ফিচার

সরোজ দত্তের এনকাউন্টার, উত্তমকুমার এবং একটি ভুলে যাওয়া কবিতা

টিম সিলি পয়েন্ট July 11, 2020 at 11:28 am ফিচার

১৯৭১ সাল। পশ্চিমবাংলায় ঘোরতর নকশাল আমল। বাতাসে বারুদের গন্ধ।

দিনটি ছিল ৫ অগাস্ট। উত্তমকুমার প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ময়দানে মর্নিং ওয়াকে যেতেন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাস্তায়। মহানায়ক কয়েকটা চক্কর দিতেন, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন, তারপর ফিরতেন। ৫ অগাস্ট তাঁর চোখের সামনে পুলিশ একটা এনকাউন্টার করল। যাকে মারা হল, তিনি নকশাল নেতা সরোজ দত্ত। কাগজে- কলমে তিনি আজও নিখোঁজ, বলাই বাহুল্য।

রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও সরোজ দত্ত ছিলেন একজন কবি, লেখক, অনুবাদক ও পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক। সব মিলিয়ে সেকালের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনের একেবারে শুরুতে তিনি অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে সেখান থেকে বরখাস্ত হন। প্রথমবার গ্রেপ্তার হন ১৯৬২ সালে, খুব অল্প সময়ের জন্য। ১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম)- এ যোগ দেন। পার্টির অন্যতম মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’র সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সুশীতল রায়চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির ঘটনার প্রতিবাদে যে আন্দোলন জন্ম নেয়, তাকে তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন। দু’ বছর পর পুরনো দল ভেঙে চারু মজুমদারের সঙ্গে তৈরি করেন সিপিআই(এম-এল)। খুব কম সময়েই নকশাল আন্দোলন আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং চারু মজুমদার, সরোজ দত্তরা পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ঢুকে যান। এরপর বেশ কিছুদিন তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ বা ৫ অগাস্ট দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। কাজ শেষ করে ভোরের ময়দানে। আর মজার কথা, অত ভোরেও এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনিও আবার যে সে নন, বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ম্যাটিনি আইডল।

উত্তমকুমারের চোখের সামনে যে এরকম একটা এনকাউন্টার হয়েছিল এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় তাঁর নানা ঘনিষ্ঠ মানুষের বয়ান থেকে। সেদিন বাড়ি ফিরে তিনি নাকি অসুস্থ বোধ করছিলেন। তিনদিন শুটিং করতে পারেননি। তবে যে ব্যক্তিকে খুন করা হয়েছিল তিনিই নকশালকুলচূড়ামণি সরোজ দত্ত কিনা সেই নিয়ে অবশ্য বিতর্কের অবকাশ রয়েছে আজও। সে বিতর্ক থেকেই যাবে। শোনা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা তাঁকে মিষ্টি কথায় সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন – “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” অন্য কেউ হলে হয়তো তাঁকে সরিয়েই দেওয়া হত। সকলেই জানেন এসব কাজের সাক্ষী রাখতে নেই। কিন্তু তিনি যে উত্তমকুমার।

সত্যি হোক বা গুজব, আর পাঁচটা মুখরোচক খবরের মতো বাঙালি এই ঘটনাটিকে মোটামুটি মান্যতা দিয়ে দিয়েছে। র‍্যাডিকাল বুদ্ধিজীবী মহল তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। উপস্থিতি প্রমাণিত না হলেও, মহানায়ককেও কম ব্যঙ্গবাণ সহ্য করতে হয়নি। সে সময় বাম মনোভাবাপন্ন কবি বিমল দেব এই নিয়ে একটি জ্বালাময় কবিতাও লিখেছিলেন। কবিতার নাম ‘উত্তমকুমারের মর্নিং ওয়াক’। পাঠকদের জন্য সেই কবিতাটি (বানান অপরিবর্তিত রেখে) আমরা উদ্ধার করছি –

