ক্যানসারকে হারিয়ে ফুটবলে আফ্রিকাজয়ী, স্বপ্নের আরেক নাম সেবাস্তিয়ান হালার
ম্যাচের বয়স তখন আশি মিনিট। ফলাফল ১-১। প্রতিপক্ষ নাইজেরিয়ার গোলের মুখে বারবার আছড়ে পড়ছে আইভরি কোস্টের ফুটবলারদের আক্রমণ। মাত্র একটা গোলের অপেক্ষা। তাহলেই আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের শিরোপা উঠবে তাদের মাথায়। সেই সময় মাঠের বাঁ প্রান্ত থেকে উড়ে এল একটা বিষাক্ত ক্রস। বিপক্ষ ডিফেন্ডারের শরীর টপকে বেরিয়ে এল আইভরি কোস্টের স্ট্রাইকার সেবাস্তিয়ান হালারের পা। বুটের সামান্য টোকায় বলের মুখ ঘুরে গেল গোলের দিকে। দ্রুত গতিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন নাইজেরিয়ার গোলকিপার। কী হবে এরপর?
গোটা দুনিয়াটা বোধহয় তখন থমকে গেছিল হালারের কাছে। প্রতিটি মাইক্রো সেকেন্ডকে মনে হচ্ছিল এক-একটা মাস। যে মাসগুলো তিনি লড়াই করেছিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে। গোলমুখী বলের গতির সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ছিল অপেক্ষা, দুশ্চিন্তা। ঠিক যেভাবে তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সারের অভিশাপ। আজ তাঁর যুদ্ধজয়ের পালা। হার মানব না, হার মানা যাবে না। মাটি কামড়ে পড়ে থেকে যে অদম্য লড়াই করেছেন, আজ যেন সুদে-আসলে তার সমস্ত ফসল ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
থেমে যাওয়া সময় আবার গতি পেল। গোলকিপারের হাত টপকে জালে জড়িয়ে গেল বল। মাঠের কোণে এসে হালারের বাঁধন ছাড়া উচ্ছ্বাস জন্ম দিচ্ছিল এক নতুন রূপকথার। তৈরি হল ক্যান্সারকে হারিয়ে ফুটবলের মাঠে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠার গল্প। আর ওই গোলের সুবাদেই সদ্য সমাপ্ত আফ্রিকান কাপ নেশন চ্যাম্পিয়ন হল দিদিয়ের দ্রোগবার দেশ।
ফিরে যাওয়া যাক বছর দুয়েক আগে। নেদারল্যান্ডসের ক্লাব আয়াক্সের হয়ে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সের পর হালার তখন সই করেছে জার্মানির ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা সাত ম্যাচে গোল করার বিরল রেকর্ড তাঁর পকেটে। নেদারল্যান্ডসের লিগেও টপ গোল স্কোরার। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু জীবন অন্যদিকে বাঁক নিল ২০২২ সালের জুন-জুলাই মাসে। জানা গেল ম্যালিগন্যান্ট টেস্টিক্যুলার টিউমার বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। কর্কট রোগের হিংস্র থাবা কখন যেন ভিতর থেকে ছিড়ে ফেলেছে তাঁকে।
শুরু হল চিকিৎসা। দুটো সার্জারি আর চার দফা কেমোথেরাপির পর রোগমুক্ত হলেন তিনি। ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে সাত মাস। আদৌ কোনোদিন মাঠে ফিরতে পারবেন কিনা, নিশ্চিত নয়। নব্বই মিনিট তীব্র উত্তেজনা ধকল কি নিতে পারবে তাঁর শরীর? তিনি কিন্তু গত সাত মাস ধরে এক-একটা করে দিন গুনেছেন। নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করেছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তোলা সেলফিতে জানিয়েছেন প্রত্যাবর্তনের বার্তা। অবশেষে ২০২৩-র জানুয়ারি ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মাঠে নামলেন হালার। বরুসিয়া সমর্থকদের বিখ্যাত ‘ইয়েলো ওয়াল’ সাদর অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে।
কিন্তু পেশাদার ম্যাচে প্রত্যাবর্তনটা রাজকীয় হল না। দুর্দান্ত লড়াই সত্ত্বেও বুন্দেশলিগার ট্রফি হাতছাড়া করল বরুসিয়া। লিগের শেষ ম্যাচের পেনাল্টি-সহ একাধিক গোল মিস করলেন হালার। ম্যাচ ড্র। আরো একবার বুন্দেশলিগায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখল বায়ার্ন মিউনিখ।
২০২৩-২৪ মরশুমটাও শুরু হল ঢিমেতালে। ক্যান্সারের আগের গোলের বুটজোড়া তখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন হালার। এর মধ্যেই চলে এল আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস। আন্তর্জাতিক ফুটবলে হয়তো ইউরো বা কোপা আমেরিকার মতো জনপ্রিয় নয় এই ট্রফি। কিন্তু গোটা আফ্রিকার কাছে এ এক পুনর্মিলন উৎসব। নিজস্ব ভাষা, পোশাক, নাচ নিয়ে বিভিন্ন দেশের হাজারো হাজারো সমর্থক রঙিন করে রাখে প্রতিযোগিতার দিনগুলি। তাই চ্যাম্পিয়নের সম্মানও গোটা মহাদেশের কাছে আকাশছোঁয়া।
আইভরি কোস্টও শুরু করেছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার হিসেবে। প্রথম ম্যাচে খুব সহজে ২-০ গোলে হারায় গিনি বিসু-কে। তারপরই নামল বিপর্যয়। প্রথমে নাইজেরিয়ার কাছে ১-০ গোলে হার। শেষ ম্যাচে একুটোরিয়াল গিনির কাছে লজ্জার ৪-০ গোলে হারল তারা। টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত ধরে নিয়ে তড়িঘড়ি ছাঁটাই করা হল ম্যানেজারকে। আশ্চর্যের বিষয়, গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচের একটাতেও প্রথম একাদশে তো দূরের কথা, রিজার্ভ বেঞ্চেও নেই সেবাস্তিয়ান হালার। তাহলে কি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও খালি হাতে ফিরতে হবে তাঁকে?
