নিবন্ধ

ধর্ষণ এবং পুরুষতন্ত্র : একটি রাজনৈতিক সমীকরণ

রাণা আলম Oct 18, 2020 at 8:37 am নিবন্ধ

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের হাথরসে একটি বছর উনিশের তরুণীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও মারধর করা হয়। অত্যাচারিতা তরুণী মৃত্যুর আগে তার জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। গোবলয়ের কুখ্যাত জাতপাত এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আবশ্যিকভাবেই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চাপানউতোর শুরু হয়েছে। যেহেতু, অপরাধীরা উচ্চবর্ণের, তাই উচ্চবর্ণের একটি সংগঠন তাদের সমর্থনে প্রকাশ্যে সরব হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের শাসক দল প্রথম থেকেই এই ঘটনাকে চাপা দিতে তৎপর হয়েছিল। পরিবারের সম্মতি ছাড়াই ধর্ষিতা তরুণীর দেহ রাতের গভীরে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যা নিয়ে পরবর্তীকালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছে। এবং এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট রাজপ্রশাসন হাথরাসের ঘটনায় আন্তর্জাতিক এবং মহাজাগতিক ষড়যন্ত্র খুঁজছেন।

উত্তরপ্রদেশের শাসক দলের এক নেতা নিহত তরুণীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এই ট্র্যাডিশন নতুন নয়। আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে কোনও মেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে ইভটিজিং-এর শিকার হলে পাঁচটা আঙুলের চারটে মেয়েটির পোশাক এবং চরিত্রের দিকে থাকে। দিল্লিতে নির্ভয়া কাণ্ডের পর এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীও জানিয়েছিল যে অত রাতে একটি মেয়ের অনাত্মীয় পুরুষের সাথে বেরোনোটা তার কাছে অপরাধের সামিল।


নজরে থাকুক

‘কী জ্বলছে?’-র পাশেই রাখা থাক প্রশ্ন ‘কে জ্বালিয়েছে?’ / সরোজ দরবার


সাধারণভাবে, ধর্ষণের ফলে একজন নারীর সম্মানহানি ঘটে। কিন্তু এই ‘সম্মান’ আদতে কার, এইটে নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমাদের সমাজে মেয়েদের পারিবারিক সম্পত্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়। তার স্বাধীন মানুষী অস্তিত্ব আমাদের কাছে স্বীকৃত নয়। যে কারণে প্রগতিশীল কলকাতাতে এখনও সিঙ্গল মাদার-এর ধারণা সম্মান পায় না, একলা মেয়ের ঘরভাড়া পেতে সমস্যা হয়। যার আলাদা অস্তিত্বই আমরা মানতে চাই না, ধর্ষণে তার সম্মানহানির চেয়েও গুরুত্ব পায় পারিবারিক সম্মানহানি। কারণ, সে আদতে তার পরিবারের প্রপার্টি। দেশভাগের পর সীমান্তের দুইদিকেই নারীদের ধর্মান্তরিত করে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। তারপরে এই ‘ফোর্সড ম্যারেজ’-এর শিকার হওয়া মহিলাদের খুঁজে খুঁজে খুন করা হত তাদের তথাকথিত পারিবারিক সম্মান বাঁচানোর জন্য।

বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত আর্কাইভ ডকুমেন্টে সাংবাদিক হাসান মুর্শেদ পাকিস্তানের খানসেনা এবং রাজাকারদের একটি নৃশংস অত্যাচারের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। গ্রামের দিকে একটি পরিবারে বাড়ির কর্তা আর কিশোর ছেলেকে বেঁধে রেখে বছর কয়েকের শিশুকন্যাটিকে আছড়ে খুন করা হয়। তারপরে গৃহবধূকে স্বামী আর সন্তানের সামনে ধর্ষণ করে তাদের মাথা কেটে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে গৃহবধূটিকে ধর্ষণের অন্যতম কারণ হল নারীশরীরের উপর পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা। এবং উল্লেখ্য যে, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে নারীর অস্তিত্ব শুধুই শরীরময়। কোনও মেয়ে প্রেমপ্রস্তাবে সাড়া না দিলে তাকে যখন ধর্ষণ করার হুমকি দেওয়া হয়, তখন তা আদতে মেয়েটিকে শারীরিকভাবে ‘নষ্টা’ প্রমাণ করার চেষ্টা মাত্র। অনার কিলিং-এর উপর বিখ্যাত বই ‘ফরবিডন লাভ’-এর লেখিকা Norma Khouri-এর মতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘women’s chastity’-কে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়।

