লোভের চোখ থেকে আড়াল খুঁজছি
কয়েক বছর আগের কথা। আমার এক বন্ধু, সদ্য বিয়ে হয়েছে তার। বিয়েবাড়ির হইহল্লা শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আবার যখন তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতে শুরু করল কর্মক্ষেত্রে, সবাই খেয়াল করছিলাম, মেয়েটি মনমরা। প্রথমে ভেবেছিলাম, বাড়িতে এতদিনের চেনা পরিসর, বাবা-মাকে ছেড়ে আসার কষ্ট হয়তো। তা ছাড়া, তার বর বিয়ে সেরেই চলে গেছে বিদেশে, নিজের কাজে। সেই একাকিত্বও কি ডানা ঝাপটাচ্ছে না তার উশকোখুশকো উড়ো চুলে? এসব নানান সাতপাঁচ ভেবে অফিসশেষে একদিন তাকে ডেকে নিয়েছিলাম আমাদের নিয়মিত আড্ডার ঠেক, কফিশপে। খানিক ছটফট করার পর, সেই বন্ধুটি আচমকা কেঁদে ফেলল, দুহাতে মুখ ঢেকে, রীতিমতো সশব্দে। আশেপাশের সবাই তাকাচ্ছে। খানিক ধাতস্থ হয়ে সে যা বলল, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। মেয়েটি লক্ষ করেছে, প্রতিদিন গভীর রাতে তার শ্বশুর কোনও-না-কোনও সময়ে উঠে এসে দরজা খুলে তাকিয়ে থাকছে তার দিকে। প্রথম দিন বুঝতে পারেনি, পালটা জিজ্ঞেস করেছিল, “কিছু বলবেন বাবা?” ছিটকে উঠে সরে-যাওয়া মানুষটির প্রতিক্রিয়া তাকে অবাক করেছিল। কিন্তু পরপর রোজ, একই ঘটনা। দরজা বন্ধ রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কারণ ওই ঘরেই রাখা থাকে অসুস্থ শাশুড়ির অক্সিজেন সিলিন্ডার। রাতদুপুরের জরুরি তলবের দাক্ষিণ্যে সে ঘর বন্ধ করা যায় না। মুশকিল হল, কথাটা বরকে জানানোর পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। এতটাই, যে, সে নিজেই নিজেকে নিয়ে প্রশ্নাতুর। আদৌ ঠিক ভাবছে সে? তারই কোনও ভুল হচ্ছে না তো?
গোপনে যুবতী পুত্রবধূর ঘুমন্ত, অসচেতন, অসাবধানী মুহূর্তের বিস্রস্ত শরীর দেখার এই তাড়না এক বিজাতীয় তৃপ্তির জন্ম দিচ্ছিল আসলে। ঠিক এই বিকৃত তৃপ্তির খবর আপনারা অবধারিতভাবে পাবেন যে-কোনও ছেলেদের মেস বা হস্টেলের আশেপাশের বাড়িগুলোর অন্দরমহল থেকে। কলকাতার একটি অন্যতম নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়েজ হস্টেলের প্রতিবেশিনীরা যেমন। ছাদে তাঁরা কাপড় মেলতে ওঠেন না, হস্টেলের দিকের কোনও জানলাই কখনও খোলা রাখার সাহস পান না। এমনকি, ক্লিপ দিয়ে রগরগে চিঠি-আটকানো পুরুষ অন্তর্বাস ছুড়ে ফেলা হয়েছে সদ্যবিবাহিত দম্পতির বারান্দায়, এ ঘটনাও সে চত্বরের ওপেন সিক্রেট। গোটা হস্টেলবাড়িটা জুড়ে যেন মানুষ নয়, শুধু জোড়া-জোড়া পুরুষচোখের বাস। তার শরীর নেই, মন নেই, হাত-পা-মাথা কিচ্ছু নেই— আছে শুধু অন্তর্ভেদী হায়নাচোখো শিকারি দৃষ্টি।
গোপন সেই আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাকে, তোমার সবটুকু, অথচ তুমি জানতে পারছ না কিছুই, নিয়ন্ত্রণ করতে পারছ না কিছুই— এই অবলোকনকামের অতলে ঢুকে আছে আসলে দু-ধরনের সন্তুষ্টি। এক, তোমাকে দেখে আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করছি, তোমার সম্মতি ছাড়াই। নিষিদ্ধ বস্তু চেখে দেখার উত্তেজনায় রোমাঞ্চিত হচ্ছে পুরুষ। গোটা বিষয়টায় অপর নারীটির কোনও সচেতন অংশগ্রহণই নেই, তার একান্ত ব্যক্তিগত নিভৃতির দৃশ্য