নগরায়ণ, গোয়েন্দাকাহিনি ও পো-র দ্যুপঁ
রেমন্ড উইলিয়ামস প্রভৃতি তাত্ত্বিকের আলোচনা থেকে বলা যায়, গোয়েন্দাকাহিনির উদ্ভব হল নগরায়ণের অনিবার্য ফলশ্রুতি। শহুরে জীবনের রীতিনীতি জনমানসে জন্ম দেয় এমন এক বিশেষ নিরাপত্তাহীনতার, যার উপশমের জন্য রঙ্গমঞ্চে ঘটে গোয়েন্দার অবতরণ। চার্লস টেলর প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিকের মতে, গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শহুরে জীবনের অন্যতম একটি পার্থক্য হল, শহরে মানুষের প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত এই দুটি বৃত্ত সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে যায়। গ্রামীণ জীবন অনেক বেশি খোলামেলা, এবং বেশিরভাগই সেখানকার আদি বাসিন্দা হওয়াতে সেখানে মানুষ প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে অনেক বেশি মাত্রায় ওয়াকিবহাল। অন্যদিকে শহরে বসবাসকারী জনগণের একটা বড় অংশ আসে জীবিকার দায়ে, শিকড়ের কোনও টান তাদের নেই। শহরের জীবন অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক, নিয়মতান্ত্রিক। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকবার লড়াই করতে করতে সেখানে এসে জড়ো হওয়া বিভিন্ন মানুষ তাই অতি সামান্যই সুযোগ পায় একে অপরকে চিনে ওঠার, বেশিরভাগটাই আবৃত থাকে ব্যক্তিগত তকমার আড়ালে। বস্তুত, এই না চেনা, না জানাই তো জন্ম দেয় শহরকেন্দ্রিক আধুনিক কবিতার ‘মডার্নিস্ট এলিয়েনেশন’-এর, যেখানে বহু লোকের ভিড়েও শহরের মানুষ একা, অজস্র মুখের মাঝে একটিও তার পরিচিত ঠেকে না:The apparition of these faces in the crowd:Petals on a wet, black bough. -Ezra Pound, ‘In a Station of the Metro'অথবা:Shall I say, I have gone at dusk through narrow streetsAnd watched the smoke that rises from the pipesOf lonely men in shirt-sleeves, leaning out of windows? -T.S. Eliot, ‘The Love Song of J. Alfred Prufrock'
তবে শুধুই কাব্যিক বিষণ্ণতা নয়, শহরে এই কাতারে কাতারে অপরিচিত মানুষের ভিড় নাগরিক জীবনে এক নিরাপত্তাহীনতারও জন্ম দেয় বটে। জীবিকার তাগিদে শহরে আসা এই অচেনা লোকগুলোর সকলেই যে সৎভাবে উপার্জন করছে, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? অগণিত এই আপাত সাধারণ মানুষদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর কোনও অপরাধী, জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত প্রতিবেশীদের ঔদাসীন্যের সুযোগ নিয়ে যে হয়তো প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে কোনও ভয়ানক পাপকার্য? বাস্তবিকই শহরে সরাইখানা, মেস, পেয়িং গেস্ট জাতীয় বাসস্থানের ছড়াছড়ি, যেখানে মাসিক ভাড়া ছাড়া বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার বাকি সমস্ত খুঁটিনাটি সম্বন্ধেই গৃহস্বামী ন্যূনতম কৌতূহলও দেখান না। একবার ভাবুন তো, অপরাজিত উপন্যাসে কলকাতার বাসায় থাকাকালীন ছাত্র অপুর পাশের বাড়ির একটি খামখেয়ালি মেয়ের সঙ্গে যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ঘটে, নিশ্চিন্দিপুর হলে এহেন ঘটনা বেশিদিন চাপা থাকত কি? আর প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপীয় শহরগুলিতে অপরাধীর মোটেই অভাব ছিল না, এবং সংবাদপত্র ও সস্তা পত্রিকাগুলির কল্যাণে সেইসব তস্করের কীর্তিকলাপ নিয়মিত পৌঁছে যেত সভ্য সমাজে। লন্ডনের পূর্বদিকে সোহো, হোয়াইটচ্যাপেল প্রভৃতি স্থান রীতিমতো কুখ্যাত হয়ে ওঠে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে। জ্যাক দ্য রিপারের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয় পাঁচজন যৌনকর্মী, পেনি ড্রেডফুলের পাতায় বেরোয় সুইনি টডের প্রকাশ্য দিবালোকে চুল ছাঁটার ভান করে একের পর এক মানুষ খুনের কাহিনি। খোদ চার্লস ডিকেন্সের লেখায় বিল সাইকস, ফ্যাগিন বা এবেল ম্যাগউইচের মতো অপরাধীদের কে ভুলতে পারে? স্বভাবতই ইউরোপীয় নাগরিকদের মনে ক্রমশ চারিয়ে যেতে থাকে ভয়, তাদের পাশের বাড়িতেই কি লুকিয়ে রয়েছে কোনও বীভৎস অপরাধী? আধুনিক শহরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য শীঘ্রই সৃষ্টি হয় শহরভিত্তিক চিরস্থায়ী পুলিশবাহিনী, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিল লন্ডনের জন্য মোতায়েন করেন মেট্রোপলিটন পোলিস ফোর্স, একই রাস্তায় হাঁটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর কলকাতাও। রাত্রের অন্ধকারে অপরাধের মোকাবিলা করবার জন্য সারা লন্ডন মুড়ে ফেলা হয় গ্যাসের বাতিতে। তবে ক্রিমিনালদের শায়েস্তা করবার ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু অনিবার্য অক্ষমতা রয়েছে বটে। প্রথমত, পুলিশ বাঁধা প্রোটোকল অনুযায়ী কাজ করতে অভ্যস্ত, ধৈর্য ধরে চেনা ছকের বাইরে গিয়ে অপরাধী ধরবার ক্ষেত্রে পুলিশ অকৃতকার্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, পুলিশকর্মী তার উর্দি ও অন্যান্য কারণে অনেক সময়েই হয় বহুল পরিচিত, সাধারণের ভিড়ে মিশে থাকা অপরাধী সেক্ষেত্রে অনায়াসেই তার থেকে এক পা এগিয়ে থাকবে। এই সমস্ত কারণেই যেন জনমানসে অপ্রতুল মনে হতে থাকে সরকারি পুলিশি ব্যবস্থা, তাই কল্পনার হাত ধরে সাহিত্য জগতে পদার্পণ করে বেসরকারি গোয়েন্দা। ইংরেজি সাহিত্যে এডগার অ্যালান পো ১৮৪১ সালে জন্ম দেন ‘মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’ নামক প্রথম গোয়েন্দাকাহিনির, গোয়েন্দার ভূমিকায় অগস্তে দ্যুপঁ। প্রশ্ন উঠতে পারে, পো নিজে মার্কিন হয়ে তাঁর গোয়েন্দা গল্পের পটভূমি হিসেবে কোনও মার্কিন শহরকে না বেছে প্যারিসকে নির্বাচন করলেন কেন? এর কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় গোয়েন্দাকাহিনির অনুকূল পটভূমি হয়ে ওঠার মত যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক শহর পাওয়া মুশকিল হত। আমেরিকার প্রথম যথার্থ আধুনিক শহর ওয়াশিংটন ডিসির নির্মাণ শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক বা বোস্টনের মতো বর্তমানের বিলাসবহুল মার্কিন শহরগুলি সেই সময়ে প্রকৃতপক্ষে ছিল বৃহৎ গ্রামের মতো, কাঠের ঘরবাড়িতে ভরা। দ্যুপঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়টিই যেন প্রমাণ করে দেয় যে সে শহরের নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোয় অবস্থিত। সে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের শেষ বংশধর, লিজিয়ঁ দ’অঁর কর্তৃক নাইটহুড প্রাপ্ত, নামের আগে ‘শেভালিয়র’ উপাধি ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমানে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হওয়ায় তাকে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং তীক্ষ্ম বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি গোয়েন্দা হিসেবে অন্নসংস্থান করতে হচ্ছে। দ্যুপঁ এবং তার নামহীন সহকারী যেন আদ্যোপান্ত শহুরে অধিবাসী, তারা সম্পূর্ণ একলা থাকে, পরিবার পরিজন বর্জিত। গ্রামে বা মফসসলে এমন ছিন্নমূল অবস্থান কল্পনা করা যায় কি? ছকের বাইরে গিয়ে ভাবতে পারে বলেই দ্যুপঁ রু মর্গের আসল হত্যাকারী জীবটিকে শনাক্ত করতে পারে, ঠিক লক্ষ করে নাকের সামনে পড়ে থাকা ডাচেসের চিঠিখানা। দ্যুপঁকে নিয়ে ‘দ্য মিস্ট্রি অফ মেরি রজে’ (১৮৪২) ও ‘দ্য পার্লয়েন্ড লেটার’ (১৮৪৪) নামে আরো দুটি গল্প লেখেন পো, এবং ছক তৈরি করে দিয়ে যান পরবর্তী কালজয়ী নানা গোয়েন্দাকাহিনির। দ্যুপঁকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সৃষ্ট আর্থার কোনান ডয়েলের বিপুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা শার্লক হোমসের সঙ্গে দ্যুপঁর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। দ্যুপঁর প্যারিসের মতোই হোমসের প্রধান কর্মক্ষেত্র আরেক আধুনিক ইউরোপীয় শহর লন্ডন। দ্যুপঁ ও তার সহকারীর মতোই হোমস এবং ওয়াটসন ঝাড়া হাত পা হয়ে বাঁচে, যদিও পরবর্তী কালে ওয়াটসন মিস মর্সটানকে বিবাহ করে সংসারী হয়। দ্যুপঁ কবিতা পড়ে, হোমস বাজায় বেহালা। পুলিশের অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্যই যেন দ্যুপঁর গল্পে হাজির পুলিশকর্তা জি-, যেমন হোমসের কাহিনিতে ইন্সপেক্টর লেসট্রেড, বা আমাদের হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত মানিকের গল্পে সুন্দরবাবু। আধুনিক শহরের অজস্র পেয়িং গেস্টের মতোই থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়ে আলাপ হয় হোমস এবং ওয়াটসনের, যেমন অজিতের মেসবাড়িতেই অতুল ছদ্মনামে প্রথম আবির্ভাব শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতা কেন্দ্রিক গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর। এডগার অ্যালান পো-,র দ্যুপঁ তাই গোয়েন্দাসাহিত্যের ক্ষেত্রে সত্যিই এক সফল পথপ্রদর্শক, বা মার্কিন সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে, এক যথার্থ পায়োনিয়ার।