রবার্ট ব্রাউনিং: মনের গভীর অতল খুঁড়ে
সময়টা ভিক্টোরিয় যুগ। ইংরেজি কাব্য তখনও আচ্ছন্ন রোমান্টিক ধারার প্রভাবে। প্রকৃতির প্রাধান্য, দার্শনিক চিন্তামগ্নতা, মধ্যযুগীয় নস্টালজিয়া প্রভৃতি যে অভিনব বৈশিষ্ট্যগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ইংরেজি কাব্যধারায় বিপ্লব নিয়ে এসেছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম লগ্নে তা পূর্ণতা লাভ করে রোমান্টিক আন্দোলন রূপে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, শেলি, কীটস প্রভৃতির কবিতাগুলি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায়। ভিক্টোরিয় যুগের প্রথম দিকে এই রোমান্টিক ধারার চেনা ছকেই চলছিল কাব্যরচনা, পোয়েট লরিয়েট লর্ড টেনিসনের কাজেও পাওয়া যায় তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ‘দ্য লোটাস ইটার্স’, ‘টিথোনাস’ প্রভৃতি কবিতায় যেখানে এসেছে প্রাকৃতিক নিসর্গের বর্ণনা ও জীবনের তাৎপর্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান, অন্যদিকে ‘আইডিলস অফ দ্য কিং’ কাব্যে পাই রাজা আর্থার সম্পর্কিত মধ্যযুগীয় রোমান্সের উপস্থিতি।
রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা এই পরিস্থিতিতে ভিক্টোরিয় ইংরেজি কাব্যে যথার্থ অর্থেই সূচনা করে এক দিকবদলের। ব্রাউনিং তাঁর কবিতায় মানবজীবনের কোনো চিরন্তন দার্শনিক সত্য উদ্ঘাটনে আগ্রহী নন, প্রাকৃতিক দৃশ্যও তাঁর কবিতায় আসে পরিস্থিতির প্রয়োজন বিশেষে। তিনি বরং চেষ্টা করেন মানুষের মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতিকে তাদের জবানবন্দির মারফত ফুটিয়ে তোলার। চার্চের কনফেশন বক্সে বসে মানুষ যেমন তার মনের অন্ধকারতম প্রবৃত্তিগুলো বেআব্রু করে মেলে ধরে ফাদারের সামনে, অনেকটা সেভাবেই ব্রাউনিংয়ের কবিতার কুশীলবরা পাঠকের সামনে দীর্ঘ জবানি বা ‘ড্রামাটিক মনোলগ’-এর মাধ্যমে তুলে ধরে তাদের মনের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন গোপন কথা, ভাবনা, ইচ্ছে। মাঝেমধ্যেই পরিচয় পাওয়া যায় রীতিমতো বিকৃত মানসিকতার, আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ও নিরীহ কথনের মাঝেই হঠাৎ উন্মোচিত হয় বক্তার কদর্যতা। এক ধরনের বিকৃত পৌরুষ হামেশাই দেখা যায় ব্রাউনিংয়ের চরিত্রদের মধ্যে, স্ত্রী বা প্রেমিকাকে না পেয়ে প্রবল যৌন ঈর্ষার ফলে তাকে ধ্বংস করে দেবার নমুনা রয়েছে একাধিক বিখ্যাত কবিতায়। ‘মাই লাস্ট ডাচেস’ কবিতায় ডিউক ফেরেরা অন্য পুরুষের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলার ‘অপরাধে’ মেরে ফেলে তার স্ত্রীকে, ‘দ্য ল্যাবরেটরি’ কবিতায় প্রিয়তমাকে না পেয়ে তাকে প্রেমিকসহ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবার ফন্দি আঁটে এক বৈজ্ঞানিক, ‘পরফিরিয়া’স লাভার’ কবিতায় ধনী পরিবারের মেয়ে পরফিরিয়াকে না পেয়ে তাকে অন্য কারোর হতে না দেবার চেষ্টায় চুলের ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে বিকৃতমস্তিষ্ক প্রেমিক। ভিক্টোরিয় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেই যেন এই কবিতাগুলোর মাধ্যমে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ব্রাউনিং। ধর্মের ভণ্ডামিকেও বেআব্রু করতে ছাড়েননি ব্রাউনিং। জীবনের বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছেন ইতালিতে, প্রত্যক্ষ করেছেন ক্যাথলিক ধর্মের অনাচার। ‘ফ্রা লিপ্পো লিপ্পি’ কবিতায় আমরা পাই বেশ্যাপাড়ার নিয়মিত খদ্দের এক কামুক তরুণ সন্ন্যাসীকে, আবার ‘দ্য বিশপ অর্ডার্স হিজ টুম্ব অ্যাট সেন্ট প্র্যাক্সড চার্চ’ কবিতার তথাকথিত সম্মানীয় পাদ্রী মৃত্যুশয্যায় তুলে ধরে তার কুকীর্তির দীর্ঘ তালিকা। ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’ কবিতায় প্রেমে প্রত্যাখ্যাত যুবকের আপাত দার্শনিক শান্ত স্বীকারোক্তি ঠেলে বেরিয়ে আসে চরম হতাশা। ‘পাওলাইন’, ‘মেন অ্যান্ড উইমেন’, ‘দ্য রিং অ্যান্ড দ্য বুক’ – ব্রাউনিংয়ের বিভিন্ন কবিতার বইয়ে উদ্ঘাটিত হয়েছে মানুষের মনের নানা চমকে দেওয়া প্রবৃত্তি। পূর্ণাঙ্গ নাটক না লিখলেও ব্রাউনিংয়ের চরিত্রদের জবানবন্দিগুলোয় নাটকীয়তার কোনো অভাব নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মানবমনের গোপন সত্যগুলো উন্মোচিত করবার জন্য মনোবিকলন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, তাঁর প্রভাবে বিরাট বদল আসবে ইউরোপীয় সাহিত্যে, চিন্তার মুক্ত স্রোত তুলে ধরবার জন্য ‘স্ট্রিম অফ কনশাসনেস’ ধারার উপন্যাস লিখবেন ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস, ডরোথি রিচার্ডসনেরা। ব্রাউনিংয়ের কবিতা প্রমাণ করে, ফ্রয়েডের আবির্ভাবের আগেই ইউরোপীয় সাহিত্যে ক্রমশ আগ্রহ বাড়ছিল মানুষের মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে। বারবার পড়েও তাই পুরনো হয় না তাঁর কবিতাগুলো, মনের চোরাগলিতে তাঁর হরেক রকম সুলুকসন্ধান।
আরও পড়ুন: নগরায়ণ, গোয়েন্দাকাহিনি ও পো-র দ্যুপঁ / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য