উল্লেখ না থাকলেও একমাত্র বাখরখানি রুটির অনুষঙ্গে উঠে আসে ঢাকার ঐতিহ্য। এমনকি এই রুটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ফৌজদার আগা বাকের আর নর্তকী খনি বেগমের ট্র্যাজিক প্রেমের কিংবদন্তির কথা মনে পড়াও বিচিত্র নয়। আবার, Dong-এর ক্ষেত্রে মূল কবিতায় ‘He fell in love with a Jumbly Girl’ বলে প্রেমের যে স্পষ্ট ঘোষণা ছিল তা বাদ দিয়ে সত্যজিৎ লেখেন ‘অনেক বছর আগে/ ডং-এর মনে বড্ড আঘাত লাগে।’ বাংলা শিশুতোষ বা কিশোর সাহিত্যে প্রেমের উল্লেখ সরাসরি কখনও থাকবে না, এই অলিখিত নিয়ম মেনেই কি সত্যজিৎ এটুকু পরিমার্জনের আশ্রয় নেন? ‘শিশু-উপযোগী’ করে তোলার দায় থেকেই কি বাদ যায় ডঙের প্রেমজনিত গভীর হতাশার অনুষঙ্গে ব্যবহৃত ‘ডার্ক’ ইমেজগুলি? ‘Hateful day’, ‘cruel shore’, ‘weary eye’, ‘dismal night’, ‘dreary night’, ‘awful darkness’, ‘angry breaker’ – এই বিশেষণগুলির ব্যবহারে যে যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও ক্লান্তির ব্যঞ্জনা ছিল, অনুবাদ থেকে তা হয়তো স্বেচ্ছায় সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ, টার্গেট পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই। তবে, তিনি যে কেবল সেন্সরশিপই করেছিলেন, এমনটা নয় মোটেই। পাপাঙ্গুলের মেয়ের নীল হাতে সবুজ বেণী বাঁধার ছবিটি সত্যজিতের নিজস্ব সংযোজন, যা বাঙালি মেয়েদের বেণী বাঁধার পরিচিত দৃশ্যের সঙ্গে মিশে ডং-এর পূর্বরাগকেই মধুরতর করে তুলেছে। 

‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’-এর ভূমিকায় সত্যজিৎ লিখেছিলেন – ‘ননসেন্স রচনার আক্ষরিক অনুবাদ করতে গেলে অনেক সময়ই মূলের হাস্যরস বজায় থাকে না।’ তাই কয়েকটি অনুবাদের ক্ষেত্রে অল্পাধিক স্বাধীনতা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ‘Where the Oblong Oysters grow’-র ভাষান্তরে তিনি যখন লেখেন ‘চৌকোমুখো চিংড়ি যেথা চারপায়েতে হাঁটে’ তখন alliteration-এর চমক বজায় রেখে স্বাধীনতা নেওয়ার একটা নমুনা আমরা দেখতে পাই। একইভাবে “O Timballo! How happy we are”-এর অনুবাদ হয়ে যায় “আহা, অলম্বুশ! আজকে মোদের মেজাজ বড় খুশ্‌।” আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে মূলের হাস্যরস বজায় রাখার তাগিদই তাঁর বেশি ছিল। মোটের ওপর ভাষান্তরের সময় Communicative approach নেওয়ারই পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। বিশ্বাস করতেন, “Language is nothing more than a vehicle for the message.”। অনুবাদের মাধ্যমে মূলের নির্যাস পৌঁছে দেওয়া লক্ষ্য ছিল বলেই বেশিরভাগ সময়ে নিছক ‘ট্রান্সকোডিং’ না করে ‘ডিভার্বালাইজ’ করেছেন তিনি। আর এরই ফলে অনুবাদ হয়েও দুটি কবিতাই ছুঁয়ে গেছে কবিতার ব্যঞ্জনা ও  রহস্যময়তাকে। যেমন,     

* When awful darkness and silence reign – আঁধার যখন থমথমিয়ে নামে 

*When the angry breakers roar, / As they beat on the rocky shore; - গুম্‌রে যখন ওঠে ক্ষণে ক্ষণ / সাগরপাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গরজন…  

*“Yonder – over the plain he goes; / …He goes! / The Dong with a luminous nose - ‘ওই দেখো ডং! ডং গেল ওই চলে! ওই যে ঘাসে, ওই ও-পাশে ডং, নাকের ডগায় ঝিলিক মারা সং!’   

