স্পষ্ট কথার দায় : স্মরণে সতীনাথ ভাদুড়ী
“পাটোয়ারী মাথাটার সঙ্গে অধ্যবসায়ী লাজুক মনের লড়াই বেশীদিন চলল না।” অতএব এককথায় ওকালতি ছেড়ে দিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। ততদিনে উকিলপাড়ায় বেশ নাম হয়েছে। বার লাইব্রেরিতে জোর আলোচনা চলে, ইন্দুবাবুর ছেলে দিন দিন বাবার মতই হয়ে উঠছে। সিনিয়র ব্যারিস্টাররাও ‘মিশিল’-এর মুসাবিদার জন্যে তার পরামর্শ নেন। সেসব ছেড়ে সোজা সক্রিয় রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বাড়ি থেকে পঁচিশ মাইল দূরে সর্বোদয় নেতা শ্রী বৈদ্যনাথ চৌধুরীর টিকাপট্টির আশ্রমে পৌঁছলেন বাড়ির আদরের ‘সতু’। খবর পেয়ে বড়ছেলে ভূতনাথকে পাঠালেন ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী। দাদাকে বাড়ি ফিরিয়ে দিলেন সতীনাথ। পরের ন’বছর ধরে ধীরে ধীরে বিহারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন ‘ভাদুড়িজী।’তারপর অকস্মাৎ সরে আসবেন সেখান থেকেও।
‘...ওরূপ intellect-এর ছেলে, চাকরী কি Court attend করতে উৎসাহ পায় না। তারা বরাবর বড় aspiration পোষণ করে, সাধারণে যা করে তাতে মন বসে না। কিন্তু congress circle-এই বা তার মন তুষ্ট থাকবে কি করে? সে হল একটি ক্ষুরধার intellect –এর ছেলে, সত্যপ্রিয়, বিদ্যাপ্রিয়, sincere কিন্তু ও circle-এ যে প্রায়ই মূর্খ, মিথ্যাভাষীর সঙ্গ জুটবে। মনের মত দোসর বা বন্ধু পাবে না। কারো সঙ্গে বনবে না, কি করে কাটবে।’ ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালের নিজের ডায়েরিতে উদ্বেগের কথা লিখলেন দাদামশায় কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ আশঙ্কা মিথ্যে নয়। ১৯৪৮ সালে কংগ্রেসের সদস্যপদে ইস্তফা দিলেন সতীনাথ। যোগ দিলেন সোশ্যালিস্ট দলে, পরে সেখান থেকেও বেরিয়ে এলেন। সমগ্রের আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির আখের গোছানো যেখানে বড় হয়ে উঠেছে, সেই মুহূর্তেই সেখান থেকে সরে এসেছেন। নয়ত নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোস করতে হত। তাই উত্তরসূরিদের স্মৃতিচারণে ফুটে ওঠে নিখাদ শ্রদ্ধা।
‘জেলে আসবার আগেই শুনেছিলাম---মানুষের আসল চেহারা জেলের ভিতরে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। মুখোস খোলা আসল মানুষ । বাইরে থাকতে গলা ফাটিয়ে যাদের ‘জয়জয়কার’ করতাম তাঁদের সঙ্গে জেলে মাত্র কয়দিন থেকেই মনের আসনে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের প্রতিমাগুলো নিজেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। অনেক শ্রদ্ধেয় ‘মূর্তি’কে নিজের হাতে ভাঙ্গতেও হয়েছিল। ভাদুড়ীজীর সঙ্গে ওই তিন বছর থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বলে জীবন সংগ্রামের আঘাতে আমি কোনদিন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাইনি।’ পরবর্তী জীবনের এগিয়ে যাওয়ার রসদ এভাবেই পেয়েছিলেন, ফণীশ্বরনাথ রেণু। খুব কাছ থেকে যিনি দেখেছেন, শুধুমাত্র লেখার জন্যে কীভাবে টি-সেলের নিঃসঙ্গতা বেছে নিচ্ছেন সতীনাথ । পড়ে দেখছেন ‘জাগরী’ উপন্যাসের প্রথম পাণ্ডুলিপি। ভাদুড়ীজীর পরামর্শেই তাঁর লেখালিখির সূত্রপাত। এতদিনের ‘দেখা’কে ধরে রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন সতীনাথ। বলেছিলেন, ‘এতদিনে অনেক কিছু দেখলে। এবার লেগে পড়ো।’
অভিজ্ঞতা জমা হয়ে চরিত্র হয়। বিলু, নীলু, ঢোঁড়াই চেনাজগৎ থেকেই উঠে আসে। দেখার চোখে ভূমিকা বদলায়। আঁতের কথা পাল্টায় না। নিজের আদর্শ, ভালবাসা, পছন্দের সঙ্গে এক ফোঁটা আপসও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। রাজনীতি থেকে দূরে এসে মন দিয়েছিলেন সাহিত্যে আর বাগানচর্চায়। পছন্দ ছিল গোলাপফুল, বিভিন্নজাতের অর্কিড। আরেক প্রবাসী সাহিত্যিক বনফুল ভালোবেসে ডাকতেন, ‘বাগানিয়া’।
‘কেউ বাগান দেখতে এলে আপনার ভাল ভাল রঙ বেরঙের গোলাপগুলো দেখাবার সময় বলবেন না যেন আমার গোলাপগুলো সাধারণ।বললেই দেখবেন সমজদার লোকটি বিজ্ঞের মত কথাটি সমর্থন করে বলবেন---আমার কাকার উঠনে একটা গাছ ছিল, ইয়া বড় বড় আর কী খোসবাই--- আতরের। একেবারে ভুর ভুর করত ইত্যাদি। এই শ্রেণীর সমজদারই শতকরা ৯৯ জন। কাজেই নিজের বাড়িয়ে বলতে যদি বাধে তাহলে চুপ থাকবেন।'
মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে এমন খাঁটি অভিজ্ঞতা বড় দুর্লভ। তাই হয়ত খানিক বিস্মৃত সতীনাথও। স্পষ্ট কথার দায়ে?
#সতীনাথ ভাদুড়ি #জন্মদিন #টিম SILLY পয়েন্ট #ব্যক্তিত্ব #জাগরী #কংগ্রেস #সোশ্যালিস্ট #ফণীশ্বরনাথ_রেণু #ঢোঁড়াই #বনফুল #স্বাধীনতা #বিহার #রাজনীতি #সর্বোদয়