সরোজ দত্তের এনকাউন্টার, উত্তমকুমার এবং একটি ভুলে যাওয়া কবিতা
১৯৭১ সাল। পশ্চিমবাংলায় ঘোরতর নকশাল আমল। বাতাসে বারুদের গন্ধ।
দিনটি ছিল ৫ অগাস্ট। উত্তমকুমার প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ময়দানে মর্নিং ওয়াকে যেতেন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাস্তায়। মহানায়ক কয়েকটা চক্কর দিতেন, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন, তারপর ফিরতেন। ৫ অগাস্ট তাঁর চোখের সামনে পুলিশ একটা এনকাউন্টার করল। যাকে মারা হল, তিনি নকশাল নেতা সরোজ দত্ত। কাগজে- কলমে তিনি আজও নিখোঁজ, বলাই বাহুল্য।
রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও সরোজ দত্ত ছিলেন একজন কবি, লেখক, অনুবাদক ও পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক। সব মিলিয়ে সেকালের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনের একেবারে শুরুতে তিনি অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে সেখান থেকে বরখাস্ত হন। প্রথমবার গ্রেপ্তার হন ১৯৬২ সালে, খুব অল্প সময়ের জন্য। ১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম)- এ যোগ দেন। পার্টির অন্যতম মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’র সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সুশীতল রায়চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির ঘটনার প্রতিবাদে যে আন্দোলন জন্ম নেয়, তাকে তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন। দু’ বছর পর পুরনো দল ভেঙে চারু মজুমদারের সঙ্গে তৈরি করেন সিপিআই(এম-এল)। খুব কম সময়েই নকশাল আন্দোলন আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং চারু মজুমদার, সরোজ দত্তরা পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ঢুকে যান। এরপর বেশ কিছুদিন তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ বা ৫ অগাস্ট দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। কাজ শেষ করে ভোরের ময়দানে। আর মজার কথা, অত ভোরেও এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনিও আবার যে সে নন, বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ম্যাটিনি আইডল।
উত্তমকুমারের চোখের সামনে যে এরকম একটা এনকাউন্টার হয়েছিল এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় তাঁর নানা ঘনিষ্ঠ মানুষের বয়ান থেকে। সেদিন বাড়ি ফিরে তিনি নাকি অসুস্থ বোধ করছিলেন। তিনদিন শুটিং করতে পারেননি। তবে যে ব্যক্তিকে খুন করা হয়েছিল তিনিই নকশালকুলচূড়ামণি সরোজ দত্ত কিনা সেই নিয়ে অবশ্য বিতর্কের অবকাশ রয়েছে আজও। সে বিতর্ক থেকেই যাবে। শোনা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা তাঁকে মিষ্টি কথায় সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন – “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” অন্য কেউ হলে হয়তো তাঁকে সরিয়েই দেওয়া হত। সকলেই জানেন এসব কাজের সাক্ষী রাখতে নেই। কিন্তু তিনি যে উত্তমকুমার।
সত্যি হোক বা গুজব, আর পাঁচটা মুখরোচক খবরের মতো বাঙালি এই ঘটনাটিকে মোটামুটি মান্যতা দিয়ে দিয়েছে। র্যাডিকাল বুদ্ধিজীবী মহল তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। উপস্থিতি প্রমাণিত না হলেও, মহানায়ককেও কম ব্যঙ্গবাণ সহ্য করতে হয়নি। সে সময় বাম মনোভাবাপন্ন কবি বিমল দেব এই নিয়ে একটি জ্বালাময় কবিতাও লিখেছিলেন। কবিতার নাম ‘উত্তমকুমারের মর্নিং ওয়াক’। পাঠকদের জন্য সেই কবিতাটি (বানান অপরিবর্তিত রেখে) আমরা উদ্ধার করছি –
কলকাতায় তখন ব্রাহ্মমুহূর্তপরাবাস্তব আলোয় জেগে উঠেছিলোরূপকথার পৃথিবীসবুজ ঘাসে মন্দাক্রান্তা ছন্দেহেঁটে যাচ্ছিলেন বাঙালীর মহানায়কতার পা ফেলার ছন্দে হেসে উঠছিলোময়দানের ব্যাকুল হাওয়ালঞ্চের সিটি গঙ্গার ওপারে হাওড়া ব্রীজের বিভ্রমধীরে উদাসীন হয়ে যাচ্ছিলেনশহরের ম্যাটিনি আইডলহঠাৎ দেখলেন, তিনটি মানুষএকজন কবিকে হত্যা করলো, শব্দ নেইএক অদ্ভুত তাৎপর্যময় নীরবতা চূড়ান্ত খুনঅদূরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ী
সত্তর দশকের সেই সকালেজিজ্ঞাসা চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে রইলেন উত্তমকুমারতার প্রাতঃভ্রমণের ছন্দ কেটে যাচ্ছিলো ক্রমশ
ব্রাহ্মমুহূর্তে ব্রাহ্মণের কৌলীন্যগায়ত্রীমন্ত্রের চিরকালীন লাবণ্য, পরম অমরতাসব – সব ছন্দহীন মনে হচ্ছিলো এইভয়ংকর হত্যার কাছে
তিনজন মানুষ অর্থাৎ তিনটি সংখ্যাএগিয়ে এলো মহানায়কের চোখের সামনেএনটারটিকা থেকে যেন ভেসে এল কণ্ঠস্বর :আপনি, দাদা, কিছুই কিন্তু দেখেননি
মহানায়কের ভুবনজয়ী হাসিতে এল নিকেল – মূঢ়তা- না কিছুই দেখিনি ...তারপর কেটে গেছে দীর্ঘদিনবহতা গঙ্গার মতই চলে গেছে সেই সকালনির্বাচনের উৎসবে উল্লাসে ভেসেছে সাম্পানউত্তমকুমারের মতই আমরাও কোনদিনকিছু দেখিনি, আমরা কিছুই দেখতে চাইনি কখনো।
কবিতাটি সে সময় বেশ সাড়া ফেলেছিল। তারপর যা হয়। নিরবধি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এই ভয়ঙ্কর গুপ্তহত্যার খতিয়ান। তার পাশে ছিন্নমস্তা সময়ের একটি হাইপোথিটিকাল দলিল হয়ে থেকে গেছে বিমল দেবের এই কবিতা। উত্তমকুমার সেখানে সত্যিই ছিলেন কিনা সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। তবে আমরা যে কোনওদিনই কিছু দেখিনা বা দেখতে চাইনা, কবির এই মন্তব্যে দ্বিমত হবার কারণ নেই বোধহয়। আজও।
[ ফিচারহেড : অর্পণ দাস ]
#ফিচার