ধরে ধরে রেকর্ড হয়ে থাকছে গোপন দর্শকের মস্তিষ্ককোশে। যা দেখা যাচ্ছে, তা গোপনীয়। যে দেখছে, সেও রয়েছে গুপ্ত। অথচ সতর্ক হওয়ার কোনও অবকাশই নেই ভোগ্যবস্তুটির— সে অজান্তেই দ্বিধাহীন পারফর্ম করে চলেছে কামুক পুরুষটির সামনে। দ্বিতীয়ত, বুঝতে ভুল হয় না যে, এই লুকিয়ে দেখার মধ্যে একটা প্রবল নিয়ন্ত্রণকামিতা আছে। কী দেখব, কতটুকু দেখব, কীভাবে দেখব— সমস্ত নিয়ন্ত্রণ এখানে দ্রষ্টার। যাকে দেখা হচ্ছে, তার অস্তিত্ব নয়, শারীরিক উপস্থিতিটুকুই শেষ কথা। আর যে দেখছে, তার শরীরও এখানে প্রবলভাবে হাজির, অথচ গোটা দৃশ্যটা থেকে সে নিজেকে স্রেফ অনুপস্থিত করে রেখে দিয়েছে!
কেন বারবার মেয়েদেরই ব্যক্তিগতর ভাঁড়ারে এই টান পড়ে? তাদের গোপনীয়তার অধিকার বারবার কেন খর্ব করা হয়? কারণ, গোপন করার একগুচ্ছ দায় মাথায় নিয়ে ছোটো থেকে বেড়ে ওঠে মেয়েরাই। বুকের ভাঁজ, খোলা ঊরু, গভীর নাভি, বাহুসন্ধির রোম, পোশাকের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসা স্ট্র্যাপ, অন্তর্বাসের মাপ, কেচে শুকোতে দেওয়া প্যান্টি, পিরিয়ডের ব্যথা, মেনোপজের বয়স— সব, স-অ-ব লুকোতে হবেই তাদের। যত গোপন, যত লুকোনো, ততই ফ্যান্টাসির উত্তুঙ্গ উদ্যাপন। দেহরহস্য অদ্ভুত, বিশেষত তা যদি হয় নারীদেহ। সে রহস্যের দিকদিশা পাওয়ার কত না কায়দা, কত না ফিকির, কত না পন্থা-অনুপন্থা! আবার সে রহস্য সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে গেলেও তৃপ্তি নেই। ধরা আর অধরার সুতোপরিমাণ ভেদরেখার ওপরে এই একবার এদিকে হেলে পড়ে, তো পরমুহূর্তেই টাল সামলে ঝুঁকে পড়ে অন্যদিকে। যে খোঁজের তল নেই, জেনেও শান্তি নেই। আছে শুধু বারবার জেনে ফেলার তাগিদে, দেখে ফেলার তীব্র বাসনায় একটি নারীর অজান্তেই তার নিভৃতিকে হত্যা করার জিঘাংসা।
গত কয়েকদিন ধরে আর জি কর কাণ্ডে নিহত মেয়েটির বিচার চেয়ে আপাতত উত্তাল হয়ে উঠেছে শহর-রাজ্য-দেশ-বিদেশ। যে নারকীয় হত্যাকে প্রথম চোটেই আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভরতি থাকা রোগীদের কাছেও বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে বুজিয়ে ফেলার লাগাতার চেষ্টা চলেছে, দৈনন্দিন পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় যাঁরাই প্রশ্ন তুলেছেন, সবাইকেই বারবার বলা হয়েছে ‘ও তেমন কিছু না, একটা বড় চুরি হয়ে গেছে হাসপাতালে, তাই এত কড়াকড়ি’— সেই হত্যারহস্যের বিচার চাইতে হলে সত্যপ্রকাশের দাবি যে সবচেয়ে বড়ো, তা নিয়ে সত্যিই তর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু এই সত্য জানা এবং জানানোর দায়ে যখন মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় মৃতার দুই পা ফাঁক করে পড়ে থাকা, রক্তাক্ত, অর্ধনগ্ন, মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া দেহ? যখন ময়নাতদন্তের ভুয়ো এবং আসল রিপোর্টের মধ্যে গরমিল মেলানোর নৃশংস অত্যুৎসাহে সোশাল মিডিয়ার প্রোফাইল থেকে প্রোফাইলে শেয়ার হতে থাকে মেয়েটির যোনি, বৃক্ক, যকৃতের ওজন? ঠিক কতটা বহিরাগত দেহরসের সন্ধান মিলেছে তার গোপনাঙ্গে, সেকথা যখন আর গোপন থাকে না কিছুতেই?
