রাম্মামের রুটম্যাপ
(জুন, ২০২২)
মাঝেমধ্যে মনে হয় জীবনের গতি বড্ড বেশি। তাড়াহুড়োয় কত মানুষের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলা হয়ে ওঠেনি, কত জায়গার পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে গিয়েছি, সেখানে আবার গিয়ে দুদণ্ড বসতে ইচ্ছে হয় এখন। তাই পুরোনো ছবি ঘাটতে ঘাটতে রাম্মাম থেকে সামান্দেন যাওয়ার পথের এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা কোনও পাহাড়ি নদীর ছবি দেখে হঠাৎ করেই মনে হল, ইস্ আগেরবার যদি আরেকটু সময় কাটাতে পারতাম এখানে, ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে কৈশোরের অতিসচেতনতার কারণে কিছু ‘না হয়ে ওঠা’ বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে। আরও একবার সুযোগ পেলে সাহস করে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করা যায়।
উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ সীমানায়, প্রায় লুকিয়ে থাকা, ছোট্ট গ্রাম রাম্মামের ওপর দিয়ে বার কয়েক আসা-যাওয়া করেছি, কিন্তু কোনোবারই থাকার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার তাই ঠিক করেছিলাম সেই পাহাড়ি নদীর ডাকে ফিরে যাবই, দূরত্ব আর দুর্গমতার বাধা পেরিয়ে আবার রাম্মামে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, সঙ্গে পেয়ে গেলাম ইস্কুলবেলার বন্ধু দীপ্তেন্দুকে। ভাগ্যক্রমে এমন এক বন্ধু পেয়েছি যে এরকম একদিনের প্ল্যানিং-এ, কখনও বা কোনও প্ল্যান ছাড়াই এরকম হঠাৎ করে বেড়াতে যাবার ব্যাপারে আমার বরাবরের সঙ্গী। অতএব আর দেরি না করে ফোন করে ফেললাম রাম্মামের সাইনো হোমস্টের মালিক কমল প্রধানজীকে। প্রধানজী ভারি অমায়িক ভদ্রলোক, বললেন সেই উইকেন্ডেই শুধু খালি আছে, পরের উইকেন্ডের জন্য ইতিমধ্যেই বুকিং হয়ে আছে। অতএব আমরা দেখলাম এই উইকেন্ডেই যেতে হলে হাতে আর মাত্র দুদিন, তৎকাল ছাড়া গতি নেই। পড়িমড়ি করে আগে ফেরার টিকিটটা করে ফেল্লাম, তখন প্রায় আর কোনও ট্রেনেই টিকিট নেই। শেষমেশ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে নিউ মাল জংশন থেকে ফেরার টিকিট পাওয়া গেল, যাওয়ার টিকিটও তৎকালে হয়ে গেল কামরূপ এক্সপ্রেসে।
সাইনো হোম-স্টে, রাম্মাম (যোগাযোগ-৯৭৩৩১৬৯২৯৮)
শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে উঠে কিছুদূর যাবার পর প্রথম পাহাড় দেখার অনুভূতিটাই আলাদা। মানভঞ্জনের পর প্রেমিকার আলতো হাসিটা দেখে যেরকম স্বস্তি বোধ হয়, অনেকটা সেরকম। যেতে যেতে মিরিকের সবুজ গালিচায় ঢাকা পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগোনোর পথে কিছু অলস মেঘের দেখা পাওয়া যায়, যেগুলো এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে। আরো ওপরে যখন উঠবেন, তখন এদেরই কারো সাথে হয়তো আবার দেখা হয়ে যেতে পারে আপনার।
