মেনুকার্ডের তত্ত্বতালাশ
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখায় মন এবং জিভ দুয়ের জন্যই রসালো উপাদান মজুত থাকে। তেমনই এক গল্পে ভোজনপ্রিয় লেখক নিমন্ত্রণ পেয়েছেন এক বন্ধুর রেস্তোরাঁর উদ্বোধনে। বসতে না বসতেই বন্ধু হাতে ধরিয়েছে মেনুকার্ড আর গুটিকয়েক চিনেবাদাম। খাবার আসার আগেই মেনুকার্ডে পদের ছড়াছড়ি দেখে লেখকের প্রাণ অস্থির। কিন্তু এক এক করে অর্ডার দেন, আর ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর মেনু হাতে এসে বন্ধু সেই নাম কেটে দেয় মেনুকার্ড থেকে। মেনুকার্ডের কোন খাবার পাওয়া গেছিল শেষমেশ সে কথা উহ্যই থাক, কারণ এ তো গল্প। তবে বাস্তবে খাবারদাবার না পেলে যে কী ঘটতে পারে, সে কথা হাড়ে হাড়ে জানতেন চিন দেশের সরাইখানার মালিকেরা। চিনে তখন সং বংশের শাসন চলছে। বাণিজ্যে তার বোলবোলাও বিশ্ব জুড়ে। ফলে রাজধানী বিয়ানজিং-এ লেগেই থাকে ভিনদেশি বণিকের ভিড়। আর কাজ করলে খিদে তো পাবেই। ফলে ভিড় উপচে পড়ে শহরের রেস্তোরাঁগুলোতেও। নানা দেশের খাবারের বায়না মেটাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত পাচকদের। আর নানা ভাষার সরু-মোটা গলায় যে কী সব খাবারের দাবিদাওয়া করা হয়, তা বুঝতে না পারলে আর-এক ঝঞ্ঝাট! অবশেষে এক বুদ্ধি বের করলেন সরাই মালিকেরা। ততদিনে কাগজ বলে একটা জিনিস এসে পড়েছে তাঁদের দেশে। সেদিন কী কী খাবার পাওয়া যাবে, কাগজে লিখে প্রতিদিন টাঙিয়ে দেওয়া হতে থাকল রেস্তোরাঁর দেওয়ালে। অবশ্য খদ্দেরের মুখ বদলাতে তালিকাও বদলাত প্রায়ই। কিন্তু এই সীমিত খাদ্যতালিকা মালিক আর ক্রেতা উভয় পক্ষেরই বেশ সুবিধে করে দিয়েছিল।
অবশ্য খাদ্যতালিকা ব্যাপারটা যে এরও অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছে, তা জানতে সময় লেগেছিল ১৯২২ সাল পর্যন্ত। সৌজন্যে আর-এক প্রাচীন সভ্যতা, যার উৎপত্তি মিশরে। ১১৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা গিয়েছিলেন তৃতীয় রামেসিস-এর বাবা সেত্নাখত। উইলিয়াম ক্রিস্টাল যখন তাঁর মমি খুঁজে বের করলেন, তার সঙ্গেই বেরিয়ে এল কিছু হায়ারোগ্লিফের টুকরো। যেগুলো খাদ্যতালিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। খাদ্যরসিক ভদ্রলোক জীবদ্দশায় মেনু দেখে খাবারের ফরমাশ দিতেন বলেই না মৃত্যুর পরও মিশরীয়রা তাঁকে মেনুকার্ড দিয়ে দিতে ভোলেনি!
