নতুন গাছ লাগানোর থেকেও বেশি জরুরি পুরনো গাছ বাঁচানো, বলছেন বিজ্ঞানীরা
“গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান” স্লোগান আমাদের সকলেরই জানা। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত এত কথাবার্তা হচ্ছে, তখন আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বেশি বেশি করে গাছ লাগানোই বোধহয় এই ক্ষতি পূরণের প্রধানতম উপায়। বিজ্ঞানীরা কিন্তু এমন মনে করছেন না, বরং তাঁরা অনেক বেশি জোর দিতে বলছেন পুরনো গাছ বাঁচানোয়। কোনও কোনও বিজ্ঞানী তো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করছেন, যত্রতত্র যথেচ্ছ গাছ লাগানোও প্রকৃতির বিপদ ডেকে আনতে পারে।
একমাত্র গাছ লাগানোই প্রকৃতির অসুখের প্রতিষেধক নয়। জলবায়ু পরিবর্তন অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র গাছ লাগিয়েই এই প্রক্রিয়াকে রদ বা বদল করা সম্ভব নয়, বরং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। ২০১৪ সালে বিজ্ঞানী নাদিম উঙ্গার নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে প্রথম এই দাবি করেন। তাঁর গভীর চিন্তা এবং গবেষণার ফসল এই এই অভিমত। নাদিম উঙ্গারের এই অভিমত পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। কতটা পরিমাণ সূর্যালোক পৃথিবীতে আসছে এবং তার কতটা অংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে পৃথিবীর উষ্ণতা। গাছ গাঢ় রংয়ের বস্তু, তাই তার তাপশোষণ ক্ষমতা বেশি। ২০০৭ সালে ইউরোপ এবং কানাডার বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, গাছ লাগানোর আদর্শ জায়গা হল নিরক্ষীয় অঞ্চল বা ট্রপিক্যাল রিজিয়ন। কারণ এই অঞ্চলে গাছের বৃদ্ধির হার বেশি এবং এই অঞ্চলের গাছ সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এই গবেষণায় এটাও দেখানো হয়েছিল যে মেরু প্রদেশে গাছ লাগানো জলবায়ুর পক্ষে ক্ষতিকর, এতে বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে যেতে পারে। এই গবেষণার সারমর্ম এই যে, গাছ জলবায়ু পরিবর্তনে তখনই সাহায্য করবে যখন তা ঠিকঠাক জায়গায় লাগানো হবে। এছাড়াও নাদিম তাঁর গবেষণায় বলেছেন যে, গাছ থেকে এক ধরনের জৈবরাসায়নিক গ্যাসীয় পদার্থ (volatile organic compounds, VOCs) নির্গত হয় যা পরবর্তীতে ওজোন এবং মিথেনের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি করতে সাহায্য করে।
নাদিমের এই গবেষণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁরা বলেছেন, নতুন গাছ লাগানোর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে গাছগুলি আছে তাদের বাঁচিয়ে রাখা। গাছ লাগানোর জন্য সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়, কিন্তু গাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাওয়া যায় না। তাই অনেক জায়গায় গাছ লাগানো হয় শুধুমাত্র অর্থকরী দিক বা সৌন্দর্যায়নের কথা ভেবে, পরিবেশের স্বার্থে নয়, এবং প্রয়োজন মিটে গেলেই সেই গাছ কেটে ফেলা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের অতি পরিচিত ইউক্যালিপটাস গাছের কথা। আমরা গাছ লাগানো দেখে আনন্দিত হই, কিন্তু ইউক্যালিপটাস লাগানোই হয় অর্থকরী উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। তাছাড়া এই গাছের অত্যধিক জল শোষণের ক্ষমতা পরিবেশের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়।
মোটামুটি দেখা গেছে যে চারাগাছের বেঁচে থাকার হার পঁচিশ শতাংশ। অর্থাৎ, চারটে গাছ লাগানো হলে জলের অভাব, পোকামাকড়ের আক্রমণের মতো প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারে মাত্র একটা গাছ। আবার একটা গাছের পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠার জন্য পনেরো থেকে তিরিশ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তার মানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের উদ্দেশ্যে গাছ লাগানো হলে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হতে সময় লাগবে প্রায় দু’দশকেরও বেশি। অর্থাৎ ব্যপারটা দাঁড়াচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সবচাইতে বেশি জরুরি পুরনো গাছ এবং জঙ্গলের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ।
এর পাশাপাশি নতুন গাছও লাগানো জরুরি। কারণ গাছ শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকেই আটকায় না; গাছের সাথে জড়িয়ে আছে বাস্তুতন্ত্র, ভূমিক্ষয় রোধ, শহুরে উষ্ণ দ্বীপপুঞ্জ (urban heat island) থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি নানারকম বিষয়। তবে শুধু নিয়মরক্ষার জন্য যে কোনও জায়গায় যে কোনও গাছ লাগিয়ে ফেললে চলবে না; সত্তর-আশির দশকে বিশ্ববব্যাপী গাছ লাগানোর হিড়িক উঠেছিল, প্রায় গোটা ইউরোপ জুড়ে এক বিশেষ প্রজাতির ঝাউ বা কনিফার গাছ লাগানো হয়েছিলো, বাংলার প্রায় সর্বত্রই ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো হয়েছিল। এর অনেক আগে গোটা দার্জিলিং জুড়ে ব্রিটিশরা জাপানি সিডার গাছ লাগিয়েছিল। এর কোনোটারই ফল ভবিষ্যতে সুখপ্রদ হয়নি। মনোকালচার বা একই ধরনের গাছ অত্যধিক পরিমাণে লাগানো জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রের নিয়মের পরিপন্থী। আর প্রাকৃতিক নিয়মের অন্যথা হলে প্রকৃতির প্রতিবাদও অনিবার্য।
গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের হার কিছু কমাতে পারে, কিন্তু পরিবর্তন থামিয়ে দিতে পারে না। তাই গাছ লাগানোর পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন অরণ্য সংরক্ষণ, বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করা, জ্বালানির ব্যবহার কমানো, জলের অপচয় রোধ করা, প্লাস্টিকের মতো ক্ষতিকর জিনিসের ব্যবহার একেবারে কমিয়ে আনা এবং পরিবেশ-বান্ধব জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়া। গাছ অবশ্যই লাগাতে হবে, তবে তা যেন নিছক অপরিণামদর্শী শখ মেটানো হয়েই না থেকে যায়, বৃহত্তর উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রাখা জরুরি।
ঋণ : ১) www.sciencemag.org
২) www.sobujprithibi.in