Susan Brownmiller তাঁর বহুচর্চিত বই “Against Our Will: Men, Women and Rape”-এ লিখছেন, ধর্ষণ পুরুষের কাছে নারীর উপর দখলদারি কায়েম করার খুব পুরোনো রাজনৈতিক অস্ত্র। তিনি লিখছেন, “from prehistoric times to the present, I believe, rape has played a critical function. It is nothing more or less than a conscious process of intimidation by which all men keep all women in a state of fear.” ইতিহাস থেকে তিনি দেখিয়েছেন ট্রয় থেকে ভিয়েতনাম, একাত্তরের বাংলাদেশ, সব ক্ষেত্রেই বিজয়ীর ইতিহাসের আবশ্যিক অংশ হল পরাজিত পক্ষের নারীদের ধর্ষণ। Arlene Eisen তাঁর ‘উইমেন ইন ভিয়েতনাম’-এ লিখেছেন যে আমেরিকান সৈন্যদের কাছে ভিয়েতনামের নারীদের ধর্ষণ করার নির্দিষ্ট নির্দেশ ছিল। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে খানসেনাদের নারকীয় ধর্ষণলীলা নিয়ে ‘Children of War’ নামে একটি তথ্যচিত্র আছে। Brownmiller-এর মতে ধর্ষণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ এবং পরিবার, এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে জড়িত। তাঁর মতে “Man's historic desire to maintain sole, total and complete access to woman's vagina, as codified by his earliest laws of marriage, sprang from his need to be the sole physical instrument governing impregnation, progeny and inheritance rights.”

Susan Griffin সাতের দশকে তাঁর এক প্রবন্ধে লিখলেন যে, ধর্ষণ আসলে পুরুষের কাছে ‘Male Protection Racket’ প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম অস্ত্র। একটি মেয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকে যে ঘরে-বাইরে যে-কোনো জায়গায় সে ধর্ষিতা হতে পারে, এবং একজন পুরুষই তাকে রক্ষা করতে পারে এই ধারণা বহু শতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর ফলে একজন পুরুষ নারীর উপর তার অধিকার বজায় রাখতে সমর্থ হয়। এই প্রসঙ্গে মনিকা বেলুচ্চি অভিনীত Malèna (২০০০) সিনেমাটির কথা ভাবা যেতে পারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সিসিলিতে সৈনিক স্বামীর মৃত্যুর খবরে সুন্দরী বিধবা নারী গোটা শহরের চোখে আবশ্যিক ভোগপণ‍্যে পরিণত হয়। কারণ, তার পাশে কোনো পুরুষ নেই। আবার যুদ্ধশেষে সৈনিক স্বামীর ফিরে আসার পর তার প্রতি শহরের মানুষের আচরণ বদলে যায়। 

নজরে থাকুক

অস্পৃশ্যতার শরীর, নাকি শরীর ভোগের অস্পৃশ্যতা? / হেমন্ত মণ্ডল


সোমা চ্যাটার্জি তাঁর ‘পলিটিকস অফ রেপ’ আর্টিকলে লিখছেন যে, ধর্ষণের সাথে ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-,এর যোগ আছে। পুরুষের শক্তির কাছে নারী দুর্বল। অতএব ধর্ষণ পুরুষের পুরুষত্ব এবং শক্তি প্রদর্শনের অন্যতম ক্ষেত্র। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ষণের শিকার হওয়া মহিলাদের অধিকাংশই জাতিগত এবং আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া কম্যুনিটির মানুষ। গোবলয়ে উচ্চবর্ণের ভূস্বামীরা নিম্নবর্ণের মানুষদের ঘর থেকে তাদের মেয়েদের জোর করে তুলে এনে ভোগ করে। উচ্চবর্ণের পুরুষের কাছে ধর্ষণ এখানে দলিত পরিবারকে ‘সবক’ শেখানোর অস্ত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অভিযোগগুলি পুলিশ থানা অব্দি পৌঁছায় না বা পৌঁছালেও সেই অভিযোগের কোনও তদন্ত হয় না। মনে রাখা দরকার, হাথরাসের ঘটনাতেও ধর্ষিতার জবানবন্দির ভিডিও রেকর্ডিং থাকা সত্ত্বেও রাজ্য পুলিশের বড়কর্তা প্রথম থেকেই ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন।

