বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে : উপেক্ষিত এক যোদ্ধার গল্প
বাঙালি কর্তাভজা জাত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বরাবরের কলোনিয়াল হ্যাংওভার। সাহেবদের থেকে শিরোপা না পেলে আমরা কাউকে পুঁছি না। তাই বহু বহু প্রতিভা আমাদের অবহেলা গায়ে মেখে বিস্মৃতির অতলে চলে গেছেন। এমনই একজন অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর অণুজীববিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে। প্যাথোলজিতে বিশ্বজোড়া পরিচিতি তাঁর। নোবেলের জন্য একাধিকবার মনোনয়নও পেয়েছিলেন। অথচ সম্ভবত নব্বই শতাংশ বাঙালি তাঁর কাজ তো দূরে থাক, নাম সম্পর্কেই অবহিত নন সেভাবে। সব থেকে বড় কথা, তাঁর বিজ্ঞানসাধনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘ একটি অংশ কিন্তু কেটেছে কলকাতারই বুকে। শুধু স্বাধীনতা-আন্দোলন, শিক্ষার প্রসার, খেলাধূলা, শিল্প আর সংস্কৃতিই নয়, বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও যে কলকাতার ইতিহাস কতটা সমৃদ্ধ ছিল তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৯ সালে এই শহরে বুকেই শম্ভুনাথ দে-র কলেরা-টক্সিন আবিষ্কারের ঘটনা আরও একবার ফিরে দেখলে।
যে কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজন হয় অসীম ধৈর্য্য, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। আর এই সবকিছুরই মিশেল ঘটেছিল শম্ভুনাথের মধ্যে৷ তাঁর জন্ম ১৯১৫ সালে। বঙ্গভঙ্গের ক্ষত তখনও শুকায়নি। একদিকে ব্রিটিশদের অত্যাচার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, “দু-টুকরো” হয়ে যাওয়া বাঙালী সত্ত্বা, আর অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে কলেরার প্রকোপ, সবমিলিয়ে সে এক অস্থির সময়। তখন কে-ই বা জানতো, খোদ বাংলার হুগলী জেলার গরিবাটি গ্রামের এই ছোট্ট ছেলেটিই একদিন কলেরা রোগকে বাগে আনার গবেষণায় গোটা পৃথিবীকে নতুন পথের সন্ধান দেবে। অভাবের সংসারে বালক শম্ভুনাথের মেধাকে চিনতে ভুল হয়নি তাঁর পিতৃব্য শ্রী আশুতোষ দে-র৷ একজন দক্ষ কুম্ভকার যেমন মাটির তাল থেকে সুন্দর সুন্দর পাত্র গড়ে তোলেন, ঠিক সেভাবেই শম্ভুনাথ-কে শিক্ষিত করে তোলার যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন আশুতোষ। গরিবাটি উচ্চবিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করার পর শম্ভুনাথ ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ নিয়ে হুগলীর মহসিন কলেজে ভর্তি হন৷ ঠিক এইসময়েই আশুতোষের অকালমৃত্যু যখন তাঁকে মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান কেষ্টধন শেঠ নামে কলকাতার এক ধনকুবের ব্যবসায়ী। মূলত তাঁর সাহায্যেই শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পান এবং কঠোর অধ্যবসায়ের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে ১৯৩৯ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে রোগবিদ্যা (প্যাথোলজি)-তে এম বি এবং ১৯৪২ সালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিকিৎসাবিদ্যায় (ট্রপিকাল মেডিসিন) ডিপ্লোমা সম্পূর্ণ করেন। অতঃপর তিনি সেখানকারই প্যাথোলজি বিভাগের ডেমন্সট্রেটর নিযুক্ত হন এবং পাশাপাশি প্রোফেসর বি.পি. ত্রিবেদীর কাছে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। এরপর ১৯৪৭ সালে তিনি লন্ডনের University College Hospital Medical School-এর মরবিড অ্যানাটমি বিভাগের প্রোফেসর স্যার রয় ক্যামেরনের কাছে তাঁর পিএইচডি শুরু করেন। হাইড্রোসেফালাস অর্থাৎ মস্তিষ্কে CSF (Cerebro-spinal fluid বা মস্তিষ্ক-সুষুম্না রস) জমা হওয়ার বিভিন্ন প্রভাবগুলি খুঁজে বের করাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়।
ওলাওঠা রোগ বা কলেরা দীর্ঘ সময় ধরে ছিল বাংলার ক্রনিক ঘাতক। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত এই ভয়ানক রোগের দাপটে। ঊনবিংশ শতক থেকেই বাংলায় কলেরার প্রকোপ ভয়ঙ্কর হারে বাড়লেও তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়নি বললেই চলে। সেই নিয়ে বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী রবার্ট কখ্ উদ্বেগও প্রকাশ করেন। ১৮৮৪ সালে কখ্ কলকাতায় এসে গবেষণার সময় কলেরা রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু Vibrio cholerae আবিষ্কার এবং পৃথক করেন। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু এবং তাদের রোগসৃষ্টি করার পদ্ধতি নিয়ে কখ্-এর স্বীকার্যগুলি “Koch's postulates” নামে পরিচিত। এই স্বীকার্যগুলি হল-১) যে কোনও রোগের ক্ষেত্রেই রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।২) সংশ্লিষ্ট রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবটিকে আক্রান্তের দেহ থেকে পৃথক করা সম্ভব এবং বিশুদ্ধ-সমষ্টিরূপে তার বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব।৩) বিশুদ্ধ-সমষ্টি থেকে প্রাপ্ত অণুজীবটিকে একটি সুস্থ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করালে সেটি আবার রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম।৪) আক্রান্তের দেহ থেকে পৃথক করে রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবটিকে আবার তার প্রাথমিক রূপে ফিরে পাওয়া সম্ভব।