শান্তির ঠিকানা রাম্মাম
প্রথমেই বলে রাখি, সান্দাকফু ট্রেক যারা করেন তাঁদের অনেকের কাছেই রাম্মাম একটি পরিচিত নাম। সান্দাকফু-ফালুট ট্রেক করে ফেরার সময় অনেকেই রাম্মাম হয়ে শ্রীখোলা আসেন। এক্ষেত্রে ফালুট থেকে রাম্মাম অবধি কিন্তু পুরোটাই হাঁটা, কারণ এখানে কোনও গাড়ি চলার রাস্তা নেই। সেক্ষেত্রে, কেউ যদি এনজেপি বা শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি রাম্মাম যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তবে তাঁরা গাড়ির রাস্তা ধরেই কিন্তু চলে যেতে পারেন। যাওয়ার উপায় দুরকম। প্রথম দিনটা শ্রীখোলায় থাকতে পারেন অথবা সরাসরি পৌঁছে যেতে পারেন রাম্মাম। ট্রেন থেকে নামার দিনই রাম্মাম পৌঁছে যেতে হলে কিন্তু চেষ্টা করবেন এমন ট্রেনের টিকিট কাটতে যেটা এনজেপিতে পৌঁছায় ভোর ৬টার মধ্যে (এক্ষেত্রে হাতে থাকে তিস্তা-তোর্সা বা কামরূপ এক্সপ্রেস), কারণ শ্রীখোলা বা রিম্বিক যাওয়ার বেশিরভাগ শেয়ার্ড গাড়িগুলোই ছাড়ে একেবারে সকালের দিকে, ভাড়া রিম্বিক অবধি জনপ্রতি ৬০০ টাকা এবং শ্রীখোলা অবধি জনপ্রতি ৬৫০-৭০০ টাকা। শ্রীখোলা রিজার্ভ করে গেলে শ্রীখোলা অবধি পড়বে ওই ৬৫০০ টাকা। রিম্বিক থেকে শ্রীখোলা এবং শ্রীখোলা থেকে রাম্মাম যাওয়ার শেয়ার্ড গাড়ি পাওয়া যায়। ভাড়া রিম্বিক থেকে শ্রীখোলা শেয়ারে ৫০ টাকা এবং শ্রীখোলা থেকে রাম্মাম আরও ৫০ টাকা। এখানে বলে রাখি যে, শ্রীখোলা নদীর ওপর গাড়ি যাওয়ার ব্রিজ তৈরির কাজ এখনও শেষ হয়নি। তাই শ্রীখোলায় এসে হেঁটে একটা সুন্দর ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে অন্য প্রান্ত থেকে শ্রীখোলা থেকে রাম্মাম যাওয়ার গাড়ি ধরতে হবে।
পাহাড়ি নদী শ্রীখোলা
অপূর্ব সুন্দর ছোট্ট এক পাহাড়ি নদী হল শ্রীখোলা। বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে শ্রীখোলা নদীতে জলের স্তর এবং স্রোত কম থাকলে গাড়ি সহজেই নদী পার হয়ে অন্যপ্রান্তে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রিম্বিক থেকেই সরাসরি রাম্মাম যাওয়ার শেয়ার্ড গাড়ি পাওয়া যায়, ভাড়া ১০০ টাকা। শ্রীখোলা থেকে রাম্মামের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগে ৪০-৪৫ মিনিট মত, কারণ শেষ ৩-৪ কিলোমিটার রাস্তা পাথুরে এবং বাঁক-বহুল। আর রাম্মাম যাওয়ার এই শেয়ার্ড গাড়িগুলো মূলত হয় বোলেরোর পিক-আপ ভ্যানগুলো, যেগুলোয় বসার জায়গা মাত্র ৬টা, গাড়ির পেছনে টেম্পোর মত অংশটায় দাড়িয়ে যাবার সুযোগ থাকলেও প্রথম যারা যাচ্ছেন তাদের জন্য সেটা একেবারেই সুবিধের নয়, বরং ড্রাইভারের সাথে কথা বলে বসে যাওয়ার চেষ্টাই করবেন! ১০০০ টাকা দিয়ে এই গাড়িগুলো রিজার্ভ করেও আপনারা যেতে পারেন, তবে গাড়ির সংখ্যা কম, তাই রিজার্ভ করতে চাইলে আগে থেকে হোমস্টের মালিকের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করে রাখাই শ্রেয়। পাহাড়ের সব জায়গায় ওই টুক করে পৌঁছে যাওয়ার উপায় থাকে না। তবুও পাহাড়প্রেমীরা শত কষ্ট সহ্য করেও পাড়ি দেন সেই দুর্গম-গিরির পথে। এ অমোঘ আকর্ষণ নিজে অনুভব না করলে বোঝা মুশকিল। রাম্মামও খানিকটা সেরকম বলতে পারেন। রাস্তা পরিষ্কার থাকলে শিলিগুড়ি থেকে রিম্বিক অবধি পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪-৪:৩০ ঘন্টা মত। রিম্বিক থেকে শ্রীখোলা সময় লাগবে ৩০ মিনিট মত এবং শ্রীখোলা থেকে রাম্মাম আরও ৪০-৪৫ মিনিট।
শ্রীখোলা থেকে রাম্মাম যাওয়ার গাড়ি
রাম্মামের সাইনো হোমস্টের মালিক কমল প্রধানজী অমায়িক ভদ্রলোক। ওনার হাসিমুখে অভ্যর্থনা আর সাদর আপ্যায়নে পথের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঘরগুলো সুন্দর এবং সাজানো। কিন্তু এখানে যারা আসবেন তাঁদের জন্য বলে রাখি যে, এখানে শুধুমাত্র একটি ঘরেই অ্যাটাচড্ বাথরুম আছে। বাকি ঘরগুলোর জন্য কিন্তু কমন বাথরুম, যদিও সেগুলো খুবই পরিষ্কার। খাওয়া-দাওয়া খুবই সুস্বাদু এবং পরিমাণেও যথেষ্ট।
সিঙ্গালিলার মধ্যে অবস্থিত এক শান্ত পাহাড়ি গ্রাম হল রাম্মাম। দিনের এক এক সময়ে এর এক এক রূপ। সকালে পাখির ডাক আর পাহাড়ি ঝর্ণার নিরন্তর বয়ে চলার শব্দে মনে হয় এ যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছি। আবার সন্ধ্যায় উল্টোদিকের ভারেঙ আর রিবদির পাহাড়ের ছোট ছোট আলোগুলো জোনাকি আর আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তারাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি করে। কোনওটাকেই আলাদা করে চেনা যায় না, আকাশ-জমিন সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। রাম্মামে একটা ছোট মনাস্ট্রি, আর ঠিক গল্পের মতই একটা ইস্কুল-বাড়ি আছে; অবশ্যই ঘুরে দেখবেন এগুলো।
রাতের রাম্মাম
রাম্মাম থেকে সিঙ্গালিলা জঙ্গলপথ ধরে আরও ছয় কিলোমিটার পথ হেটে গেলেই অপার্থিব সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে পশ্চিমবঙ্গের একেবারে শেষ সীমান্তে অবস্থিত সামান্দেন উপত্যকা, যা সাইলেন্ট ভ্যালি নামেও পরিচিত। এই পথ ধরে ঠিক অর্ধেক দূরত্ব গেলেই দেখা মিলবে জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলা রাম্মাম নদীর। সিঙ্গালিলার এই জঙ্গল-পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির বর্ণ, গন্ধ আর ছন্দের সাথে কখন যেন একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে শুধু শব্দ শুনছিলাম। পাখির গান, ঝিঁঝির ডাক, শুকনো পাতাগুলোর ঘষা লাগার শব্দ আর পাহাড়ি ঝর্ণার অবিরাম বয়ে চলার শব্দ। প্রতিটিই হয়ে চলেছে আপন ছন্দে, ঠিক যেন একটা সুন্দর মিউজিকাল পিস-এর বিভিন্ন স্তরের মত, আদি-অনন্তকাল ধরে যে সুর বেজে চলেছে, অদৃশ্য কয়্যার-ডিরেক্টরের ব্যাটনের নির্দেশে সে সুরের ওঠানামা চলছে অবিরত, কিন্তু থামছে না কখনওই। অতঃপর প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে, বনের গন্ধে বিভোর হয়ে এগিয়ে চললাম সামান্দেনের দিকে।
