রেডিও শো, রাতের কল, নোংরা কথা! স্বাধীনতা চেয়ে...
যে ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য এই গণ আন্দোলন, তার দায় কি শুধু রাতের? নাকি অফিস/কর্মক্ষেত্র বা রাস্তার? রাতেই কিংবা রাস্তাতেই শুধু এমনটা হওয়ার ভয়! কয়েকটা গল্প শুনুন তবে। গল্প না বলে এগুলোকে ঘটনা বলাই ভাল। তবে আপনি গল্প ভেবে শুনতে পারেন তাহলে ভাল লাগবে। কারণ এই ‘'ছোট ঘটনা’গুলো নিয়ে আমরা কেউই বিশেষ মাথা ঘামাইনা কিনা!
বাড়ির সবাই আগেভাগেই বিয়েবাড়ি চলে গেছে। বাড়ির কিশোরী মেয়েটিরও স্কুল থেকে ফিরে সেখানে যাওয়ার কথা। তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়ে বাড়িতে শুধু থেকে গেলেন তার এক পুরুষ আত্মীয়। যিনি ইতিমধ্যেই আড়ালে-আবডালে সদ্য কিশোরী মেয়েটির দিকে থাবা মেরেছেন বারকয়েক। কিন্তু আজ? আজ মেয়েটি বাড়ি ফিরে সামগ্রিক পরিস্থিতিটা বোঝার পর, তার মনের অবস্থা কী হবে ভাবতে পারেন?
কলেজে দুই বন্ধুর খুনসুটি চলছে। ছেলেটি কী একটা নতুন জিনিস কিনে এনে দেখাচ্ছিল। মেয়েটি ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে পালিয়েছে। ছেলেটিও তার পেছনে। সোজা করিডোর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পাশের একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে ঢোকে মেয়েটি। আর কিছু পরে বেরিয়ে আসে সন্ত্রস্ত, মুখ নিচু, মাথা নিচু, দুই হাতে আগলে রাখা বুক। পেছনে ছেলেটি, তার বেহাত হওয়া জিনিস হাতে নিয়ে গর্বিত। মুখে পৈশাচিক হাসি।
রাত, রাস্তা, খুঁজে পেলেন কোথাও?
নিজের লালসা মেটাতে বিনা অনুমতিতে ইচ্ছেমতো অন্যকে ব্যবহার, অন্যের শরীরকে ব্যবহার। নিজের ক্ষমতার বলে অন্যকে একটু ‘শিক্ষা’ দেওয়া। আর তার শুরুটা ঘটে আমাদের খুব কাছ থেকেই। আমাদের কমফোর্ট জোন থেকেই।
ভয়টা তাই একা থাকা নিয়ে নয়, ভয়টা সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ায়। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। একা মানে, আমি অন্য কারও উপস্থিতি চাইছি না বা আশা করছি না। আমি একা। নিশ্চিন্ত। আর সংখ্যালঘু মানে আমি জানি আরও লোকজন আছে, যারা আমার থেকে ক্ষমতায়, শক্তিতে বড়ো এবং যখন-তখন তারা সামনে এসে শক্তি প্রদর্শন করে যেতে পারে আমার খাটো কাপড়, অনাবৃত মাথা, রাতে ঘোরাফেরার অজুহাতে। এমনকি যদি ফোনকল বা মেসেজেও সম্ভব হয়, হেনস্থা করতে ছাড়ে না।
এফএমে তখন রাত বারোটা অবধি লাইভ শো চলত। লাইভ মানে ফোন লাইনও খোলা থাকত। নানা দিন নানা বিষয় নিয়ে কথা হত শ্রোতাদের সঙ্গে, যেমনটা হয়। আর তার মধ্যে এক বা একটা দল ছিল (সঠিক জানা নেই, বিভিন্ন ফোন নম্বর থেকে কল আসত) যারা রোজই প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে থাকত ফোনে লাইন পাওয়ার জন্য। যাঁদের এফএমে কল করার অভিজ্ঞতা আছে জানবেন, একবারে কল করে পাওয়া যায় না। রাতের শোয়ের রেটিং তখন অন্য রেডিও স্টেশনগুলিকে ছাপিয়ে গেছে। কত মানুষ কত কথা-অভিজ্ঞতা শোনান ফোন করে। দিনশেষের নিরিবিলিতে, অনেকেই শান্তিতে বসে অনেক গোপন কথা, নস্ট্যালজিয়া শেয়ার করতেন। কতকিছু বলার, শোনার, জানার আছে। পরপর সেই কলগুলি রিসিভ করতে করতে কোনোটায় শোনা যেত পুরুষ কন্ঠে হেসে হেসে বমি পাওয়া কিছু চটুল কথা। যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মেয়েটিকে নিয়ে একটু মজা করা। হোক না ফোনে! প্রতিটা কল রিসিভ করার আগে, বিরক্তি আর অপমানের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম আমি! রাতের আরও এক নামী মহিলা আরজেকেও এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে শুনেছি। তিনি বিশেষ পাত্তা দিতেন না। তারপর আমিও সইতে সইতে সব ঝাল ঝেড়ে দিলাম একদিন। ওই ফোনকলেই।
ওইদিন প্রথম, স্টুডিওর চেয়ারে বসে ফোনের ওপারে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতাকে, পচা গলা একটা মানসিকতাকে তার ভাষাতেই চিৎকার করে গালি দিয়েছিলাম। তবে তাও বলব, এ ঘটনাও তো যে কোনও সময়ই ঘটতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রাতের কলকাতাকে নিয়ে কোনও ভয়াবহতা জমে নেই। আমার চোখে দেখা এ শহরের নিয়ন আলোর দ্যুতি, তারাভরা রাত বরাবরই খুব প্রিয়। অবশ্য সেই সময়ে আমার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য একজনকে মাঝরাত অবধি অফিসে থেকে যেতে হত আমার সঙ্গে। যিনি আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি যেতেন। সেক্টর ফাইভে রাতের শিফটে থাকা এক বন্ধু একবার কথায় কথায় জানিয়েছিল তাঁর ‘দুখ ভরি দাসতান’। কেন কাছে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রোজ ফিরতে দেরি হয়! আসলে অফিসের ড্রপের গাড়িতে ওইসময়ে সে একটিই ছেলে, তাই শেষ মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে তবে ফাঁকা গাড়িতে একা সে ফিরতে পারবে। অনেকটা সময় নষ্ট। অনেক অফিসে আবার এধরনের সমস্যার জন্য রাতের শিফটে মেয়েদের কম রাখা হয়। কোথাও মেয়েদেরও ছেলেদের সাথে একই টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। সেসব বড্ডই গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। এ শহরেই পার্ক স্ট্রিটের মতো ‘ছোট ঘটনা’ ঘটেছে। জেনেছি, পড়েছি। চাকরিসূত্রে একটা সময়ে মাঝরাতে বা তারও পরে বাড়ি ফিরেছি। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমায় কোনোদিন কোনও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখানে এসেই কি-বোর্ডে আঙুল থমকে গেল। ওই যে ‘সৌভাগ্যক্রমে’ লিখলাম। কাজ সেরে ঠিকঠাক অর্থাৎ সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে, নিগ্রহ-নাকাল না হয়ে আশ্রয়ে ফিরতে পারাটা কিন্তু আমিও সৌভাগ্যেই মানি, দেখলেন!
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ
অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত
চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী