ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

রিভিউ : দ্য এলিয়েনিস্ট (নেটফ্লিক্স : ২০১৮)

সৃজিতা সান্যাল July 12, 2020 at 11:44 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

রিভিউ : দ্য এলিয়েনিস্ট (নেটফ্লিক্স : ২০১৮)
নির্মাতা : রুপার্ট গ্রার্গসন-উইলিয়ামস
সিজন : ১ টি (১০ টি এপিসোড)
অভিনয়ে : ড্যানিয়েল ব্রুহল, লুক ইভান্স, ব্রায়ান জেরাটি, ডগলাস স্মিথ প্রমুখ

উত্তর আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক সিটি। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ। বিংশ শতকীয় মন ও মননের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমাজের সদর-অন্দর। সোশ্যালিস্ট লেবর পার্টির নেতৃত্বে পোক্ত ভিত পাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। অথচ সেই আলোকিত দৃশ্যের অন্তরালে রয়েছে এক অন্য পৃথিবী। অন্যতর বাস্তব। অচেনা, ক্রূর, অমানবিক হিংস্রতায় পূর্ণ। অবচেতনের অন্ধকারে গড়া। সন্ধানী দৃষ্টি ছাড়া যার হদিশ পাওয়া সহজ নয়।

অপরাধজগতের সেই গভীরতম তলদেশকে চিনে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ডঃ ক্রাইৎসলার। পেশায় এলিয়েনিস্ট। ‘দ্য এলিয়েনিস্ট’ ওয়েবসিরিজের শুরুতেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয় এই শব্দের মর্মার্থ – “In the 19 th century, persons suffering from mental illness were thought to be alienated from their own true natures. Experts who studied them were therefore known as the alienists.” মানবিক চারিত্র্য থেকে বিচ্যুত মন নিয়ে চর্চার সূত্রেই ক্রাইৎসলার এসে পড়েন এক জটিল ভয়াবহ হত্যারহস্যের কিনারে।

হত্যা আসলে এক নয়, একাধিক। তীব্র শীতের রাতে শহর উপান্তে একটি সেতুর ওপর পাওয়া যায় মেয়েদের পোশাকপরিহিত এক কিশোরের মৃতদেহ ; চোখদুটি ওপড়ানো, যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন। সিরিয়াল কিলিংয়ের দ্বিতীয় খুন। এর বহুদিন আগে খুন হয়েছিল এক অভিজাত বংশোদ্ভুত যমজ ভাইবোন। এরপর একই পদ্ধতিতে একে একে যারা খুন হয় তারা সকলেই নগরপ্রান্তের যৌনপল্লীতে আশ্রিত রূপান্তরকামী বালক। নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনার রুজভেল্টের সমান্তরালে তদন্তের কাজে এগিয়ে আসেন তাঁর বন্ধু লাজলো ক্রাইৎসলার। তিনি সঙ্গী হিসেবে পান পুরনো বন্ধু, নিউ ইয়র্ক টাইমসের ইলাস্ট্রেটর জন মুরকে। রহস্যের আকর্ষণে দলে যোগ দেন আরও একজন – রুজভেল্টের সেক্রেটারি, নিউ ইয়র্কের পুলিশবিভাগে নিযুক্ত প্রথম মহিলা কর্মচারী মিস সারা হাওয়ার্ড। পুলিশবিভাগের আরও দুই ডিটেকটিভের সক্রিয় সহযোগিতায় উন্মোচিত হতে থাকে তদন্তের নানা অভিনব বাঁক। প্রতিটি খুনের স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রধান তিন তদন্তকারী মিলিতভাবে কাজ করলেও গোটা সিরিজ জুড়ে তাঁদের মতপার্থক্য এবং অনুসন্ধানের গতিপ্রকৃতির ফারাকটুকু বেশ চোখে পড়ার মত। এতে প্রধান তিন চরিত্রের ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রাইৎসলার বাহ্যিক তথ্যপ্রমাণের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেন খুনের মোটিভকে, অপরাধীমনের অন্ধকারতম প্রদেশের নাগাল পাওয়ার তীব্র ইচ্ছেই তাঁকে তদন্তের রসদ যোগায়। জন মুর তদন্ত এগোতে চান অপরাধীর ফেলে যাওয়া নিশানার ওপর নির্ভর করে। আর এই দুই পদ্ধতির সমন্বয় ঘটান সারা হাওয়ার্ড।

