নিবন্ধ

<b>স্বয়ং রামচন্দ্র কি স্বস্তি পেতেন এই মন্দিরে?</b>

সরোজ দরবার Aug 12, 2020 at 9:57 am নিবন্ধ

নরচন্দ্রমা রামচন্দ্রকে আমরা যেমনটা দেখি, রামায়ণের কাহিনিতে, তাতে এটুকু স্পষ্ট যে তিনি আর-কিছুতে ভয় না পেলেও, অধর্মকে বেজায় সমীহ করতেন। সামান্যতম কারণে ধর্মচ্যুত হন, এমনটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল প্রায়। এবং যে যে কাজে স্বাভাবিকভাবে ধর্ম রক্ষিত হয়নি বলে মনে হতে পারে, বা উত্তরকালের মনে হয়ও, যেমন শম্বুক কি বালী বধ বা সীতাকে ত্যাগ, সেই ক্ষেত্রগুলিতে, যেন আগাম আঁচ করেই একাধিক যুক্তি সাজিয়ে রেখেছিলেন রামচন্দ্র। এবং সে কাজগুলি বৃহত্তর ধর্মসাধনের লক্ষ্যেই করা হয়েছে, মোটামুটি এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বহুতর প্রয়াস ছিল সেইসব যুক্তি-সোপানে। উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, তাও বলা থাক যে, রিলিজিয়নের সংকীর্ণ জামা গায়ে চাপানোর কোনও দায় রামচন্দ্রের ধর্মের কোনোকালেই ছিল না। ফলে ধর্মের প্রসারিত এবং সম্ভাব্য সমস্ত অর্থ মাথায় রেখেই একটা প্রশ্ন ভেসে ওঠে - এই যে মন্দিরের ভিতপুজো হল, এ কি ধর্মে সইত স্বয়ং রামচন্দ্রের?

সম্পত্তি নিয়ে মহাভারতে বিবাদ ঘনিয়ে ওঠে। রামায়ণ কিন্তু সেখান থেকে শতহস্ত দূরে। রামচরিত্রকে কেন্দ্র করেই মূলত এই অসাধ্যসাধন হয়েছে। রামায়ণেও যুদ্ধ আছে বটে। কিন্তু সে যুদ্ধ ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পত্তির বিবাদজনিত যুদ্ধ নয়। গৃহবিবাদ, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ রামায়ণের অভীষ্ট নয়। অথচ কাহিনির শুরুটা সেখান থেকেই। রামচন্দ্র যখন রাজা হতে চলেছেন, তখনই মঞ্চে কৈকেয়ীর আবির্ভাব এবং ভরতের রাজ্যপ্রাপ্তি। এ কাহিনি আমাদের জানা। এবং, এও জানা যে ভরত নিজেও এই রাজ্য পেয়ে খুব তৃপ্ত ছিলেন, তা নয়। রামের অভিষেক তখন হয়েই গিয়েছিল। অস্ত্রবল এবং জনসমর্থন - কোনোটাতেই রামের কমতি কিছু ছিল না। অনায়াসে অনিচ্ছুক ভরতকে পরাস্ত করে রামচন্দ্র সিংহাসন দখল করতে পারতেন। কিন্তু রাম সে পথে যাননি। কারণ এই বিবাদ তাঁর কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

বরং দেখা যাচ্ছে, রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনবাসকালে ভরত একবার সৈন্য নিয়ে রামচন্দ্রের কাছে গিয়েছিলেন। দূর থেকে তা দেখে লক্ষ্মণ তো রেগে আগুন। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁদের শেষ করে দিতেই ভরত সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। ফলে, ভরতকে বধ করাই উচিত। তাতে অধর্ম হয় না। অর্থাৎ, লক্ষ্মণের ক্রোধকে সম্বল করে রাম ওখানেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারতেন। হলে আরেকটা মহাভারত হয়ে-ওঠা অসম্ভব ছিল না! কিন্তু এবারও তিনি সে পথে হাঁটলেন না। ভরত প্রস্তাব এনেছিলেন, রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার। রাম তাও প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ, পিতা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সুতরাং পুত্র হিসেবে রামের কর্তব্য রাজ্য ত্যাগ করা, ভরতের উচিত তা গ্রহণ করা। এর ব্যত্যয় নেই। এটিই ধর্ম। রাম সেই ধর্ম থেকে সরেননি। সম্পত্তির বিবাদ, ও সেই হেতু ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, যা কিনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল না, তা মূলত হল না রামের কারণেই। তাঁর ধর্মরক্ষার কারণে। দু-একবার ক্ষোভ যে তাঁর মনেও বুদবুদ তোলেনি তা নয়, কিন্তু তা ধর্মরক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

এহেন রামচন্দ্র কি একটি মন্দির পেয়ে খুশি হতেন! বিশেষত সেই জমিতে, যেটিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘকালীন বিবাদ; ভ্রাতৃহত্যার ইতিহাস এবং সম্ভাবনা দুই-ই যার সঙ্গে সংলগ্ন, সেটুকুকে আপন করে পেয়ে নরচন্দ্রমা কি নিজ ধর্ম রক্ষা করতে পারতেন! খটকা লাগে।

আরও পড়ুন

‘অযোধ্যার চেয়ে সত্য’

রামচন্দ্রের যুদ্ধ ছিল বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে। সরল সমীকরণে যাকে বলা যায়, অনার্যদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানেও রামচন্দ্র বলেই তো তিনি ব্যতিক্রম। যেহেতু যুদ্ধ, তাই বিরুদ্ধপক্ষ থাকবে, স্বাভাবিক। মূলত একে বলা যায় আর্যসভ্যতার প্রসার। অথচ রাম তো লঙ্কা দখল করেননি। রাবণকে নানা কৌশলে হারিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘রামচন্দ্র শত্রুদিগকে বশ করিয়াছিলেন, তাহাদের রাজ্য হরণ করেন নাই। বিভীষণ তাঁহার বন্ধু হইয়া লঙ্কায় রাজত্ব করিতে চাহিল। কিষ্কিন্ধ্যার রাজ্যভার বানরদের হাতে দিয়াই চিরদিনের মতো তিনি তাহাদিগকে বশ করিয়া লইলেন। এইরূপে রামচন্দ্রই আর্যদের সহিত অনার্যদের মিলন ঘটাইয়া পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের সম্বন্ধ স্থাপন করেন।’ অর্থাৎ কিনা আজকের দিনে প্রার্থিত ইনক্লুসিভ্‌নেস, তাই-ই রামচন্দ্রের শেষমেশ কাঙ্ক্ষিত। আর্য-অনার্যের মিলন সম্পন্ন হলে রামচন্দ্রের কাহিনি মুখে মুখে ফিরতে শুরু করল। তাই-ই গাঁথা হল মহাকাব্যে।

সেই রামচন্দ্র কি এই দেখে খুশি হতেন, যে তাঁর মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এই ভূমির বহু মানুষকে শ্রেণি ও আচরণীয় ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করে রাখা হছে! একটি জাতির মিলিত সংমিশ্রিত রূপকে এখন পেট চিরে চিরে আলাদা করা হচ্ছে। আর তার পুরোভাগে রাজনৈতিক নিশান হয়ে থাকছে তাঁরই মন্দির। এই তথ্যটুকু স্বস্তি দিত ধর্মরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ রামচন্দ্রকে!

রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট কথা, ‘গার্হস্থ্যপ্রধান হিন্দু সমাজের যত-কিছু ধর্ম’ রামচন্দ্রকে সে সবেরই অবতার করে দেখিয়েছেন আদিকবি। ছেলে হিসেবে, ভাই হিসেবে, স্বামী হিসেবে (সমালোচনার অবকাশ যদিও থাকে), রাজা হিসেবে তাই তিনি ‘লোকপূজ্যতা’ অর্জন করেছিলেন। ‘নিজের সমুদয় সহজ প্রবৃত্তিকে শাস্ত্রমতে কঠিন শাসন করিয়া সমাজরক্ষার আদর্শ দেখাইয়াছিলেন। আমাদের স্থিতিপ্রধান সভ্যতায় পদে পদে যে ত্যাগ ক্ষমা ও আত্মনিগ্রহের প্রয়োজন হয়, রামের চরিত্রে তাহাই ফুটিয়া উঠিয়া রামায়ণ হিন্দুসমাজের মহাকাব্য হইয়া উঠিয়াছে।’ – এই হল রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন। এবং রামচন্দ্রকে সত্যিই এর বাইরে ভাবার প্রয়োজন নেই। আত্মনিগ্রহ শব্দের দিকে আমরা যদি খেয়াল করি, তবে স্পষ্টই বুঝব, রামচন্দ্রের স্বরূপ। যে ভূমি ইতিমধ্যেই গৃহবিবাদের কারণ, এবং এখনও সে সম্ভাবনা পুরোপুরি মুছে যায়নি, সেখানে আর যাই হোক রামচন্দ্র মন্দির-লাভের কারণে প্রবৃত্তির শাসনে নিজেকে সমর্পণ করতেন না। তাহলে তাঁর এতদিনকার ত্যাগ, ক্ষমা, ধর্মরক্ষার আখ্যান মিথ্যে হয়ে যায়। তিনি কেবল পুরুষোত্তম তো নন, মর্যাদা পুরুষোত্তমও।

আমরা মন্দির গড়ছি। রামচন্দ্রের সেই মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি তো!

#নিবন্ধ #স্বয়ং রামচন্দ্র কি স্বস্তি পেতেন এই মন্দিরে? #সরোজ দরবার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

183400