সন্ন্যাস নেবার পরেও গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করতেন সতীশচন্দ্র ওরফে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ
বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামের তালিকা করতে বসলে বোধহয় বাংলার সমস্ত ফুল পঞ্জিকার সম্মিলিত পৃষ্ঠাসংখ্যাকেও ছাপিয়ে যাবে। ফলে অনেকের নাম এবং কীর্তিই আমাদের অজানা থেকে যায়। এমনই একজন হলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯২১), পরবর্তী জীবনে সন্ন্যাস নিয়েও যিনি বিপ্লবের পথ থেকে সরে আসেননি।
সতীশচন্দ্রের জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে। সেখানে স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথমে তিনি গ্রামের স্কুলে কিছুদিন ও পরে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। নিয়মবদ্ধ লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই তাঁর সন্ন্যাসীদের জীবনযাপন সম্পর্কে এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ায় বেশ আগ্রহ ছিল। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে বিপ্লবী অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে বরিশালে 'কর্মীসংঘ' স্থাপিত হয়, যা পরে 'স্বদেশবান্ধব সমিতি' নামে পরিচিত হয়। এই সমিতির সহ-সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন সতীশচন্দ্র। অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে বরিশালে বিলাতি দ্রব্য বর্জন শুরু হলে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন, তখন সতীশচন্দ্র এই সমিতির নেতৃত্ব দেন। এই সময়ের মধ্যেই সতীশচন্দ্র 'যুগান্তর' দলে যোগ দেন। এরপর বাংলায় এইসব সমিতি নিষিদ্ধ হয় এবং সতীশচন্দ্র প্রত্যক্ষ আন্দোলন থেকে সরে আসেন।
বরিশালে আচার্য শংকরানন্দ সরস্বতীর আদর্শে তাঁরই নামাঙ্কিত মঠ স্থাপন হয়। ঈশ্বরচিন্তা ছাড়াও এর উদ্দেশ্য ছিল জনসেবা ও শিক্ষাবিস্তার। সতীশচন্দ্র এই মঠের প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা নেন। এখানেই তিনি শংকরানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ও নতুন নাম নেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী। এরপর আজীবন তিনি এই নামেই পরিচিত হয়েছেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর বেশ কিছুদিন তিনি বিভিন্ন তীর্থভ্রমণ করেন এবং ধর্মসংক্রান্ত পড়াশোনা করেন। কিন্তু পূর্বাশ্রমের সমস্ত সংসর্গ তিনি ত্যাগ করেননি। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করলেও দেশকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষা এবং চেষ্টা থেকে তিনি মুহূর্তের জন্যেও বিরত হননি। গোপনে তিনি স্বদেশি আন্দোলনকারীদের সাহায্য করতেন, যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন দেশকে স্বাধীন করতে এগিয়ে আসার জন্য। সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর কার্যাবলি সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিল এবং তাঁকে নজরাধীন রেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সতীশচন্দ্রের পরোক্ষ অংশগ্রহণ এবং বিপ্লবী যুবকদের তাঁর প্রতি দুর্বার আকর্ষণ দেখে পুলিশ তাঁকে স্বগৃহে নজরবন্দি হয়ে থাকার আদেশ দেয়। এই আদেশ সতীশচন্দ্র অস্বীকার করলে তাঁকে শংকর মঠে রাখার ব্যবস্থা হয়। এখানেও পুলিশের নজর এড়িয়ে বিপ্লবীরা নিয়মিত সতীশচন্দ্রের সাথে দেখা করে উপদেশ ও পরামর্শ নিতেন। শত শত বিপ্লবী শংকর মঠে দীক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজ ঝাঁপিয়ে পড়ত।
সতীশচন্দ্রকে কোনওভাবেই নিরস্ত করতে না পেরে এরপর ইংরেজ সরকার তাঁকে মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে অন্তরীণ থাকার নির্দেশ দেয়। প্রায় তিনবছর তিনি মহিষাদলে ছিলেন। এখানেও তিনি আঞ্চলিক যুবকদের স্বদেশি ভাবাদর্শে প্রভাবিত করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। অনেক দূরদূরান্ত থেকেও গ্রামবাসীরা আসত তাঁর কাছে রোগের চিকিৎসা করাতে ও ধর্মীয় উপদেশ শুনতে। এখানে থাকাকালীনই সতীশচন্দ্র অনুগামীদের দিয়ে প্রচুর বইপত্র সংগ্রহ করান সাধারণ মানুষের জন্য। তাছাড়া নিজেও ধর্মবিষয়ক বেশ কয়েকটি পুস্তিকা, যেমন 'বেদান্তদর্শনের ইতিহাস', 'রাজনীতি', 'কর্মতত্ত্ব' প্রভৃতি রচনা করেন।
মহিষাদলে থাকাকালীন ম্যালেরিয়া জ্বরে সতীশচন্দ্র বেশ কাবু হয়ে পড়েন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রচুর লেখাপড়া করার পরিশ্রম, ফলে শরীর ভেঙে পড়ে। তিন বছর পর সরকার থেকে তাঁর মুক্তির আদেশ হয়। পরে ভক্তদের অনুরোধে আরেকবার মহিষাদলে আসেন, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যই বেশিদিন থাকতে পারেননি। এরপর মধ্যপ্রদেশের বরদুয়ারে এক শিষ্যের কাছে যান স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য, কিন্তু সেখানে অবস্থার আরো অবনতি হওয়ায় কলকাতায় তাঁকে ফেরত আনা হয়। কিছুদিনের মধ্যে কলকাতাতেই তাঁর দেহান্ত হয়। হাওড়ার শিবপুরে তাঁর ভক্তরা তাঁর নামে একটি স্কুল খোলেন। স্কুলটির নাম শিবপুর স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়, যা সংক্ষেপে শিবপুর এস.এস.পি.এস. বিদ্যালয় নামে পরিচিত।
#swami prajnanananda #Satishchandra Mukhopadhyay #Indian Freedom Fighter #Indian Freedom Fight #বরিশাল #বিপ্লবী সমিতি #শংকর মঠ #স্বামী শংকর আচার্য #মহিষাদল #শিবপুর এস.এস.পি.এস. বিদ্যালয়