কলকাতায় তখন ব্রাহ্মমুহূর্ত
পরাবাস্তব আলোয় জেগে উঠেছিলো
রূপকথার পৃথিবী
সবুজ ঘাসে মন্দাক্রান্তা ছন্দে
হেঁটে যাচ্ছিলেন বাঙালীর মহানায়ক
তার পা ফেলার ছন্দে হেসে উঠছিলো
ময়দানের ব্যাকুল হাওয়া
লঞ্চের সিটি গঙ্গার ওপারে হাওড়া ব্রীজের বিভ্রম
ধীরে উদাসীন হয়ে যাচ্ছিলেন
শহরের ম্যাটিনি আইডল
হঠাৎ দেখলেন, তিনটি মানুষ
একজন কবিকে হত্যা করলো, শব্দ নেই
এক অদ্ভুত তাৎপর্যময় নীরবতা চূড়ান্ত খুন
অদূরে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ী

সত্তর দশকের সেই সকালে
জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে রইলেন উত্তমকুমার
তার প্রাতঃভ্রমণের ছন্দ কেটে যাচ্ছিলো ক্রমশ

ব্রাহ্মমুহূর্তে ব্রাহ্মণের কৌলীন্য
গায়ত্রীমন্ত্রের চিরকালীন লাবণ্য, পরম অমরতা
সব – সব ছন্দহীন মনে হচ্ছিলো এই
ভয়ংকর হত্যার কাছে

তিনজন মানুষ অর্থাৎ তিনটি সংখ্যা
এগিয়ে এলো মহানায়কের চোখের সামনে
এনটারটিকা থেকে যেন ভেসে এল কণ্ঠস্বর :
আপনি, দাদা, কিছুই কিন্তু দেখেননি

মহানায়কের ভুবনজয়ী হাসিতে এল নিকেল – মূঢ়তা
- না কিছুই দেখিনি ...
তারপর কেটে গেছে দীর্ঘদিন
বহতা গঙ্গার মতই চলে গেছে সেই সকাল
নির্বাচনের উৎসবে উল্লাসে ভেসেছে সাম্পান
উত্তমকুমারের মতই আমরাও কোনদিন
কিছু দেখিনি, আমরা কিছুই দেখতে চাইনি কখনো।

কবিতাটি সে সময় বেশ সাড়া ফেলেছিল। তারপর যা হয়। নিরবধি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এই ভয়ঙ্কর গুপ্তহত্যার খতিয়ান। তার পাশে ছিন্নমস্তা সময়ের একটি হাইপোথিটিকাল দলিল হয়ে থেকে গেছে বিমল দেবের এই কবিতা। উত্তমকুমার সেখানে সত্যিই ছিলেন কিনা সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। তবে আমরা যে কোনওদিনই কিছু দেখিনা বা দেখতে চাইনা, কবির এই মন্তব্যে দ্বিমত হবার কারণ নেই বোধহয়। আজও।


[ ফিচারহেড : অর্পণ দাস ]

#ফিচার

  • পথিক
    July 29, 2022 at 11:54 am

    লেখাটা দারুন। কবিতা টা দুর্লভ

  • Deep Chatterjee
    July 12, 2020 at 8:00 am

    বিদ্যাসাগর-রামমোহনের মূর্তিভাঙ্গা লাইনের প্রবর্তক আর খোলাখুলি সমর্থক সরোজ দত্তকে নিয়ে রোম্যান্টিক নক্সালজিক না হয়ে বোধহয় আধুনিক যুগে প্রগতিশীল ওয়েবজিন চালানো যায় না। ভালই! একদিকে বিদ্যাসাগর পুজো। বা তাঁকে কমরেড বিদ্যাসাগর বানানো। আরেকদিকে বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙ্গা সমাজবিরোধীকে বিরাট বিপ্লবী বানিয়ে তাঁর জন্য সফ্ট কর্ণারকে হাইলাইট করা। একই সাথে এই দুটো স্ট্যান্ড। এই না হলে আধুনিক বাংলার সাহিত্যচিন্তা! শুরুতেই এই নমুনা। খুব ভাল।

  • সরোজ
    July 11, 2020 at 4:31 pm

    বিমল দেবে-র এই কবিতা উজ্জ্বল উদ্ধার, ধন্য়বাদ টিমকে।

  • অপূর্ব
    July 11, 2020 at 4:23 pm

    দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় না, সরোজ দত্ত ছিলেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ‌্যায়ের বাড়িতে, লেকের কাছে রাজা বসন্ত রায় রোডে, তবে ইনি 'লোকায়ত' দেবীপ্রসাদ নন।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

83

Unique Visitors

226327