অগ্নিদগ্ধ অভিনেত্রী থেকে সাহেবি থিয়েটারের প্রথম বাঙালি ‘হিরো’ : সাক্ষী সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মাটি
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। ঠিকানা- ৩০, পার্ক স্ট্রিট, কলকাতা-১৬। শুধু প্রতিষ্ঠানের নামটা লিখলেই তো হত, আবার ঠিকানা লেখার কী দরকার ছিল? বিশেষ করে আজকের দিনে যখন কলেজটির নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। শিক্ষা, গুণমান, ঐতিহ্য ইত্যাদি কারণে নয়। ঘুরছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে। আমরা সেই বিতর্কে যাব না। বরং আমরা পিছিয়ে যাব প্রায় একশ পঁচাত্তর বছর। তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ছিল না, কলকাতা-১৬-ও ছিল না। কিন্তু ঠিকানাটা ছিল। তখন সেখানে ছিল সাঁ সুসি থিয়েটার। সম্ভবত বাংলায় ইংরেজদের তৈরি করা শেষ স্থায়ী থিয়েটার। যেখানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন সেই সময়কার বিখ্যাত ইংরেজ অভিনেত্রী। আবার সেই থিয়েটারেই সাদা চামড়ার বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন এক বাঙালি যুবক। যে সে চরিত্রে নয়, একেবারে শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকের মূল চরিত্রে।
সময়টা ১৮৩৯ সাল। কলকাতায় তখন ইংরেজরা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। খেলাধুলো, গান-বাজনা আর মদ—কলকাতাকে লন্ডন শহরের মতো ‘বসবাসযোগ্য’ বানানোর পরিকল্পনা ঠিকভাবেই এগিয়েছে। কিন্তু একটা খামতি থেকেই যাচ্ছে। অভিজাত ইংরেজদের নিজের হাতে গড়া ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ কিছুদিন আগেই আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। একটা নিজস্ব থিয়েটার ছাড়া শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্য সম্পূর্ণ হয় না। এদিকে ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ পুড়ে যাওয়ার পর কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা বড়ো অংশ ইংল্যান্ডে চলে গেছিলেন। ফলে নানারকম পরিকল্পনা চললেও কলকাতায় তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আকাল। বাংলায় তখনও বাঙালিদের দ্বারা থিয়েটার অভিনয় চালু হয়নি। অবশ্য যাত্রা বা অন্যান্য লোকনাট্যের জনপ্রিয়তা কম ছিল না। কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি যুবকেরও অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা তো আর ইংরেজদের থিয়েটারে ঢুকতে পারবেন না। এমনকি অভিজাত ও অর্থবান বাঙালি ছাড়া ইংরেজদের অভিনয় দেখার সৌভাগ্যও সবার ছিল না। এই পরিস্থিতিতে কলকাতায় ইংরেজদের থিয়েটারি আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য এগিয়ে এলেন ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও অভিনেতা মিঃ স্টোকলার। তড়িঘড়ি তিনি লন্ডন থেকে নিয়ে এলেন মিসেস লিচ-কে। যিনি ছিলেন চৌরঙ্গী থিয়েটারের প্রাণভোমরা। তিন মাসের মধ্যে গড়ে উঠল ইংরেজদের নিজস্ব ‘সাঁ সুসি থিয়েটার’। প্রথমে অস্থায়ী মঞ্চে অভিনীত হল ‘ইউ ক্যান্ট ম্যারি ইওর গ্রান্ডমাদার’ নামের একটি নাটক এবং দুটি প্রহসন। টিকিটের দাম ছিল ওই সময়ে ছয় টাকা, পাঁচ টাকা ও চার টাকা। পুরো হলটি ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। চারশো সিটের থিয়েটার হল প্রথম রাতেই হাউসফুল।
শুধু মিসেস লিচ বা স্টোকলার নন, মিসেস ব্ল্যাক, মিসেস ফ্রান্সিস, মিঃ বলিনের অভিনয়ে-নাচে-গানে কলকাতায় ইংরেজ থিয়েটারের সুসময় ফিরে এল। লন্ডন থেকে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এসে যোগ দিলেন। ফলে প্রয়োজন পড়ল আরও বড়ো, আরও সুসজ্জিত থিয়েটার হলের। অর্থসাহায্য করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং বড়লাট অকল্যান্ড এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর। মিসেস লিচ নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করলেন নতুন থিয়েটার বাড়িটির জন্য। অবশেষে ১৮৪১ সালের মার্চ মাসে স্থায়ী ‘সাঁ সুসি থিয়েটার’-এর উদ্বোধন হল। ঠিকানা- আজ যেখানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।
কিন্তু সুখের সময় বেশিদিন থাকে না। ১৮৪১ সালের নভেম্বর মাসে ‘হ্যান্ডসাম হাজব্যান্ড’ নাটকের অভিনয় চলাকালীন পোশাকে আগুন লেগে মিসেস লিচের মৃত্য হয়। চৌরঙ্গী থিয়েটার পুড়ে যাওয়ার পর তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গেছিলেন। নতুন উন্মাদনায় ফিরে এসে যে থিয়েটারের জন্য নিজের সর্বস্ব দান করেছিলেন, সেই থিয়েটার মঞ্চে আগুনে পুড়েই তাঁর মৃত্যু ঘটল। নিয়তি আর কাকে বলে!