আমাদের দেশে ধর্ষিতা যখন সারভাইভর, তখনও তাকে বিচারব্যবস্থার নির্মমতম পরীক্ষা ও সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। শরীরই যেখানে অপরাধের মূল মোটিফ, শরীরই যেখানে অপরাধে আক্রান্ত, শরীর বনাম শরীরী আগ্রাসনের এই অভিযোগের প্রত্যেকটা পরতে পরতে তাই শরীরই হয়ে থাকে একমাত্র এভিডেন্স। বহু ক্ষেত্রে অত্যাচারিত মেয়েরা এই এভিডেন্স দাখিলের ভয়াবহ লড়াই থেকে বাধ্যত নিজেকে সরিয়ে নেন। প্রথমে পারিবারিক সালিশি সভায়, পরিচিত বৃত্তে, পাড়াপ্রতিবেশীর সমবেদনায় ঢাকা কৌতূহলের নিবৃত্তিতে, ভরা বিচারশালায় অচেনা মানুষের উৎসুক দৃষ্টির সামনে বারবার মেলে ধরতে হয় নিজেকে, বারবার সশব্দ রোমন্থনে ফিরে ফিরে যেতে হয় অত্যাচারমুহূর্তের কাছে, বারবার খোঁচা লাগে গভীর ট্রমার বিষজড়ানো পর্দায়। ধর্ষণ শারীরিকভাবে হয়তো একবারই ঘটে, কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং আরও অসংখ্যবার এই মানসিক ধর্ষণের বিধ্বস্ত ক্লান্তি মেয়েরা লুকোবে কোথায়?
আজ যে মেয়েটি বেঁচে নেই, বেঁচে থাকতে সেও হয়তো নিদেনপক্ষে চুলটুকু না আঁচড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েনি কখনোই। অথচ ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে নীল চাদরে আধঢাকা তার দেহ আজ কনটেন্ট। তার পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পোস্টমর্টেম চলছে খুঁটিনাটি বীভৎস বর্ণনা দিয়ে। নারকীয়তার যে সীমা নেই, শুধু সেটুকু বুঝেই ক্ষান্ত দেয়নি কেউ। অত্যাচারের ভয়ংকরতম বর্ণনার সম্ভাব্য স্ক্রিপ্ট চলে এসেছে বাজারে। সত্যি বলতে কী, তার যা সূক্ষ্ম ডিটেলিং, তাকে ‘রগরগে’ বলতেও আপনার বাধবে না। কীভাবে, কোথায় কোথায় বলপ্রয়োগ করা হয়েছে, কজন নিজের পুরুষাঙ্গ প্রোথিত করার সাফল্য উদ্যাপন করেছে, শ্রোণি-অস্থি পেনিট্রেশনের চাপে ভেঙেছে না ভাঙেনি— সমস্তই তো ‘তথ্য’, ‘খবর’। মৃতদেহের সম্মতি বলেও কিছু হয় না, গোপনীয়তা বলেও তাই কিছু নেই! আর যে মেয়ে দেশজোড়া এমন অভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু, আন্দোলনের স্বার্থেই তার দেহ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সবই তো সমাজ বদলের মূলধন, ‘জনচিত্তের জাগরণের’ মহার্ঘ্য উপকরণ! নিরঙ্কুশ বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্তটায় মেয়েটা সেমিনার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল যখন, গায়ের ওপরে নাকি পুরু করে টেনে দিয়েছিল লাল একটা কম্বল, শেষ আড়াল।
ওই লাল কম্বলটা গেল কোথায়?
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ
অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত
চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
মিছিলে পা মেলান, তবে মনে রাখুন…/মুনিয়া দেবলীনা
অন্ধকার পথে একলা হাঁটার স্বাধীনতা চেয়ে…/অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
নট অল মেন, কিন্তু.../ রণিতা চট্টোপাধ্যায়
আমরা শিখেছিলাম, চড় মারাই মেয়েমানুষের ওষুধ/ বিবস্বান
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র