শুধু হত্যাকারীর মনোরহস্যের উদ্ঘাটনেই সীমাবদ্ধ থাকে না সিরিজ। গল্প এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হতে থাকে ব্যক্তিগত স্তরে তিন প্রধান চরিত্রের বিচিত্র টানাপোড়েন, তাঁদের বর্তমান আচরণের আড়ালে রয়ে যাওয়া অতীতের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।

ক্যালেব কারের উপন্যাস অবলম্বনে রুপার্ট গ্রার্গসন-উইলিয়ামস নির্মিত এই সিরিজের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক সম্ভবত এর সিনেমাটোগ্রাফি। অধিকাংশ দৃশ্যের অনুজ্জ্বল বা অন্ধকারময়, কিছুটা বিষাদাচ্ছন্ন টোন সিরিজের মূল থিমের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সময় দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ডের ফেড ইন, ফেড আউট ঘটনার রুদ্ধশ্বাস গতির মাঝে এনে দিয়েছে স্বস্তিদায়ক অবকাশ এবং পরবর্তী দৃশ্যে পৌছনোর মানসিক প্রস্তুতি। নামভূমিকায় ড্যানিয়েল ব্রুলের অভিনয় যথাযথ। ক্রাইৎসলারের সংবেদনশীল অথচ রুক্ষ, অনুসন্ধিৎসু অথচ শীতল ব্যক্তিত্বের জটিলতা তুলে ধরতে যে অধ্যবসায় ও মুনশিয়ানার প্রয়োজন তার ছাপ তাঁর কাজে রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে সারা হাওয়ার্ডের ভূমিকায় ডাকোটা ফ্যানিংয়ের অভিনয়। তাঁর দৃঢ়, অনমনীয়, কখনো কখনো আপাত কমনীয়তা-বর্জিত প্রায় পুরুষালি ভঙ্গিমা সারার পিতৃসান্নিধ্যে বেড়ে ওঠার ইতিহাস, বুদ্ধির প্রাখর্যে কর্মজগতে সম্মানজনক স্থান পাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, স্থূল লালসাপূর্ণ পুরুষ-সহকর্মীদের প্রতি ঘৃণা ও তৎসংলগ্ন পুরুষ-বিতৃষ্ণা, সর্বোপরি, অতীত ট্রাজেডিকে একক প্রচেষ্টায় বহন করার শক্তি ও স্থৈর্যকে চিনিয়ে দেয়।

পিরিয়ড ড্রামা হিসেবেও এই সিরিজ বেশ সফল। বিংশ শতকের প্রাক্কালে উত্তর আমেরিকার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির আভাস এখানে পাওয়া যায়। পুলিশ কমিশনার থিয়োডর রুজভেল্টের মত ঐতিহাসিক চরিত্রের উপস্থিতি এবং তাঁর আদর্শের সঙ্গে দুর্নীতিপূর্ণ পুলিশি ব্যবস্থার দ্বন্দ্বের ছবিও প্রাসঙ্গিকভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। তবে অধিকাংশ থ্রিলারের মত যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে এই মিনি-সিরিজ কোনও সূচিমুখ উপসংহারে সেভাবে পৌঁছে যায় না। বরং রহস্যের বেশ কিছু সুতো শেষপর্যন্ত ছাড়াই থাকে। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সম্পর্কে ঔৎসুক্য থাকলে ‘দ্য এলিয়েনিস্ট’ নিঃসন্দেহে আগ্রহ জাগাবে, কিন্তু নিছক ক্রাইম-থ্রিলার উপভোগের উত্তেজনা নিয়ে দেখতে শুরু করলে তা দর্শকের হতাশার কারণ হতে পারে।

#ওয়েব সিরিজ রিভিউ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

215002