*They went to sea in a Sieve, they did – তারা ছাঁকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবে। দেবেই দেবে। 

*Far and few, far and few/Are the lands where the Jumblies live; - অনেক দূরে অনেক দেশের পর, পাপাঙ্গুলের ঘর।  

 *They whisled and warbled a moony song – এবার তারা উঠল সবাই আনমুনি গান গেয়ে… 

সত্যজিৎ যে কখনোই আক্ষরিক অনুবাদের দিকে ঝোঁকেননি, তা এই কটা উদাহরণ থেকেই বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। শেষ উদাহরণে ব্যবহৃত ‘আনমুনি’ শব্দটি লক্ষণীয়। বলা বাহুল্য, শব্দটি বাংলা অভিধান বহির্ভূত এবং সত্যজিতের নিজের তৈরি। ইংরাজি ‘moony’ শব্দের একটা অর্থ যেমন চাঁদ-সম্বন্ধীয়, আরেকটি অর্থ তেমন স্বপ্নালু বা চন্দ্রাহত। কিন্তু এইসব অভিধানগত অর্থের একটাও ব্যবহার না করে সত্যজিৎ নিয়ে এলেন একেবারে অন্য একটি সিগনিফায়ার। যার সঙ্গে সোর্স-ল্যাঙ্গুয়েজ-টেক্সটে ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিসাযুজ্য (‘মুনি’-- ‘আনমুনি’) দিব্যি বজায় রইল। এদিকে টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ বাংলার ‘আনমনা’ শব্দের সঙ্গেও অর্থগত ও ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকায়, কচিকাঁচা পাঠকদের মনে অর্থবোধ তৈরিতে তেমন কোনও বাধা রইল না। 

Jumblies এবং Dong – দুটো কবিতার বেলাতেই নতুন শব্দ বা সিগনিফায়ার তৈরিতে আশ্চর্য মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। ভাষাগত ব্যবধান সত্ত্বেও আমাদের এত কাছের হয়ে ওঠার জাদুকাঠি অবশ্যই কবিতাদুটিতে সত্যজিতীয় শব্দের বুদ্ধিদীপ্ত অথচ অনায়াস প্রয়োগ। যেমন, 


এই উদ্ভট নামশব্দগুলো পাল্টে নেওয়ার সময় সত্যজিৎ একইসঙ্গে মূলের সঙ্গে ধ্বনিসাদৃশ্য রাখা ও আমাদের চেনা কোনও বাংলা শব্দের সঙ্গে ধ্বনিগত মিল বজায় রাখার যে টেকনিক নিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য। বাংলাশব্দের সঙ্গে মিল থাকার কারণে, একেবারে নতুন হওয়া সত্ত্বেও, তাদের আটপৌরে বলেই মনে হয়। মনে মনে একটা কল্পিত অর্থ বা সিগনিফায়েডও খাড়া করে ফেলতে পারে পাঠক। এদিকে মূলের স্বাদটুকুও বাদ পড়ে না কোথাও। মূলের কৌতুকভরা স্থাননামগুলোকে সত্যজিৎ বাংলায় খুব সাফল্যের সঙ্গে বদলে নিয়েছেন তো বটেই, চেনা কিছু ইংরাজি শব্দকেও নতুন বাংলা শব্দ দিয়ে স্থানান্তরিত করেছেন। Western Sea এর আক্ষরিক অনুবাদ ‘পশ্চিম সাগর’ না করে তিনি লিখেছেন ‘পছিম সাগর’। Mountains Brown ‘পাটকিলে’ রঙের অনুষঙ্গে তাঁর কলমে হয়ে গেছে ‘পাটকিলিয়া’ পাহাড়। Pinky Paper হয়েছে ‘বালির কাগজ’। আর শব্দপ্রয়োগে এ হেন সরস উদ্ভাবনী কৌশল বাংলা কবিতাগুলোকে কখনও কখনও মূলের থেকেও মজার করে তুলেছে বললে বাড়িয়ে বলা হয় না একটুও। বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে ‘পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা’, ‘কুমড়োপটাশ’ ‘ফুটোস্কোপ’, ‘হাঁসজারু’র মতো শব্দগুচ্ছ উপহার দিয়েছিলেন যে কবি, তাঁর উত্তরাধিকার তাঁর ছেলের ননসেন্স শব্দতৈরির হাতকেও যে পোক্ত করেছিল, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।    

