রাম : রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব এবং অপরত্বের চিহ্নতত্ত্ব
‘রাম’ এবং ‘রাজনীতি’ শব্দদুটি বস্তুত দুটি পরস্পর আপতিত ছায়া। রামকেন্দ্রিক অতি সংবেদনশীলতার বর্তমান রাজনৈতিক চরিত্র খুব অস্পষ্ট নয়। তবুও রাম এবং রাজনীতি হয়ত রাম কথার জন্মের সময় থেকেই পরস্পরলগ্ন। একে অন্যে সম্পৃক্ত।
প্রথমত, এ কথা আজ সম্ভবত অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই যে রামায়ণ একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক আখ্যান। ব্রুকিংটন থেকে শুরু করে কামিলা বুলকে পর্যন্ত অনেক রামায়ণ-গবেষক দেখিয়েছেন যে, রাম মূলে একজন ক্ষত্রিয়বীর। রাজা। তাঁর অবতারত্ব পরবর্তী প্রক্ষেপ। যদিও নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি মনে করেছেন, “প্রাচ্যপন্ডিতেরা নিরন্তর রামচরিত্রের মহিমা কীর্তন করে যে এক্সট্রিমিজমের সূচনা করেছেন, পাশ্চাত্য পন্ডিতেরাও প্রক্ষেপবাদের পঙ্কোদ্ধার করে সেই এক্সট্রিমই আমদানি করেছেন।" রামায়ণের মূল কাহিনি কাঠামোর কাছে যদি আসা যায়, তাহলেও রামকথার রাজনৈতিক চারিত্র্য খুব কিছু ক্ষুণ্ন হয়না। এক রাজার পারিবারিক বিবাদে রাজ্যচ্যুতি, সীতাহরণজনিত ইক্ষ্বাকুবংশাপমান খণ্ডনার্থে অন্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা এবং জয়লাভ -- এই তো রামায়ণের কাহিনিচুম্বক।
অবশ্য রামায়ণের মূল কাহিনি-কাঠামোর কারণেই এই প্রবন্ধ এক বিদ্যায়তনিক কূটচক্রে পড়ে গেল। রামায়ণের মূল কাহিনি-কাঠামো বলতে আমরা কী বুঝব? কোনটা প্রক্ষেপ আর কোনটাই বা প্রক্ষিপ্ত নয়? মূল রামায়ণ যে কার তা নিয়েই তো বহু মৌলিক বিতর্ক রয়েছে । কেউ কেউ অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত অবলম্বনে মনে করেছেন রামায়ণ বস্তুত লেখা শুরু করেছিলেন চব্যন মুনি। শেষ করেন বাল্মীকি। দীনেশচন্দ্র সেন 'The Bengali Ramayana' গ্রন্থে দেখাতে চেয়েছেন রামায়ণ মূলত পালি দশরথ জাতকের অনুসরণে লেখা। যদিও Winternitz তাঁর 'History of Indian Literature' (Vol 1)-এ এই মত যুক্তি দিয়ে খন্ডন করেছেন। Weber রামায়ণে যে গ্রিক প্রভাবের কথা বলেছিলেন, Winternitz তারও সংগত বিরোধিতা করেন।
উৎস এবং প্রভাব সংক্রান্ত বিতর্ক ছাড়াও রামায়ণের কাহিনি কাঠামো নির্ণয়ের আরেকটি সমস্যা আছে। রামায়ণ, আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে রামকথা কিন্তু এক প্রবহমান সাংস্কৃতিক স্রোত। কেবল বাল্মীকির রামায়ণই রামকথার শেষ কথা নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে মহাভারত, খিল হরিবংশ, ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত্য পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত পুরাণ ইত্য্যাদিতে রাম কাহিনির নানান খণ্ড মেলে। এছাড়াও যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, আনন্দ রামায়ণ, ভুশুণ্ডী রামায়ণ, তত্ত্ব- সংগ্রহ রামায়ণ, মহা রামায়ণ প্রভৃতির কাহিনিসূত্র অনেক সময়ই স্বতন্ত্র। বাল্মীকির কাহিনিসূত্রের সঙ্গে এদের বিরোধও লক্ষণীয়। এ ছাড়াও রামদাস গৌড় হিন্দুত্ব গ্রন্থে (প্রকাশক শ্রীশিবপ্রসাদ গুপ্ত,সেবা উপবন, কাশী, ১৯৩৮) আরও উনিশটি রামায়ণের উল্লেখ করেছেন। এ সমস্ত ছাড়াও রয়েছে জৈমিনীয় অশ্বমেধের রামকাহিনি, উড়িষ্যার সারলাদাসের বিলঙ্কা রামায়ণ, বলরাম দাসের জগমোহন রামায়ণ প্রভৃতি। এছাড়াও কালিদাস প্রমুখের হাতে রাম কথার পুনর্বিন্যাস হয়েছে। (রঘুবংশের কথা পাঠকের মনে আসবে)। বৌদ্ধ এবং জৈনদের স্বতন্ত্র রামকথা রয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য ছাড়াও তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালাম, বাংলা, অহমিয়া, হিন্দি, মৈথিলী, ওড়িয়া, আদিবাসী, মরাঠি, গুজরাটি, কাশ্মীরি, উর্দু –পার্সি, পাঞ্জাবি, নেপালি – এই সমস্ত প্রাদেশিক রামকথার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা যায় না। বহির্ভারতীয় বিভিন্ন কাহিনির সঙ্গে রামকথার যোগ যদি ছেড়েও দিই, তাহলেও, কোন এক নির্দিষ্ট-সর্বময়-ভারতীয়-রামের ধারণা কিন্তু আমরা পাব না। আজকে যখন দেখি এক বিশিষ্ট ধর্মরাজনৈতিক শ্লোগান হয়ে উঠেছে, “এক হি নারা, এক হি নাম, জয় শ্রী রাম, জয় শ্রী রাম” - তখন প্রশ্ন করতে বড়ো সাধ জাগে, এ কোন রাম? এই রাম কি কৃত্তিবাসের না কম্বনের? নাকি এই রাম বুদ্ধ রেড্ডির রঙ্গনাথ রামায়ণের নায়ক! কন্নড় ভাষার জৈন কবি পোত্র যে ভুবনাইক রামাভ্যুদয় রচনা করেছিলেন এই রাম কি সেখানকার? নাকি এই রাম কুমুদেন্দু রামায়ণ থেকে উঠে এসেছেন? তুলসীদাস না কানহর দাস কার রাম আমাদের কাছে প্রামাণ্য ? আসলে যে বহুত্ববাদ ভারতের আঁতের কথা সেই বহুত্ববাদই পারে এমন বহুচারী এবং বহুমুখী রাম নির্মাণ করতে।
জাতীয়তাবাদ বিশেষত উগ্র এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এক জাতীর অন্তর্গত বহুত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়। এক কল্পিত ঐক্যে মুছে দিতে চায় সমস্ত বৈচিত্র্য। তাই রামকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বয়ানে প্রথমেই অস্বীকৃত হবে রামের বহুত্ব। রাম হয়ে উঠবেন এমন ‘এক’ ধর্মীয় সংবেদনা যাঁকে ব্যবহার করে হিন্দু নামক এক কল্পিত ধর্মরাজনৈতিক সত্তাকে উজ্জীবিত করা যায়, এমনকি ব্যবহার করা যায়। আবার জাতীয়তাবাদেরই লক্ষণ হিসেবে এই রাম তাঁর প্রাদেশিক রূপগুলি, রূপের স্বাতন্ত্র্যগুলি ত্যাগ করবেন। সংগত কারণেই মনে হয়, প্রাদেশিক রূপ ত্যাগ করে এইবার রাম হয়ে উঠবেন সংস্কৃতানুগ। বাল্মীকিসর্বস্ব। যেকারণেই হয়ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, যখন রামকেন্দ্রিক ধর্মীয় ন্যারেটিভ তার হিংস্রতম রূপটি প্রদর্শন করে ফেলেছে, তখন রামকে নিয়ে এক কাউন্টার ডিসকোর্স রচনার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এবং সেই কাউন্টার ডিসকোর্স মূলত রচিত হয় যে আকরের ওপর ভিত্তি করে তা, বাল্মীকির রামায়ণ। সুকুমারী ভট্টাচার্য 'বাল্মীকির রাম - ফিরে দেখা' বইয়ের প্রাক্-কথনে লিখছেন,
“২ ডিসেম্বর, ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ভাঙার পড়ে রামভক্ত সঙ্ঘ পরিবারের রামকে আরও একবার তলিয়ে দেখার বাসনা হল। আগাগোড়া খুঁটিয়ে পড়লাম রামায়ণ। সেখানে যে রামকে পেলাম তিনি বনগমন পর্যন্ত আদর্শ পুরুষ হলেও তার পড়ে তাঁর মধ্যে এমন কিছুই পাওয়া গেল না যাতে তাঁকে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ বলা যায়।...
