সারকারিনা: সন্ধ্যারাতের বেতাজ বাদশা
অর্পণ দাস
Aug 23, 2020 at 10:50 am
ফিচার
সত্তরের কলকাতা তখন মাঝবয়সি। বিপ্লব-রাঙা স্লোগানের কল্লোল তখন ক্রমশ দূরবর্তী। এমারজেন্সির আলো নেভা সন্ধ্যায় সাবধানী পায়ে ফুটপাথ পেরোচ্ছে মানুষ। ‘সর্বহারার’ লাল-নিশানের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে উঠতে তখনও সামান্য দেরি। সেই কলকাতার পেটের মধ্যে বসে আছে আরেকটা কলকাতা। গণনাট্য-নবনাট্য-গ্রুপ থিয়েটারের প্রগতিশীল নাট্য-আন্দোলনের শহরের রাতকে শাসন করে উত্তর কলকাতার বিভিন্ন পেশাদার থিয়েটার হলগুলি। স্টার, রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, কাশী-বিশ্বনাথ মঞ্চের নাটকের অভিনয়ে-নাচে-গানে-লাস্যে গ্রাম-শহর-মফসসলের জনতা বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিত রাত। ক্রমশ এদের সরিয়ে এই রাতের শহরের বেতাজ বাদশা হয়ে উঠল ‘সারকারিনা’।
১৯৭৬ সালে অমর ঘোষের একার দক্ষতায় আর অর্থব্যয়ে সেজে উঠল সারকারিনা। অমর ঘোষ নিজে ছিলেন ফিজিক্সের শিক্ষক, পরে রবীন্দ্রভারতীর নাট্য বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৫২ সাল থেকে তাঁর নাট্যদল ‘উদয়াচল’-কে নিয়ে যে যাত্রার শুরু, তা ষাটের দশকের শেষে এসে প্রথমবার আশার আলো দেখল। কিন্তু ‘নৃত্য-নাটক-সংগীত আকাদেমি’-র আপত্তিতে ও পরে সরকারি পালাবদলে দুবারই তিনি ব্যর্থ হলেন। তার সঙ্গে হারিয়ে গেল ৮ ফুট-৪ ফুটের বিরাট নকশাটির নকল। অবশেষে উত্তর কলকাতার রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের (বর্তমানে বিডন স্ট্রিটের পাশে) একটি খাটাল কিনে শুরু হলো পথ চলা। গোটা কলকাতা জানল একটা অদ্ভুত মঞ্চের থিয়েটার, আরও অদ্ভুত এক নাম নিয়ে শহরে উপস্থিত। প্রথম প্রযোজিত হল অমর ঘোষেরই রচিত-নির্দেশিত-অভিনীত নাটক ‘তুষার যুগ আসছে’। উদ্বোধনের দুদিন আগেই শো হাউস-ফুল। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। ফাইনাল রিহার্সালের দিন যন্ত্রব্যবস্থার ত্রুটিতে (নাকি ষড়যন্ত্র?) ১৬ ফুট টাওয়ারের উপর থেকে পড়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে যান অমর ঘোষ। কিন্তু ‘শো মাস্ট গো অন’। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই অভিনয় করে চললেন তিনি।
সারকারিনার সাফল্য ছুটল বিদ্যুতের বেগে। ‘অগ্নিবন্যা’-র (১৯৭৭) পরের নাটক ‘সম্রাট ও সুন্দরী (১৯৭৮) অভিনীত হল সহস্র রজনী। অমর ঘোষ প্রযোজনা করলেন ছায়ানট, হ্যামলেটের মতো নাটক। আর স্টারকাস্ট? হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, শমিতা বিশ্বাস, সবিতাব্রত দত্ত, দিলীপ রায়, সুলতা চৌধুরী, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, নন্দিনী মালিয়া, কে নেই সেই তালিকায়। অন্য প্রযোজনা দলও রঙ্গিনী, তুঙ্গে বৃহস্পতি, সুখী গৃহকোণ, পান্না হীরে চুনি, রক্তাক্ত আদালত, সাহেবের মতো নাটক সাফল্যের সঙ্গে এখানে অভিনয় করেছে। রবি ঘোষ, সমর মুখোপাধ্যায়, পার্থপ্রতীম চৌধুরী, জ্ঞানেশ মুখার্জিদের অভিনয়ে-নির্দেশনায় ‘সারকারিনা’ আশি-নব্বইয়ের কলকাতার সন্ধ্যা-রাতের অধীশ্বর। চোখ ঝলসে যায় তার জৌলুসে, তার শো-ম্যানশিপে। ১৯৯৫-এর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য করিতকর্মা, মমি, হ্যালো চুমকি, উল্কা, গুলবাজ, হীরাপান্না-র মতো হালকা নাটকও এখানে সপ্তাহে তিনদিন অভিনীত হয়েছে।
আসলে নাটক বা অভিনয় বা নির্দেশনা নয়, সারকারিনার আসল জাদু ছিল তার মঞ্চব্যবস্থায়। যেটা শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষ নয়, গোটা এশিয়াতেও ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম। সারকুলার আর এরিনা-র প্রযুক্তিগত মিশ্রণে তৈরি মঞ্চ তৈরি করেন অমরবাবু। সার্কাসের রিং আর বিড়লা তারামণ্ডলের পরিবেশনায় প্রভাবিত হয়েই তিনি এইরকম পরিকল্পনা করেন। এ মঞ্চ প্রথাগত তিনদিক ঘেরা নয়, প্রেক্ষাগৃহের মাঝখানে গোলাকৃতি মঞ্চ। মঞ্চের পাটাতনটি বসানো থাকত একটা শক্তিশালী হাইড্রোলিক জ্যাকের উপর। দৃশ্য বদলের সময় সেই মঞ্চ ঝুপ করে মাটির তলায় দশ ফুট গভীরে তলিয়ে যেত। সেখানেই আছে গ্রিনরুম। নতুন সিন, নতুন সেট, নতুন অভিনেতাদের নিয়ে মাটির তলা থেকে উঠে আসত নতুন মঞ্চ। অনেক সময় অভিনয় চলাকালীনই মঞ্চ নিচে চলে যেত। তখন মঞ্চের চারদিকে করা সিমেন্টের বেসমেন্টে অভিনয় চলত। এই ম্যাজিক দেখার জন্যই হাজারো-হাজারো মানুষ জড়ো হতেন সারকারিনার টিকিট-কাউন্টারে। যারা দেখেছেন সেই দৃশ্য, তাঁদের স্মৃতি যেন আজও একই রকম রোমহর্ষণ জাগায়। এর চারদিকে ঘিরে ছিল দর্শকাসন। পূর্বে-পশ্চিমে আটটি, উত্তরে এগারোটি ও দক্ষিণে বারোটি সারিতে ধাপে ধাপে উঠে যেত দর্শকাসন। মোট আসন সংখ্যা? ১০০০!