আরও পড়ুন : ম্যাজিকাল মিল / শিলালিপি চক্রবর্তী
মেনুকার্ডের উৎপত্তি মিশর বা চিন যে দেশেই হোক না কেন, ‘মেনু’ নামটার দাবিদার অন্য দেশ। লাতিন ‘মিনুটুস’ শব্দ, অর্থাৎ কোনও কিছুকে ছোটো আকারে দেখা, থেকে ফরাসিরা তৈরি করে নিয়েছে ‘মেনু’ শব্দটা। ফরাসি শিখতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল সে ভাষায় এরকম ছোটোখাটো বানানের শব্দের দেখা বেশি মেলে না। সেইসব বড়সড় নাম আর ফরাসি অ্যাকসেন্টের ছোটো উচ্চারণ বুঝতে গিয়ে সে দেশের রেস্তোরাঁর অ-ফরাসি ভোজনরসিকদের অবস্থা কাহিল। কোন একটা গল্পে ছিল, মেনুকার্ডে ‘লেডিস ফিঙ্গার’-এর সুললিত নামে মুগ্ধ হয়ে একজন সেটাই অর্ডার করে বসেছিল। সেকালে ফরাসি রেস্তোরাঁয় এমন খদ্দেরের দেখা মিলত প্রায়শই। আর পাতে ঢ্যাঁড়শ জুটলে তারা বাক্যসুধা পান করাতেও পিছপা হত না। আর ভাষা সমস্যা যদি নাও হয়, সেক্ষেত্রেও ভোজনবিলাসীদের রকমারি খাবারের বায়নাক্কা আর কাঁহাতক মেটানো যায়! এখানেও সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন সেই রেস্তোরাঁ মালিকেরাই। অপেক্ষাকৃত সুবিধের খাবারগুলোকে রাখলেন এক তালিকায়, তার নাম দেওয়া হল আ-লা-কার্ত (a` la carte; according to the board)। এই খাবারদাবারগুলো কম বিপজ্জনক বলে এখানে ‘মালের দায় কর্তৃপক্ষের নহে’। আর আ-লা-কার্ত-কে মেনুর সম্মানও দেওয়া হত না, যে সম্মান পেত ‘তাবল দ্যোৎ’ (table d’hote), যা বানানো হত যথার্থ খাদ্যরসিকদের জন্য। স্যুপের আগের পদ থেকে ডেসার্টের পরের পদ অবধি সুসজ্জিত এই মেনু বানাতেন স্বয়ং রেস্তোরাঁ মালিক বা শেফ।
বাংলার ভোজসভায় মেনুকার্ডকে হাজির করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। নাম দিয়েছিলেন ‘ক্রমণী’। রন্ধনশিল্পে নৈপুণ্যের পাশাপাশি তাঁর ছিল এক অভিনব পারিপাট্যের বোধ। ফলে খাবারের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যতালিকা কেমন করে সাজালে সুন্দর দেখাবে, তা নিয়েও তিনি ভাবনাচিন্তা করেছেন। তাঁর এক-একটি ক্রমণীর শব্দসজ্জা কবিতার মতো। আর ফরাসি ‘তাবল দ্যোৎ’-এর মতোই সে তালিকায় স্টার্টার থেকে ডেসার্ট কী নেই! কোথাও পাওয়া যাবে খেজুরের পোলাও, লঙ্কা পাতার চড়চড়ি, বিটের হিঙ্গি, কাঁচা তেঁতুলের সরস্বতীঅম্বল, পেঁয়াজের পরমান্ন, করলার দোল্মা আচার, চঁওচঁও; তো কোথাও দেখা যাচ্ছে অলিভ রুটি, এস্পারোগাস স্যাণ্ডুইচ, উফ্স্ আলানিজ, মুলুকতানী সূপ, ধূম পক্ব ইলিশ বা মটনের কলার।
আরও পড়ুন : দাদাদের খাওয়াদাওয়া / রণিতা চট্টোপাধ্যায় ও বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
সেত্নাখত-এর মতো ব্যক্তিগত মেনুকার্ড কিংবা ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুই-এর ‘ইন্টিমেট সাপার’-এর মেনু যে অ-মূল্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু ১৯৭০-৮০ পর্যন্ত রেস্তোরাঁতেও দেখা পাওয়া যেত দাম ছাড়া খাদ্যতালিকার। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যেসব বিজনেস ডিনার আয়োজিত হত, সেখানে অভ্যাগতরা হাতে পেতেন ‘ব্লাইন্ড মেনু’। আর অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো রাখত ‘লেডিস মেনু’। মেয়েরা বিল মেটাবে, এও কি সম্ভব! কিন্তু গোল বাধল এই দুয়ে মিলেই। ১৯৮০ সালে, ক্যাথলিন বিক নামের এক ভদ্রমহিলা একজন বিজনেস পার্টনারকে নিয়ে ওয়েস্ট হলিউডের ল’অরেঁজারিতে ডিনার করতে গিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে সেই সঙ্গী ছিলেন পুরুষ। যথারীতি তাঁকে ধরানো হল ‘রেগুলার মেনু’ আর বিক পেলেন ‘লেডিস মেনু’। প্রবল চটে বিক দৌড়োলেন আইনজীবী গ্লোরিয়া অলরেডের কাছে, ‘লেডিস মেনু’ আসলে ‘ক্যালিফোর্নিয়া সিভিল রাইটস অ্যাক্ট’-এর পরিপন্থী এই দাবিতে ল্যস্যুট দায়ের করার জন্য। আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার আগেই অবশ্য রেস্তোরাঁ এই লিঙ্গনির্ভর মেনুকার্ডের ব্যবস্থাকে বিদায় জানায়। কিন্তু ২০১০ সালেও ট্রেসি ম্যাকলিওড জানিয়েছেন, লন্ডনের ‘লা গ্যাভরোচে’ রেস্তোরাঁ পুরুষের বুক-করা টেবলের ক্ষেত্রে ‘লেডিস মেনু’-র নিয়ম জারি রেখে চলেছে।
অভ্যাস ভাঙা কঠিন। পিতৃতন্ত্র ভাঙা আরও।