... মূল রামায়ণের কাহিনির সঙ্গে প্রক্ষিপ্ত কাহিনিগুলিকেও গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন না করলে এই বিচার অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। মূল রামায়ণের রাম কোনও দেবতা নন, মানুষ। অথচ প্রক্ষিপ্ত অংশে বলা হল তিনি বিষ্ণুর অবতার।”
বলা বাহুল্য, সুকুমারী যে রামের কথা বলছেন, তা বাল্মীকির রাম। এবার আমাদের বিনীত প্রশ্ন, যে উন্মত্ত ধর্মান্ধ জনতা ২ ডিসেম্বর ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল তাদের কজন সংস্কৃত রামায়ণ পড়েছে! রামকেন্দ্রিক গণসংবেদনার মূলে কিন্তু কোনও সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা কাজ করে না। কাজ করে লৌকিক রামকথা। মুখে মুখে পুরুষানুক্রমে ছড়িয়ে যাওয়া রামকথা। আমাদের দেশের কালেক্টিভ সাইকিতে রাম ভগবানই। বাল্মীকি যাই লিখুন। বস্তুত, ভারতীয় গণমানসে যে রাম নিজের রাজত্ব বিস্তার করেন তিনি বাল্মীকির রাম নন। তাহলে?
হিন্দুস্থানের জাতীয়তাবাদী সত্তা প্রতিষ্ঠায় যে ভাষাকে রাজনৈতিক গুরুত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়ে আসছে অনেক কাল ধরে, তা হল হিন্দি। আমাদের দেশের আমজনতার মনে সচেতনভাবে যে কল্পিত রাষ্ট্রভাষার ধারণা বপন করা হচ্ছে, সেইটিও হিন্দি। এই নিবন্ধকার ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুলে বেসরকারিভাবে প্রচলিত একাধিক সাধারণজ্ঞান বইয়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা দেখেছেন, “হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা।” এমনকি বহু স্কুলের শিক্ষক অবধি এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার। অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ এবং ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজের পার্থক্য খুব কম মানুষ বোঝেন। হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থানের সেই বহুত্ববিনাশী প্রকল্পে হিন্দিভাষার জনপ্রিয়তম রামকথার অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠবার কথা ছিল। তা হয়ত হয়েওছে। হিন্দির জনপ্রিয়তম রামকথাকার তুলসীদাস। যদিও, তুলসীদাসের রামচরিতমানসের ভাষা প্রচলিত খড়ীবোলি হিন্দি নয়। হিন্দির অনেক আঞ্চলিক রূপ যেমন অবধী, পূর্বাঞ্চলের কথ্য ভাষা, কাশীর কথ্যভাষা, মথুরার ব্রজভাষা ছাড়াও মূল সংস্কৃত ভাষা অবলম্বনে এবং প্রচুর অপভ্রংশ শব্দ একত্রে যোজনা করে তুলসীদাস রামচরিতমানস রচনা করেছিলেন। হিন্দিবলয়ে এর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। লক্ষণীয় তুলসীদাসের লেখনীতে রাম কিন্তু সর্বাংশে দেবতা। তুলসীদাস কেবল রামচরিতমানস লেখেননি। রামাজ্ঞা প্রশ্ন, জানকীমঙ্গল, গীতাবলী, কবিতাবলী, বরবৈ রামায়ণ প্রভৃতি সমস্ত গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, তাঁর ইষ্ট দেবতা রামচন্দ্র। ফলে, এক ভক্তকবির ভক্তিকাব্য হয়ে উঠেছে তুলসীদাসী রামকেন্দ্রিক গ্রন্থগুলি। অয্যোধ্যা ও মিথিলার নর-নারী, বনের মুনি ঋষি, নিশাচর, কিষ্কিন্ধ্যার বানর বাহিনী, লঙ্কার রাক্ষসকুল -- তুলসীরামায়ণে যে-ই রামের সংস্পর্শে আসে, সে-ই তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর চরণাশ্রিত হয়। রামায়ণের যেসব ঘটনা রামের ভাগবত মহিমাবৃদ্ধির সহায়ক নয়, সেগুলিকে তুলসীদাস সযত্নে বর্জন করেন। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে বিভীষণের প্রতি ইন্দ্রজিতের ভর্ৎসনা এই রামায়ণে বর্ণিত হয় না। বালিবধ প্রসঙ্গ নেহাত অপরিহার্য তাই তুলসী দাস তার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা কেবল উল্লেখমাত্র। এবং সেই উল্লেখের অবকাশেও তুলসীদাস বারবার করে বলেন, রামের প্রতি বালির ভর্ৎসনা কেবল মৌখিক। আসলে বালির অন্তরেও রামভক্তির শিখা চিরঅনির্বাণ। শূর্পণখা প্রসঙ্গ নিয়ে কবি খুবই বিব্রত। কারণ শূর্পণখাকে ভক্তিমতী দেখালে রাম-রাবণ যুদ্ধ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আবার শূর্পণখাকে বাদ দিতে গেলেও সেই একই সমস্যা। তাই নিরুপায় তুলসীদাস মাত্র নয়টি চৌপাই ও একটি দোঁহায় শূর্পণখার কাহিনিতে কোনক্রমে যবনিকা টানেন। লক্ষণীয়, অগ্নিপরীক্ষার আগে সীতার প্রতি রামের সুপরিচিত কটূক্তির উল্লেখমাত্র তুলসীদাসে নেই। এখানে রাম তাড়কাবধের পর, তাকে নিজ পদে আশ্রয় দেন। “দীন জানি তেহি নিজপদ দিহ্না”। বস্তুত, তুলসী–রামায়ণে গল্পাংশ কম। ভক্তিভাব বেশি। সেই ভক্তিভাব প্রধানত অধ্যাত্মরামায়ণ থেকে সংগৃহীত। তুলসীদাসের রামায়ণে ব্রাহ্মণত্বের প্রতি চরম ভক্তি দেখা যায়। দুর্বাসা কবন্ধকে শাপ দিয়েছিলেন। সে রামের চরণদর্শনে শাপ মুক্ত হয়। রাম তাকে ব্রাহ্মণ সেবার মাহাত্ম্য বুঝিয়ে পরম পদ দান করেন। তুলসীদাসে মন্দোদরীর রামভক্তি বর্ণিত। সে সুন্দরকান্ড এবং যুদ্ধকান্ডে তিনবার রাবণকে রামের শরণ নিতে উপদেশ দেয়। রাক্ষসী ত্রিজটাও এখানে রামভক্ত - “রাম চরণ রতি নিপুণ বিবেকা”। বিভীষণ এখানে তপস্যা করে ধর্মবুদ্ধি চান না, চান ভগবৎভক্তি। “তেহি মাগেউ ভগবন্ত পদ”। সীতার রূপ ধারণ করে সতীর বিরহী রামকে পরীক্ষা আনন্দরামায়ণ ও ভাবার্থ রামায়ণের অনুসরণে তুলসীদাসেও আছে। যে পরীক্ষায় বলাই বাহুল্য রাম জয়ী হন। তুলসীদাসী রামায়ণে বালক রাম তাঁর মাকে আপন অদ্ভুত অখণ্ড রূপ দেখান যাঁর প্রতি রোমে কোটি ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থান- দেখ রাবা মাতহি, নিজ অদ্ভুত রূপ অখণ্ড/ রোম রোম প্রতি লাগে, কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড”।
মোটকথা, তুলসীদাসী রাম মোটেও ‘নরচন্দ্রমা’ নন। দেবতা। এখন রামের এই দেবচরিত্রই পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে কালচারাল ন্যারেটিভ থেকে হয়ে উঠবে পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ। বাল্মীকি এবং তুলসীদাসে যে রামরাজ্যের কথা আছে তাকেই মহাত্মা গান্ধী নিজের পলিটিক্যাল এজেন্ডা বানিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও গান্ধীজির রামরাজ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। গান্ধীজি স্পষ্টত বলেছিলেন, “… by Ramrajya, I do not mean Hindu Raj. For me, Ram and Rahim are one and the same deity. The ancient Ideal Ramrajya is one of the true democracy in which the meanest citizen could be sure of swift justice”. গান্ধীজির প্রিয় ভজন রঘুপতি রাঘব রাজা রামেও, সেই একই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম। রাম রহিমের একীকরণ দেখার মত উদারতা এক শ্রেণির রাজনৈতিক স্বার্থের জন্যই আজও নেই, তখনও ছিল না। হয়তো তাই এক হিন্দুর হাতেই খুন হতে হয় গান্ধীজিকে। এবং যে ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংস্কৃতি তথা ভারতীয় সংবিধানের গর্ব, এক শ্রেণির মৌলবাদ হিন্দুত্বের নির্মোকে বারবার আঘাত করে চলে সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে।
অর্থাৎ আমরা বুঝতে চাইছি কীভাবে এক সাংস্কৃতিক বয়ান ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে প্রথমে ধর্মীয় এবং পরে রাজনৈতিক বয়ান। মূল বাল্মীকি-রামায়ণে রাম দেবতা নন। পরবর্তী প্রক্ষেপে তাঁর ওপর দেবত্ব আরোপিত। এবং দেশ জুড়ে রামকথার যে বিস্তৃতি তাতেও গনমানসে রামের দেবরূপ অত্যন্ত স্পষ্ট। আর সেই সংবেদনাকে ব্যবহার করেই গড়ে ওঠে এক উগ্রজাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে রামমন্দির সংক্রান্ত বিতর্কে। 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে' –এর দাবিতে লালকৃষ্ণ আদবানির সেই কুখ্যাত রথযাত্রায়। কার্যত যার পরেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রামের নামে চলতে থাকে অসহিষ্ণুতা, হত্যা। ভারতীয় ভক্তিধারায় প্লাবিত রামনাম শোণিতস্পর্শে কলঙ্কিত হয়। কিন্তু এই রাজনৈতিক রামের সূচনা ঠিক কোথায়? গান্ধীজি রাজনীতির ক্ষেত্রে যে রামকে নিয়ে এসেছিলেন সেই রাম কিন্তু বিভেদের কথা বলত না। সেই রামকে কেন্দ্র করে এক জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় ঐক্যস্থাপন অবশ্যই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। সচেতনভাবেই তিনি তাঁর রাম ন্যারেটিভকে এক ধর্মনিরপেক্ষতার আবহ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাবা উচিত ছিল, বহুধর্মের রাষ্ট্রে কেবল একটি ধর্মের দেবতা হয়ে ওঠা সাহিত্যিক নায়ককে রাজনৈতিক গুরুত্ব দিলে সমস্যা তৈরি হবেই। তৈরি হবে এমন কিছু ন্যারেটিভ যা ধর্মীয় জাতীয়তার পালে হাওয়া লাগাতে চাইবে।
সেই ন্যারেটিভের পাথুরে প্রমাণ ১৯৫৭ সালে করপাত্রী মহারাজের “মার্ক্সবাদ ও রামরাজ্য” নামক ৮১৬ পাতার বহু বিতর্কিত গ্রন্থ। মূলে সেটি অবশ্য সংস্কৃততেই লেখা ছিল। সেই বইয়ের বিরোধিতা করেই রাহুল সাংকৃত্যায়ন লেখেন রামরাজ্য ও মার্ক্সবাদ । করপাত্রী মহারাজও এক রামরাজ্যের কথা বলেন। যদিও সেই রামরাজ্য গান্ধীজির রামরাজ্যের থেকে আলাদা। করপাত্রীর রামরাজ্য এক ধর্মনিয়ন্ত্রিত রাজ্য। এবং যে রাজ্য পরধর্ম অসহিষ্ণু। গোহত্যা বিরোধী। যে রাজ্য আসলে সত্যযুগের দিকে ফিরে যাওয়ার এক অলীক প্রচেষ্টা। নারী-শূদ্রকে দমিয়ে রেখে এমন এক ধর্মরাজ্য কায়েম যেখানে উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হয়।
১৯৯৩ এ Sheldon Pollock 'Ramayana and Political Imagination India' প্রবন্ধে দেখিয়ে ছিলেন, দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রাম কিন্তু সেইভাবে গণমানসে পূজ্য হয়ে ওঠেননি। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই হঠাৎ করে রামমন্দির নির্মাণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এই প্রবণতা চরম পরিণতি পায় ষোড়শ শতাব্দীতে। যাকে Sheldon Pollock বলছেন, “vast vernacularization of the epic”. এই সময় থেকেই প্রাদেশিক রামকথাগুলিও বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। আসলে রামায়ণ এমন এক দৈব রাজার গল্প শোনায় যে সমস্ত খারাপের ওপর জয়লাভ করতে পারে। Sheldon Pollock এর ভাষায়, রামায়ণ, “very powerful imaginative formulation of the divine king as the only being capable of combating evil”. রাবণ এই সময় থেকেই জনমানসে অপরত্ব