১৯৯২ সালে রাজস্থানে ভাঁয়োরি দেবীকে উচ্চবর্ণের মানুষেরা ধর্ষণ করেছিল, কারণ তিনি বাল্যবিবাহ বন্ধ করার অভিযানে ওই এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবং এটাও মাথায় রাখা দরকার, এই ধর্ষণের বিচারের নামে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক দলগুলি প্রহসন ছাড়া আর কিছু করেনি। অথবা, আমাদের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি যদি শিক্ষিকা সোনি সোরির কথা না ভুলে থাকে, তাহলে তা আর-একবার মনে করা দরকার। মাওবাদীদের সাথে থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষিকা সোনি সোরিকে পুলিশ কাস্টডিতে ধর্ষণ করা হয়। তাঁর যৌনাঙ্গে পাথরকুচি ভরে দেওয়া হয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সোনি সোরির উপরে অত্যাচারে মূল অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার অঙ্কিত গর্গকে পরবর্তীকালে সাম্মানিক পদক দিয়ে সম্মানিত করে। কালা কানুন আফস্পার আওতায় থাকা কাশ্মীরের কুনান পোশপোরার ধর্ষিতাদের এবং মণিপুরের ধর্ষিতা এবং নিহত মনোরমা থাংজমের কথাও এক্ষেত্রে সমানভাবে উল্লেখ্য।

ধর্ষণ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই নারীর উপরে দখলদারি স্থাপনের জন্য পুরুষের কাছে অতি প্রিয় অস্ত্র। আমাদের সামাজিক নির্মাণে নারীকে পুরুষের চোখে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠতে হয়। তাই, বাজারে ফেয়ারনেস ক্রিমের রমরমা বজায় থাকে, পুরুষের শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনেও একজন স্বল্পবসনা নারীকে দাঁড়াতে হয়। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে লিঙ্গসাম্য বিষয়টি এখন অব্দি সোশ‍্যাল মিডিয়ার ডিজিটাল পোস্টার হওয়া ছাড়া বাস্তবে খুব বেশি দূরে এগোতে পারেনি। এবং আমরা, এই পুরুষতান্ত্রিক প্যাথেটিক সমাজব্যবস্থার প্রোডাক্ট পুরুষেরা অধিকাংশই মনে করি, নারীস্বাধীনতা বিষয়টাও আমাদেরই দাক্ষিণ্য মাত্র।

তবুও, আমাদের যাবতীয় উদাসীনতা আর তাচ্ছিল্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াইতে দাঁড়িয়ে থাকেন ভাঁয়োরি দেবী, সোনি সোরি আর মণিপুরের মায়েরা। তাঁদের সামনে একদিন, নিশ্চয়ই একদিন, পুরুষতন্ত্র তার যাবতীয় ঔদ্ধত্যসমেত লজ্জায় মাথা নোয়াবে, এই বিশ্বাসটুকু থাক।



কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১। ‘দাস পার্টির খোঁজে’, (২০১৬), হাসান মুর্শেদ

২। ‘দ্য পলিটিকস অফ রেপ’, (২০১৮), সোমা এ চ্যাটার্জি

৩। মেরি এলেন গেল, (১৯৭৫), নিউ ইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ

৪। ‘এগেনইস্ট আওয়ার উইল’, (১৯৭৫), সুসান ব্রাউনমিলার


 


[ পোস্টারঃ অর্পণ দাস ]

#নিবন্ধ #নারীপক্ষ #সিলি পয়েন্ট #হাথরাস #গোবলয় #উত্তরপ্রদেশ #নির্ভয়া #ইভটিজিং #দেশভাগ #সীমান্ত #ফোর্সড ম্যারেজ #হাসান মুর্শেদ #খানসেনা #রাজাকার #Norma Khouri #women’s chastity #Susan Brownmiller #“Against Our Will: Men Women and Rape #Arlene Eisen #Children of War #Brownmiller #Women in Vietnam #Susan Griffin # Malèna #সোমা চ্যাটার্জি #Politics of Rape #ভাঁয়োরি দেবী #রাজস্থান #সোনি সোরি #AFSPA #Soni Sori #Kunan Poshpora #Kashmir #Manipur #Thangjam Manorama #gender equality #SAY NO TO RAPE #Feminism #Hathras #Gang Rape #Power Politics #Balarampur #Silly Point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

9

Unique Visitors

214972