কখ্ গবেষণার মাধ্যমে তাঁর প্রথম দুটি স্বীকার্যকে প্রমাণ করতে পারলেও তৃতীয়টি পারেননি। দীর্ঘ ৭৫ বছর কাজটি সেই অবস্থাতে আটকে থাকার পর নতুন গতি পায় ১৯৫৯ সালে শম্ভুনাথ দে-র কলেরা-টক্সিন আবিষ্কারের পর। একইসঙ্গে কখের স্বীকার্যগুলিও প্রমাণিত হয় ও পূর্ণতা পায়। পূর্ববর্তী কিছু গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের ধারণা তৈরি হয়েছিল কলেরা-টক্সিন হয়তো এন্ডোটক্সিন, যা কোশের ভিতরে অবস্থান করে এবং শুধুমাত্র বিনষ্টিকরণের পরই কোশের বাইরে আসে। কিন্তু শম্ভুনাথ দে প্রথম প্রমাণ করেন যে এটি একটি এক্সোটক্সিন, যা জীবিত কোশের বাইরে নিঃসৃত হয়ে কাজ করে। তিনিই প্রথম দেখান যে, Vibrio cholerae ক্ষুদ্রান্ত্রের মিউকাস পর্দার ভেদ্যতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানকার রক্তজালক থেকে জলবিয়োজন বা ডিহাইড্রেশানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে জল ও ইলেকট্রোলাইট বা তড়িৎবিশ্লেষ্যের নির্গমন ঘটায়। এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য তিনি oral rehydration therapy (ORT)-এর মাধ্যমে বাইরে থেকে জল, ইলেকট্রোলাইট (লবণ) ও গ্লুকোজের মিশ্রণ প্রয়োগ করেন। শিরার মাধ্যমে চালিত পদ্ধতির (Intraveinous therapy) তুলনায় ORT ছিল অনেক সহজ, সুলভ, কার্যকরী এবং অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল। তাঁর এই গবেষণা জনস্বাস্থ্যের ওপর এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। এর ফলে কলেরার মৃত্যুহার একধাক্কায় ৩০% থেকে কমিয়ে প্রায় ৩.৬%-এ নিয়ে আসা সম্ভব হয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ORT-র কার্যকারিতা প্রথম প্রমাণিত হয়৷ সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে অশান্ত সেই সময়ে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত রিফিউজি ক্যাম্প-গুলিতে কলেরা মহামারীর আকার নেয়। তখন প্রায় ৩৭০০ আক্রান্তের ওপর ORS (oral rehydration salt) প্রয়োগ করা হলে প্রায় ৯৬% আক্রান্ত সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। অতঃপর, ১৯৮০ সালে World Health Organization (WHO) মান্যতা দেয় ORS-এর ফর্মূলাকে।
শম্ভুনাথ দে-র এই কাজ সারা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়। তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন নোবেলজয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী জোশুয়া লিডারবার্গ। এমনকি একাধিকবার শম্ভুনাথ দে-কে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন, যদিও শেষপর্যন্ত শম্ভুনাথ ব্রাত্যই থেকে যান। ১৯৭৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসরগ্রহণ করলেও তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭৮ সালে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে কলেরা এবং ডায়ারিয়া রোগ-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু এই বিদ্বানের গবেষণার কাজ বিদেশে সমাদৃত হলেও স্বদেশে উপযুক্ত সম্মান তাঁর অধরাই থেকে যায়। ১৯৮৫ সালে তাঁর প্রয়াণের মধ্যে দিয়ে বাংলা তথা ভারতের রোগবিদ্যার ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়ের অবসান ঘটে৷ যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা এভাবেই ইতিহাস ও মানুষের কাছে উপেক্ষার পাত্র হয়েও বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে গেছেন, রোগ-মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রাণপাত করেছেন বারবার। এখন আমরা তাঁদেরকে, তাঁদের কাজকে আর বিজ্ঞানচিন্তাকে আপন করব? নাকি ওলাবিবির শরণাপন্ন হয়েই থেকে যাবো চিরকাল, সে বিচারের ভার আমাদেরই ওপর।
ঋণস্বীকার:১) “New Drug Targets for Cholera Toxin”- by J. R. Thiagarajah and A. S. Verkman. “Trends Pharmacol Sci.” জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র।২) “From endotoxin to exotoxin: De’s rich legacy to cholera”- by G Balakrish Nair a & Jai P Narain. “Public health classics” জার্নালে প্রকাশিত একটি রিভিউ।৩) “History of Development of Oral Rehydration Therapy”- by S K Bhattacharya. “Indian J Public Health” জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র।৪) উইকিপিডিয়া।
[পোস্টার : অর্পণ দাস।]
#বিজ্ঞান #বিজ্ঞানী #শম্ভুনাথ দে #রাহুল দত্ত #স্মৃতি