ম্যাজিক কিন্তু তখনও বাকি ছিল। সম্ভবত হালারের জন্যই অপেক্ষা করছিল এক মিরাকল। গ্রুপে তৃতীয় হয়েও নক-আউট পর্বে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেল আইভরি কোস্ট। শেষ ষোলোর ম্যাচে দেখা হল প্রতিযোগিতার হট ফেভারিট সেনেগালের সঙ্গে। একদিকে কোচহীন আইভরি কোস্ট, অন্যদিকে বিপক্ষ দলে রয়েছে সাদিও মানে, কুলিবালি, এদোয়ার্দো মেন্ডির মতো তারকা। সেই ম্যাচে উদ্ধারকর্তা হিসেবে এগিয়ে এল টিমের ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্ক কেসি। ভক্তরা যাঁকে ভালোবেসে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে ডাকে। বহু স্বপ্ন নিয়ে প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনায় আসার পরের বছরেই বেচে দেওয়া হয় তাঁকে। সেনেগালের বিরুদ্ধে ম্যাচের ৮৬ মিনিটে পেনাল্টি থেকে তাঁর সমতা ফেরানোর গোলটাই অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে গেল ম্যাচটাকে। অবশেষে টাইব্রেকারে জয়।
কোয়ার্টার ফাইনালে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলে নাটকীয় জয় এল মালির বিরুদ্ধে। তুলনায় সহজ ম্যাচ ছিল সেমিফাইনালে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর। ম্যাচের ৬৫ মিনিটে একমাত্র গোলটি করলেন হালার। এবার ফাইনালে মুখোমুখি হতে হবে আরেক ফেভারিট নাইজেরিয়ার। ভিক্টর ওসিমেনের মতো তারকায় ভরা ‘সুপার ইগলস’দের কাছে গ্রুপ পর্বেই একবার হার মানতে হয়েছে আইভরি কোস্টকে। ফাইনালটা অবশ্য দাপটের সঙ্গেই শুরু করেছিল কেসিরা। কিন্তু গতির বিপরীতেই গোল দিয়ে দেয় নাইজেরিয়া। ম্যাচের ৬২ মিনিটে সমতা ফেরান ‘প্রেসিডেন্ট’ কেসি। আর তারপর ৮০ মিনিট নাগাদ হালারের পায়ে লেখা রইল জয়ের ঠিকানা। যাবতীয় হিসেব-নিকেশ উলটে দিয়ে ‘আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস’ চ্যাম্পিয়ন হল আইভরি কোস্ট।
তাঁরা যেন আরেকবার শিখিয়ে দিয়ে গেলেন ফুটবল মানেই শুধু সাফল্যের হিসাব রাখা নয়। তা জীবনের মতোই গড়ে-পিঠে নেওয়া একটা গল্প। লড়াইয়ের শক্তি আর স্বপ্ন দেখার সাহস। তথাকথিত বড়ো নামেদের আলোয় সেজে ওঠা শান বাঁধানো রাজপথের সমান্তরালেই কত ছোটো ছোটো ধুলোমাখা গলি এগিয়ে যায় অমরত্বের দিকে। ফের একবার মনে পড়তে পারে দিদিয়ের দ্রোগবার কথা। সেই দ্রোগবা, যিনি ফুটবলের ভালোবাসায় বেঁধেছিলেন দু'ভাগে বিভক্ত আইভরি কোস্টের হৃদয়কে। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের পর তাঁর আর্তিতেই থেমেছিল দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধ। কিন্তু গত বছরের শেষের দিক থেকে ফের অশান্ত হতে শুরু করেছে তাঁর দেশ। আফ্রিকান কাপ বিজয়ী হালাররা কি পারবেন আরেকবার দেশে শান্তি আনতে?
.................
#Sébastien Haller #footballer #Borussia Dortmund # Ivory Coast #silly পয়েন্ট #অর্পণ দাস