বা otherness এর চিহ্নায়ক হয়ে উঠতে থাকে। আর হিন্দু রাজারা রামায়ণের সেই অপরত্বকে নিজেদের রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণে ব্যবহার করতে শুরু করেন। রামায়ণ তাঁদের কাছে একই সঙ্গে “theology of politics” এবং “symbology of otherness” হয়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব এবং অপরত্বের চিহ্নতত্ত্ব সমাপতিত হয়ে হিন্দুত্বের আত্মনির্মাণে কতটা সহায়ক হয়েছিল তা জানা নেই। কিন্তু Sheldon Pollock এর উদাহরণ হিসেবে দুটি মারাঠি রামায়ণের কথা বলেছেন। যার একটিতে ঔরঙ্গজেব তুলনীয় হন রাবণের সঙ্গে আর অপরটিতে কুম্ভকর্ণের সঙ্গে। স্পষ্টতই হিন্দুত্বের শত্রু হিসেবে রক্ষকুল এবং ঔরঙ্গজেবের সমাপতন অপরত্বের এমন এক পরিসর নির্মাণ করে যার মধ্যে ধীরে ধীরে অপর ধর্ম অপর রাজনৈতিক চেতনার মানুষগুলিও ঢুকে পড়তে থাকে।
রাম ভারতীয় রাজনীতিতে এর পর ক্রমেই প্রাসঙ্গিক থেকে প্রাসঙ্গিকতর হয়ে উঠেছেন। ১৯২০ সালে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে সংঘটিত আওধের কৃষক বিদ্রোহের কথা আমাদের মনে পড়বে। রামচন্দ্র যেখানে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য 'সালাম' এই সামাজিক সম্বোধনরীতিকে বদলে দিয়ে 'সীতা-রাম' চালু করেন। এই সময় থেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির আঙিনায় রাম শ্লোগান হয়ে উঠলেন। সেই সময় 'সীতা- রাম' শ্লোগানে হাজার হাজার কৃষক জমিদারের বিরুদ্ধে একত্রিত হতেন। ঐতিহাসিক দিলীপ মেনন মনে করেছেন রামচন্দ্রের কৃষক বিদ্রোহ দেখেই গান্ধীজি বুঝতে পারেন যে, রাম পলিটিক্যাল ইডিওম হিসেবে কত শক্তিশালী।
আরও পড়ুন : 'অযোধ্যার চেয়ে সত্য' / বিবস্বান দত্ত
পরবর্তীকালে ভাজপা-র বাবরি মসজিদ আন্দোলনের সময় থেকেই এক পরম অনিবার্যতায় রাম ভারতীয় রাজনীতিতে মৌলবাদের চিহ্নায়ক হয়ে উঠলেন । ১৯৯৬-এর লোকসভা ভোট থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহার বা সঙ্কল্প পত্রে একটা জিনিস কিন্তু একবারের জন্যও বদলে যায় নি। সেটা হল রামমন্দির এবং অয্যোধ্যা। এইভাবেই রাম কালচারাল ন্যারেটিভ থেকে ধীরে ধীরে রিলিজিয়াস ন্যারেটিভ এবং তারও পরে পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ হয়ে ওঠে।
এখন এই যে চিহ্নায়কের অপসারণ তা এক অনিবার্য সমস্যার জন্ম দেয়। ধর্ম যখন পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ হয়ে ওঠে তখন এক সংবিধান স্বীকৃত বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বস্তুত ধীরে ধীরে মৌলবাদের বীজভূমি হয়ে উঠতে থাকে। যে মৌলবাদ তৈরি করে নেয় এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতাকেন্দ্র। অপরত্বের চিহ্নতত্ত্বে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চায় সমস্ত বিরোধী কণ্ঠ। রামকথা ভক্তির চির অনির্বাণ ধারা। সেই ভক্তি কিন্তু অন্যের ভক্তিকে আঘাত করার কথা বলে না। রাম, ধর্ম, ভক্তি এই সমস্তই আত্মসন্ধান আত্মজাগরণ এবং আত্মনিবেদনের সাধন থেকে সরে হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অস্ত্র। সেই অস্ত্রের ধারে, ভারে, চমকে বার বার রক্তাক্ত হচ্ছে ভক্তি, ভারত এমনকি রামও। রামের নামে হত্যা ভারতে প্রবহমান রাম-সংস্কৃতিকেই বিদ্রুপ করে।
...........................
#Rammandir #Indian Politics #রামমন্দির #বিবস্বান দত্ত #silly পয়েন্ট