বইয়ের খবর

বইয়ের সত্যজিৎ, সত্যজিতের বই

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য May 4, 2022 at 3:58 am বইয়ের খবর

বই : বইয়ের অনুষঙ্গে সত্যজিৎ
লেখক : ঋত্বিক মল্লিক
প্রকাশক : পত্রলেখা
প্রকাশ : ২০২২
মূল্য : ২০০/-

মনে রাখতে হবে সত্যজিৎ যে বৃত্তের মানুষজনদের নিয়ে সাহিত্য বা চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন তাঁরা মূলত ভদ্রবিত্ত, এবং বইপড়ার অভ্যাস তাঁদের সহজাত। শিক্ষাই যাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি, বই যে তাদের স্বাভাবিক সঙ্গী হবে এতে আর আশ্চর্য কোথায়? সত্যজিতের কালজয়ী চরিত্ররা যেমন ফেলুদা, সিধু জ্যাঠা, শঙ্কু বা তারিণীখুড়ো- পড়ার ব্যাপারে কেউ কম যান না। আবার বই যারা না পড়ে খালি কমোডিটির মত সাজিয়ে রাখে, তাদের মোটেই ভালো চোখে দেখা হয় না সত্যজিতের পৃথিবীতে, যেমন বোম্বাইয়ের বোম্বেটে গল্পে সগর্বে ‘আই ডোন্ট রিড দেম!’ ঘোষণা করা মিঃ গোরে।

সত্যজিতের পৃথিবীতে বইয়ের এই সর্বাঙ্গীন উপস্থিতিকেই বিভিন্নভাবে পর্যালোচনা করেছেন ঋত্বিক মল্লিক। বই শুরু হয়েছে পাঠাভ্যাস সম্বন্ধে সত্যজিতের নিজের কিছু বক্তব্য দিয়ে। প্রথম জীবনে মূলত রহস্য কাহিনী বা থ্রিলার প্রেম থেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে পড়াশোনা আরো গভীর হওয়া। সিনেমার বই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বই থেকে কমিকসের প্রতি টান- সবই উঠে এসেছে এই অংশে। সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি- ‘আই ওয়াজ আ ভোরাশিয়াস রিডার।‘ পরবর্তী অধ্যায়ে এসেছে সত্যজিতের সৃষ্ট পড়ুয়া চরিত্রদের কথা। তাঁর নিজের পুরনো বইয়ের প্রতি নেশাই যেন প্রতিফলিত হয় ‘বর্ণান্ধ’ বা ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’ গল্পের চরিত্রদের মধ্যে। বিপিন চৌধুরী থেকে মিঃ শাসমল, ‘লাখপতি’ বা ‘ভক্ত’ থেকে ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’, প্রতি গল্পেই উপস্থিত পড়ুয়া মানুষেরা, তারা ট্রেনে পড়ে, রাতে ঘুমোবার আগে পড়ে, হোটেলে বসে পড়ে। ফেলুদার বইপ্রেম তো বারেবারেই উঠে আসে তোপসের কথায়। ফেলুদা দানিকেন পড়ে, কালীসিংহের মহাভারত পড়ে, টিনটিন পড়ে। তোপসে স্বেন হেদিন পড়ে, জটায়ুর রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ে, জটায়ু নিজে পড়েন বাঙালির সার্কাস বা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। সোনার কেল্লা ছবিতে ট্রেনে বসে ফেলুদাকে পড়তে দেখা যায় প্যারাসাইকোলজির জার্নাল, আর তোপসেকে টিনটিন ইন টিবেট। লালমোহনবাবু আবার ঘুরছেন হিন্দি ভাষা শেখবার গাইড বই নিয়ে।

রহস্য রোমাঞ্চের উপাদান যাঁর লেখায় বারেবারেই এসেছে, সেই সত্যজিতের গল্পে বা সিনেমাতেও তাই পাওয়া যায় রহস্য লেখকদের বইয়ের উল্লেখ। কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, এলেরি কুইন প্রভৃতি রহস্য লেখকদের বই মাঝেমধ্যেই পড়ে সত্যজিৎ সৃষ্ট চরিত্ররা। রহস্য লেখকের উপস্থিতি, ফেলু সিধুজ্যাঠা বা শঙ্কুর পাঠাভ্যাসের পাশাপাশি সত্যজিতের কাজে টিনটিন সিরিজের প্রভাব বা ডেভিড ম্যাককাচনের উপর আলাদা অধ্যায় এ বইয়ের বাড়তি পাওনা। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে হরফ নিয়ে সত্যজিতের আগ্রহ বা বিবর্তনবাদ নিয়ে তাঁর পড়াশোনা, সত্যজিৎ নিয়ে হালফিলের বাজারে প্রচুর লেখালেখি হলেও এসব নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না। সিনেমা নিয়ে দিস্তা দিস্তা লেখা হলেও তাঁর ছবিতে বইয়ের চিত্রায়ণ বা বই সম্বন্ধে সংলাপ নিয়ে আলাদাভাবে কথাই বা তেমন হয় কই? লেখক সমাপ্ত করেছেন বড় সুন্দর একখানা কথা মনে করিয়ে দিয়ে- বই ছিল সত্যজিতের কাছে বাইরের জগত দেখবার জানলা, ঘরকুনো হয়ে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকার জীবনবিমুখতাকে তিনি কখনো সমর্থন করেন নি। তাই তো পড়ুয়া হলেও ফেলুদা, শঙ্কু বা তারিণীখুড়ো হামেশাই বেরিয়ে পড়ে নতুনের সন্ধানে। ক্যামেরার পিছনে সত্যজিতের শেষ কাজ আগন্তুক ছবিতে বিদায় নেবার আগে মনমোহন মিত্র বালক সাত্যকিকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেয়, সে কখনও কূপমণ্ডূক হবে না।

ঝরঝরে গদ্যের পাশাপাশি একাধিক প্রাসঙ্গিক ছবি এ বইকে সার্থক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। লেখক ভাবনার অভিনবত্ব এবং পরিপাটি উপস্থাপনার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন। সত্যজিতের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে উনকোটি চৌষট্টিরকম স্মৃতিচারণ আর একঘেয়ে শ্রদ্ধা-নিবেদনের মধ্যে এই মননশীল বইটি সত্যিই টাটকা হাওয়ার মতো।         

#বইয়ের অনুষঙ্গে সত্যজিৎ #সত্যজিৎ রায় #ঋত্বিক মল্লিক #পত্রলেখা #বইয়ের খবর #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

42

Unique Visitors

215820