মূলের সঙ্গে অনুবাদের আর একটা কৌতুককর ফারাকের কথা বলে আজকের আলোচনায় দাঁড়ি টানা যাক। আলোচ্য  দুটো কবিতাতেই Jumbly বা পাপাঙ্গুলদের প্রসঙ্গ নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র পাপাঙ্গুল বা Jumbly। দ্বিতীয় কবিতায় নামচরিত্র ডং হলেও সেখানে পাপাঙ্গুলদের উপস্থিতি আছে। 

এখন, প্রশ্ন হল, লিয়ার-কল্পিত এই ননসেন্স প্রাণীদের দেখতে কেমন? “Their heads are green, and their hands are blue.” মূল কবিতায় তাদের চেহারার বর্ণনা এটুকুই। সত্যজিৎ কিন্তু অনুবাদের সময় পাপাঙ্গুলদের হাতের রঙের কোনও প্রসঙ্গ আনলেন না। এই বদল কি কেবল অন্ত্যমিলের জন্য? লিয়ার নিজে কবিতার সঙ্গে যে অলংকরণ যোগ করেছেন, তা সাদা-কালো স্কেচ হওয়ায় রং বোঝার উপায় সেখানে নেই। লিয়ারের নিজের ছবি ছাড়াও তাঁর নন্‌সেন্স কবিতার সঙ্গে আরেকজনের অলংকরণ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি হলেন L. Leslie Brooke। লেসলি ব্রুকের ছবিতে জাম্বলিদের হাতের চেটোর রং নীল। মাথার চুল সবুজ। গায়ের বাকি অংশ বাদামি রঙের।  


তবে, ব্রুক এবং লিয়র দুজনের আঁকায় কিন্তু আকাশপাতাল ফারাক। লেসলি ব্রুকের ছবিতে ইংরাজি ফেয়ারি টেলের অলংকরণের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর আঁকা জাম্বলিদের সঙ্গে পাশ্চাত্য লোককথা-উপকথার নোম বা গবলিনদের চেহারার বেশ মিল রয়েছে। মুখের রেখায় বার্ধক্যের ছাপ। তাদের চুলের ছুঁচলো চুড়া যেন নোমেদের ছুঁচলো টুপিরই অনুকৃতি। 

 


১৯৮৬-তে ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ বেরনোর বহু আগেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘The Jumblies and Other Nonsense Verses’-এর লেসলি ব্রুকের ড্রয়িং-সম্বলিত-এডিশন। সুতরাং ধরে নেওয়াই যায় এই ছবিগুলোর সঙ্গে সত্যজিতের হয়তো পরিচয় ছিল। কিন্তু তাদের দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি তাঁর অনুবাদ। তিনি বুঝেছিলেন, লিয়ারের তৈরি জগৎ কিন্তু ঠিক রূপকথার জগৎ নয়। ননসেন্সের পৃথিবী লিয়ারের একান্ত নিজস্ব। এই উপলব্ধির ফলেই সত্যজিতের অনুবাদে পাপাঙ্গুলদের আচরণ ছেলেমানুষিতে ভরপুর। “They called aloud… we don’t care a button! We don’t care a fig!”-এর অনুবাদ – “তারা সবাই মিলে হাত-পা ছুঁড়ে বলে, মোরা থোড়াই কেয়ার করি, এই আমাদের মনের মতন তরী।” হাত-পা ছোঁড়ার ইমেজটি সত্যজিৎ নিঃসন্দেহে লিয়ারের ছবির অনুপ্রেরণাতেই যোগ করেছিলেন। কারণ তাঁর ছবিতে জাম্বলিদের চেহারা আর হাবভাব শিশুসুলভ। আর ঠিক একই কারণে লেসলি ব্রুকের আঁকা বাদামি দেহের জাম্বলিদের নস্যাৎ করলেন সত্যজিৎ। মূলের নীল হাতের অর্থ একটু বিস্তৃত করে নিয়ে তাদের চামড়ার রংই নীল বলে ধরে নিলেন তিনি। আর আমরা, পাঠকেরা, বিজাতীয় জাম্বলিদের পেরিয়ে পেয়ে গেলাম “নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল”ওলা আমাদের অতিপ্রিয় পাপাঙ্গুলদের!    




[লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত বিভিন্ন ছবির উৎস : অন্তর্জাল] 

[কভার ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]

#সত্যজিৎ রায় #হিরে মানিক জ্বলে #নিবন্ধ #সিরিজ #Series #Translation #Transcreation #Edward Lear #Limeric #The Jumblies #Dong #পাপাঙ্গুল #এডওয়ার্ড লিয়র #লিমেরিক #ছড়া #Nonsense Verse #Silly Point #সৃজিতা সান্যাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

219121