মুক্তগদ্য

স্মৃতিধর্ম

পিয়ালী বসু July 11, 2020 at 11:01 am মুক্তগদ্য

ঘরের বাইরে যাইনি বহুদিন। দরকারে অদরকারে বেরনোই যেত, আসলে ভয় পেয়েছি। রোগ, রক্ত সবেতেই ভয় আমার। সব পথগুলোয় তো এখন চাপ চাপ রক্ত তাই না! খবর পাই, খবরে দেখি। যদিও সবটা দেখা যায় না, কারণ যারা দেখায়, যারা দেখে আর যাদেরকে দেখে এই তিনের মধ্যে চিরকালের এক ভেদরেখা। তবু নিয়মের ফাঁক গলে যতটুকু দেখে নিই, তাতে ওই ভয়টা আরও চেপে বসে। অস্থির লাগে, শরীর খারাপ করতে থাকে। শুয়ে পড়ি দেখার ক্লান্তিতে। আর তখনই মনে হয়, চেনা হাতের স্পর্শে কপাল ভিজে যাচ্ছে। যেমনটা হত ছোটবেলায়, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকার সময়। টের পেতাম আমার কপালে চামড়া কুঁচকে যাওয়া এক হাত। আমার ঠাকুমা চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলছে, ‘আর রাগ করে না দাদা, ওঠ এবার, গল্প শুনবি!’নাতনি হয়েও আমরা পাঁচবোন ঠাকুমার ডাকে কখনও দিদিভাই নয়, দাদাই ছিলাম, ওই যেমনটা হয় আরকি। কিন্তু ঠাকুমার গল্প মানেই তো সেই শুনে শুনে ঠোঁটস্থ হয়ে যাওয়া বেগুন-তোলা বুড়ি আর নাহলে লেবুসুন্দরীর গল্প। তবু, সে মানুষটির ঠেলাঠেলিতে উঠে বসতেই দেখতাম মিটিমিটি হাসছেন সুন্দরী । তখন আমার কিশোরমুখ, বয়েজকাট চুল, মুখের দিকে তাকিয়ে বলে বসত, ' আহাআ গো, একদম যেন ইন্দিরা গান্ধী।' এই অসম্ভব তুলনা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তাম যখন, তখন ঠাকুমা বলত ‘অমন হাসবিনে, জানিস! আমাদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তা দিয়ে হুডখোলা গাড়িতে করে ইন্দিরা গান্ধীকে যেতে দেখেছি! যশোহর রোডে কী ভিড় তখন...’ । এ গল্পও বহুবার শুনেছি, তবু আবার একবার শুনব বলে সোজা হয়ে বসে বলতাম ‘হবে না হবে না। সেই প্রথম থেকে বলো।’ '৭১ এরও আগে, '৪৭ এরও আগের সেইসব কথা বলো।

স্মৃতিচারণ আমাদের অনিবার্য ভবিতব্য।ঠাকুমা তাই বলে ফেলত আরও আগের, কত আগের কথা৷ ‘.....বিজয় বুড়োর মেয়ে ছিলাম আমি, কলারুয়া ঝাউডাঙায় ছিল আমাদের বাড়ি । আমাদের দুইবোনের একই পরিবারের মাসতুতো দুই ভায়ের সঙ্গে বাংলা ১৩৫০ সালে একইদিনে বিয়ে হয়েছিল। সারা গ্রামের লোককে ছানা-চিনি খাইয়েছিল আমার বাবা।’ মন্বন্তরের সে যুগে ছানা চিনি যেন অমৃত। অন্তর ছুঁয়ে থাকা কোনকালের সে অমৃতের চিহ্ন এতকাল পরেও যেন তখন ঠাকুমার চোখেমুখে। '...বিয়ের পর গোরুর গাড়ি করে বেনাপোল পেরিয়ে এসে তোদের দাদুর সঙ্গে বায়স্কোপ দেখেছি কত, জানিস! দিব্যি কাটছিল দিন হেসে খেলে। অভাবের মধ্যেও একটু শান্তি ছিল। দেশে কোথায় কী হচ্ছে, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে আমরা, অত খোঁজ রাখতাম নাকি! তারপর একদিন শুনি দেশভাগ হবে। আচ্ছা বেশ, হবে তো হবে। ওমা তারপর সে কী গন্ডগোল, আগুন জ্বলল চারিদিকে। হিন্দুদের নাকি চলে যেতে হবে ওপারে আর ওইদিকের মুসলমানদের এপারে চলে আসতে হবে। মাঝখানে নাওভাঙার জল। তারপর একদিন সেই জল ঠেলে, নিজেদের ভিটেমাটি সব ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একটা নতুন নাম পেলাম, লোকে বলল শরণার্থী.. ' এরপরই থেমে যেত ঠাকুমা। আমি দেখতাম জল টলটল করছে আমার অশীতিপর ঠাকুমার চোখে। শৈশবেই নিজের সবটুকুই যে ফেলে এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে, মুখের ভাষাও ফেলে এসেছিল বুঝি সেইসঙ্গেই । তাই দু-একটা শব্দ ছাড়া প্রায় সবসময়ই খাঁটি রাঢ়ী উচ্চারণ ছিল আমার ঠাকুমার মুখে।