লিচের মৃত্যুর পর কখনও মাদাম ব্যাক্সটার, কখনও জেমস ব্যারী সাঁ সুসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু লিচের অভাব পূর্ণ হয়নি। নিত্যনতুন নাটক অভিনয়ে করে বা টিকিটের দাম কমিয়েও দর্শকের মনোরঞ্জন করা যাচ্ছিল না। এমনকি মঞ্চে ঘোড়ার খেলা দেখানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর সত্যিকারেই নাটকের মাঝে দড়ির উপর নাচের সার্কাস দেখানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অবস্থার বদল হয়নি।
সেই সময়েই সাঁ সুসি-তে আবির্ভাব ঘটল ‘দ্য হিন্দু ওথেলো’র। তাঁর নাম বৈষ্ণবচরণ আঢ্য। ১৮৪৮ সালের ১৬ আগস্ট শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করলেন তিনি। ডেসডিমোনার চরিত্রে ছিলেন মিসেস লিচের মেয়ে মিসেস অ্যান্ডারসন। এই চরিত্রটার জন্যই তাঁকে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা হয়ে হয়েছিল। ১২ সেপ্টেম্বর আবার ‘ওথেলো’-র অভিনয় হলো।
মিসেস অ্যান্ডারসনের অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও মোকাম কলিকাতায় তখন শুধুই বৈষ্ণবচরণের নাম। সাহেবি থিয়েটারের প্রথম বাঙালি ‘হিরো’ তিনি। তাঁর উচ্চাঙ্গ অভিনয়, ইংরেজি বলার কায়দা, ব্যক্তিত্বপূর্ণ উপস্থিতি, জড়তাহীন অঙ্গভঙ্গি নিয়ে তিনি প্রথম অভিনয়েই দর্শকের মন জয় করে ফেললেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর পাতায় তাঁর প্রভূত প্রশংসা করা হল। অবশ্য বাধা যে আসেনি তা নয়। তাঁর অভিনয় আটকানোর জন্য সাহেবরা নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ সাঁ সুসি তখন ধনী বাঙালিদের অর্থসাহায্যেই চলছিল। রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা বৈদ্যনাথ রায়, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহরা ছিলেন ‘ওথেলো’-র সবথেকে বড়ো পৃষ্ঠপোষক। ততদিনে উচ্চশিক্ষিত ও ধনী বাঙালিরা ইংরেজ থিয়েটারের গ্ল্যামারে মুগ্ধ হতে শুরু করেছেন। তাঁরা বুঝে গেছিলেন থিয়েটার করলে যেমন ইংরেজসুলভ কৌলীন্য পাওয়া সম্ভব, তেমনই নিজস্ব আভিজাত্য দেখানোও সহজ হবে। অবশ্য তখনও বিদেশি অনুকরণে বাঙালি থিয়েটার চালু হয়নি। কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় বাঙালির মুদ্রার ওজন ভারি হয়ে উঠছিল। কিছুদিনের মধ্যে ‘সাঁ সুসি’সহ কলকাতার প্রায় সবকটা সাহেবি থিয়েটার উঠে যাওয়া তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে।
বৈষ্ণবচরণকে নিয়ে বাঙালির মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল এটাই ছিল তার মূল কারণ। যদিও এই দুটি অভিনয়ের পর বৈষ্ণবচরণকে আর মঞ্চের আলোয় দেখা যায়নি। এরপর বাবুদের বাড়ির থিয়েটার বা পেশাদার থিয়েটার চালু হলেও তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাত্র দুদিনের জন্য অভিনয় করে বৈষ্ণবচরণ ইতিহাস হয়ে গেলেন।
সেই ইতিহাসের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। যেখানে ছিল কলকাতার শেষ সফল সাহেবি থিয়েটার। সেই থিয়েটার উঠে গেছে, ইংরেজরাও চলে গেছে পঁচাত্তর বছর হলো। ‘ওথেলো’-র সময়কাল এখন আর নেই। কিন্তু মধ্যযুগীয় মানসিকতার কিছু মানুষ আজও রয়ে গেছে। যাওয়ার সময় ইংরেজরা এদের সঙ্গে নিয়ে গেলেই পারত।
#সিলি পয়েন্ট # সেন্ট জেভিয়ার্স # অর্পণ দাস # থিয়েটার #ফিচার #St. Xaviers # Arpan Das # stage theatre # silly point