সিঙ্গালিলার জঙ্গলপথে
পথে কত পাহাড়ি ঝর্ণা, আগে কোনোদিন না দেখা ফুল আর পাহাড়ের মতই ধরা না-দেওয়া পাখি, দেখবেন ঠিক পথ বাতলে দেবে। কখনও উঁকি দেবে দূরের পাহাড়ের খেলনাবাড়িগুলো, মুহূর্তেই আবার ভ্যানিশ। মেঘ এসে খবর নিয়ে যাবে, “কি মশাই, আজ লাঞ্চে চিকেন-ভাত? না কি, মোমো-ওয়াই ওয়াই?” ভেজা কাঠের গুঁড়ির ওপর গজিয়ে ওঠা ব্যাঙের ছাতা, ফার্ণের জটলা আর বহুবছর ধরে এ পথের পাহারায় থাকা বৃক্ষরাজি যেন জায়গায় জায়গায় ওয়ার্মহোল তৈরি করে রাখে। সামান্দেনে ঢোকার মুখেই আছে সবুজ গালিচায় মোড়া একটা খোলা মাঠ। সব মিলিয়ে এমন রূপকথার মত পরিবেশ, যে এই মাঠে চরতে থাকা ঘোড়াগুলোকে পক্ষীরাজ বলে ভুল হয়ে যায়। সামান্দেনে ছিলাম রূপেশ ছেত্রীর সাইলেন্ট ভ্যালি হোমস্টেতে। ছবির মত সুন্দর। এখান থেকে দুই কিলোমিটার হেঁটে গেলেই আবার আরও এক শান্ত-সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম গোর্খে। গোর্খে থেকে আবার চার কিলোমিটার হেটে গেলেই সিকিমের ভারেঙ থেকে আবার গাড়ি-চলা রাস্তা মিলবে। সেখান থেকে গাড়ি ধরে সরাসরি এনজেপি বা শিলিগুড়ি চলে আসতে পারবেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, রাম্মাম থেকে সামান্দেন-গোর্খে হয়ে ভারেঙ যেতে হলে গোর্খের সিঙ্গালিলা চেকপোস্ট থেকে টিকিট করাতে হবে, যার মূল্য জনপ্রতি ১২০ টাকা। আবার কেউ যদি শুধুমাত্র রাম্মামে কাটিয়েই শ্রীখোলা হয়ে ফিরে আসেন তবে এই টিকিট করা জরুরি নয়। রাম্মামে ইলেকট্রিসিটি এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা নেই সেরকম (যেটা সামান্দেন আর গোর্খেতে বেশ আছে), তবে ইন্টারনেট স্পিড মোটামুটি হলেও “ওয়ার্ক ফ্রম হিল” করার পক্ষে খুব একটা উপযোগী নয়।
সাইলেন্ট ভ্যালি হোম-স্টে, সামান্দেন (যোগাযোগ-৯০০২১৩৪১৯৮)
গন্ধেরও যেন এক অদ্ভুত স্মৃতি থাকে, আচমকাই একেবারে অন্যরকম কোনও জায়গায় পাওয়া কিছু গন্ধ বহুদিন আগের কোনও স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। তেমনই আবার যেন প্রত্যেক স্মৃতির সঙ্গেই আলাদা আলাদা কিছু গন্ধ জড়িয়ে থাকে। ঠিক যেমন সিঙ্গালিলার জঙ্গলের কথা মনে করলেই আমি সেই পাগল-করা বুনো গন্ধটা পাই, আর সেটাই যেন বারবার আমাকে টেনে নিয়ে যায় পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ওই একলা নদীর ধারে।
**************
ছবি: লেখক
#রাম্মাম #ভ্রমণ #রাহুল দত্ত #পাহাড় #সিলি পয়েন্ট #সিঙ্গালিলা #silly point #Singalila #Rahul Dutta #travel # photography # webportal