এপারে এসে অনেক কষ্টে একটা মাথাগোঁজার ঠাই পেয়েছিল ঠাকুমারা। অনেকের তো সেটুকুও জোটেনি, তার আগেই, পথেই শেষ হয়ে গেছে কত হাজার লক্ষ মানুষ। তবু, চিরকাল পৃথিবীতে কিছু মানুষ হেঁটেই চলে তাই না! কেউ ঘর ছেড়ে, কেউ বা ঘরে ফেরার তাগিদে..। দুর্ভাগ্যের জয়টিকা যাদের কপালে আঁকা হয়, তারা ওই টিকার গুণেই বুঝি আশ্চর্য পবিত্র, অপার ক্ষমাশীল হয়ে ওঠে। জগৎসংসারের সব কারসাজিকে সীমাহীন মাপ করে দেওয়ার ঠেকা নেয় যেন তারা। এসব কথা অবশ্য আমার স্বর্গত ঠাকুমাকে এখন বললে নিশ্চই কলকল করে বলে উঠত ‘ওসব ক্ষমাটমা আবার কী! বিপদের দিনে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। এটাই স্বাভাবিক।’ হয়তো তাই, তাই এতকিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকায় যখন কার্ফু জারি হল, বাড়িঘর ফেলে রেখে মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করল, প্রবল জেদে ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমার দাদু ঠাকুমা থেকে গেল একা, আমাদের পাড়ায়। মায়া জড়িয়ে পায়ে পায়ে থেকে গেল গোয়ালের গোরুটা, মাঠের ছাগলটা, ছড়িয়েছিটিয়েও আলগাশ্রী নিয়ে টিকে রইল ঠাকুমার গেরস্থালি। বাড়ির পাশের মেয়েদের স্কুলটায় তখন জয়বাংলার লোক ক্যাম্প তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে সুলেমান আর আব্দুল বলে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়িতে থেকেছিল বেশ কয়েকমাস। দিন পনের পরপর যুদ্ধে গিয়ে আবার ফিরে আসত ওরা।নিজের বাড়ির মতই থাকত। কেউ কিচ্ছু জানতে চাইত না, বরং ওরা আমার স্কুলে পড়া বাবা কাকাদের ওপার বাংলার সোনামুখো রোদের গল্প শোনাত দুপুরবেলা। ঠাকুমাই রেঁধেবেড়ে, খাইয়ে নিজের ফেলে আসা দেশকে স্বাধীন করার জন্য ওদেশেরই ওই দুজনকে এদেশ থেকে পাঠাত যেন প্রতিবার। ঠাকুমাকে ওরা ‘মা’ বলত।

তারপর একদিন স্বাধীন হল বাংলাদেশ।ওপারে জন্মানো প্রতিটি মানুষ এপারে বসেও সমান খুশি সে খবরে। শুধু বিকেল হলেই ওই দুজনের জন্য মন কেমন করত আমার ঠাকুমার।তারপর, হঠাৎই প্রায় ছ-মাস পর একটা বেজির ছানা হাতে করে তারা হাজির হয় আমাদের বাড়িতে। আমার ছোটকাকার হাতে সেই ছানা বেজিকে দিয়ে বলে ‘তোমাদের নুন খেয়েছি, তাই স্বাধীন বাংলাদেশের এই ছোট্ট প্রাণটা তোমাদের হাতে তুলে দিলাম, একে বাঁচিয়ে রেখো’। তারপর যেভাবে আসা সেভাবেই হুড়মুড়িয়ে ওরা ফিরে গিয়েছিল। ‘শিশির ভেজানো কাঁটাতার, গাছপালা’ পেরিয়ে সেও তো একরকম হেঁটে যাওয়া, তাই না!

#মুক্তগদ্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

28

Unique Visitors

214996