আর? আর ছিল ক্যাবারে। বেতাজ বাদশার রাজসভায় স্বল্পবসনা সুন্দরীর লাস্যময় নৃত্যের আসর। রগরগে, সস্তা উন্মাদনার এই প্রতিযোগিতাতেও বাকিদের হারিয়ে দিল সারকারিনা। ১৯৭৭-এই তার শুরু। একটা তিন ঘণ্টার নাটকে পঁচিশটি পর্যন্ত নাচ থাকত। প্রগতিশীল আর বুদ্ধিজীবী থিয়েটার মহলের আপত্তি আর ভ্রূ কোঁচকানোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাতের পর রাত মদিরতার পেয়ালায় তুফান তুলল সারকারিনা। থিয়েটার নয়, সারকারিনা মানে তখন শুধুই এন্টারটেইমেন্ট, এন্টারটেইমেন্ট আর এন্টারটেইমেন্ট। গোধূলির আলো মাখা ক্লান্তিকে সঙ্গী করে রাতের আঁধারে ঢলে পড়া শহরটার এক প্রান্তের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত সারকারিনা।
নজরে থাকুক
এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ লগ্ন। লাল নিশানের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে তখন সদ্য ধাক্কা লেগেছে। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, হাইরাইজ আর উড়ালপুলের কলকাতার চোখের তলায় অস্পষ্ট কালি। গণনাট্য-নবনাট্যের কলকাতার থিয়েটার মহলে শুরু হয়েছে আমরা-ওরার কোন্দল। সেই কলকাতার পেটের মধ্যে বসে আছে আরেকটা কলকাতা। যেখানে একসময়ের রঙিন পেশাদার থিয়েটারগুলি আজ সেপিয়া টোনের জীর্ণতা থেকে ক্রমশ ধ্বংসের সাদা-কালো হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শনের দাপট, নিজেদের রুচিহীনতাসহ আরও অসংখ্য কারণ দায়ী তার জন্য। স্টার থিয়েটারে শুরু হয়েছে সিনেমা প্রদর্শন, মিনার্ভা নিয়ে দোলাচল চলছে। রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, রঙমহল, কাশী-বিশ্বনাথের কোনোটি পড়ে গেছে পৌরসভার সীমানার মাঝখানে, কোনোটিকে গ্রাস করেছে প্রোমোটারের দল। তারই মধ্যে বিডন স্ট্রিটের ধারে পেশাদার থিয়েটারের শেষ সন্তান সারকারিনা কোনোরকমে টিকে ছিল। বলা ভালো প্রোমোটারের লোভ আর গুন্ডাদের হুমকির মধ্যেও অমর ঘোষ তাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। ২০০৮ সালে ‘গুলবাগ’ প্রযোজনার পর অমর ঘোষের গুলবাগেও ফুল শুকিয়ে যায়। ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের আন্তরিকতাই এখন সারকারিনার একমাত্র সম্বল। ঝুল পড়া অন্ধকার ঘর, মরচে ধরা সিঁড়ি, ভাঙা-চোরা সেট, একজায়গায় ডাঁই করে রাখা চেয়ার, এই তো অবস্থা তার। ‘দেহ পট সনে’ সকলই হারিয়েছে তার। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় যখন ‘থিয়েটার ইন রাউন্ড’ যখন আবার জনপ্রিয়তা লাভ করছে, তখন এই পোড়া কলকাতায় বসে আমরা আরেকটা ইতিহাসের মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় দেখছি। যেখানে নাটকের রাজা মৃত, আর ধূলায় পড়ে আছে তাঁর সাধের পেয়ালা, তাঁর মুকুট।
[পোস্টার - অর্পণ দাস।]
#কলকাতা #সারকারিনা #নিবন্ধ #অর্পণ দাস