সাবানের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিজ্ঞাপনে মডেলের কথা ভাবলে স্বল্পবসনা নারী কিংবা সিক্স প্যাক সংবলিত পুরুষ, এই ছবিই চোখে ভেসে ওঠে প্রথমেই। তার উপরে আবার সাবানের বিজ্ঞাপন। লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে বেলুনের মধ্যে ফেনায়িত বাথটবে শুয়ে কোনও সুন্দরী তরুণী, আর বেলুন উড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্য রাই, এমনটাই দেখতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু যদি বলা হয়, বিজ্ঞাপনের মডেল হচ্ছেন কোনও বয়স্ক পুরুষ, তাঁর আবার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, তাহলে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই ঠেকে, তাই না? কিন্তু ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল এই বিজ্ঞাপনটির ক্ষেত্রে। এখানে মডেল হয়েছিলেন আর কেউ নন, খোদ রবীন্দ্রনাথ।
দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের জোয়ার আসেনি তখনও। তাই টিভির পর্দায় নয়, কাগজের পাতায় দেখা গিয়েছিল এই বিজ্ঞাপন। ছাপানো হয়েছিল লিফলেট। আর তাতে দেখা গিয়েছিল, একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের সাবানকে শংসাপত্র দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলছেন, তাঁর জ্ঞানমতে এই সাবানের চেয়ে ভালো কোনও বিদেশি সাবান নেই। ইংরেজিতে লেখা এই উক্তির পাশে কবির শান্ত, সৌম্য ছবি। হাত দুটি কোলের উপরে জড়ো করা। পরনে চিরাচরিত জোব্বা। বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানোর জন্য তাঁর সাজসজ্জা কিংবা আচার আচরণে বিন্দুমাত্র বদল ঘটেনি। কারণ এই বিজ্ঞাপন তো কোনোরকম আর্থিক লাভ কিংবা খ্যাতির লোভে করছেন না তিনি। এই বিজ্ঞাপনে তিনি অংশ নিয়েছেন এক বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ওই সময়ের সমস্ত লেখালিখি, সব বক্তব্যের মধ্যে যে কথাটি রয়ে গিয়েছে, তাকে প্রকাশ করারই আরেকটা পথ যেন খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই পথ হয়ে উঠেছে এইসব বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন।
বাণিজ্যিক বললে বোধহয় সবটুকু বলা হয় না। হ্যাঁ, বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভের উদ্দেশ্য নিয়েই সংস্থাগুলি পথে নেমেছিল এ কথা ঠিক। কিন্তু সে বাণিজ্যের সঙ্গে কোথাও জুড়ে গিয়েছিল দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদও। বণিকের মানদণ্ডই তো একদিন এ দেশে রাজদণ্ডের রূপ নিয়েছিল। তখন থেকেই দেশের বাণিজ্যক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল তারা। এ দেশ থেকেই সংগ্রহ করেছে কাঁচামাল, অর্থ, শ্রমিক— এককথায় পণ্য উৎপাদনের সব উপকরণ, আর তারপরে সেই পণ্য বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে এ দেশের বাজার থেকেই। সেই বিদেশি বণিকদের সঙ্গেই পাল্লা দিতে নেমেছিল সামান্য কয়েকটি দেশীয় সংস্থা। গোদরেজ তাদেরই অন্যতম। স্প্রিং ছাড়া তালা, টাইপরাইটার, রেফ্রিজারেটর, নির্বাচনের ব্যালট বক্স, এমন একাধিক জিনিস ভারতে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই সংস্থার হাত ধরেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্র ধরে জোয়ার এল এই স্বদেশি ব্যবসায়। একদিকে বিলিতি পণ্য বয়কট, আরেকদিকে দেশি পণ্য উৎপাদনে জোর পড়ল। বলাই বাহুল্য, এই সময়ের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথও। তবে ভাঙায় তাঁর আগ্রহ যতটা, তার চেয়েও বেশি তিনি গড়ার পথের পথিক। আর সেই কারণেই বারবার নিজের কথায়, লেখায় দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার কথা বলে চলেছিলেন তিনি। যেসব সংস্থা সেই সময় এহেন উদ্যোগ নিয়েছিল, তাদের হয়ে স্বদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে কোনও দ্বিধা ছিল না তাঁর। মনে করা হয়, এমন অন্তত শ-খানেক বিজ্ঞাপনে তাঁকে দেখা গিয়েছিল। আর সেইসব বিজ্ঞাপনের মধ্যেই একটি ছিল গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপন।
স্বদেশি সাবানের ব্যবসা প্রথম শুরু করেছিলেন মহীশূররাজ কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার, তার বছর দুই পর এই ব্যবসা খোলে টাটা গোষ্ঠীও। সেই বছরেই, অর্থাৎ ১৯১৮ সালে আর্দেশির এবং পিরোজশা গোদরেজ নাম লেখালেন সাবানের ব্যবসায়। কিন্তু বাজারে টিকে থাকার জন্য এক অভিনব উপায় খুঁজে নিলেন তাঁরা। সেই সময়ে সাবানের অন্যতম উপকরণ ছিল পশুর চর্বি। এর আগেই বন্দুকের টোটায় পশুর চর্বি আছে এই সন্দেহ থেকে একটা গোটা মহাবিদ্রোহ দেখেছে ভারত। সুতরাং জাত যাওয়ার ভয়ে সাবান ছুঁয়ে দেখত না দেশের অধিকাংশ মানুষই। এই বিশাল বাজার ধরাই ছিল গোদরেজ সংস্থার লক্ষ্য। দেশীয় বাজারে প্রথম চর্বিমুক্ত সাবান নিয়ে আসে এই সংস্থাই। গান্ধীবাদের সেই যুগে অহিংসার বাণীর সঙ্গে নিজেদের পণ্যকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন গোদরেজ কর্তৃপক্ষ। ‘চাভি’ নামে এই ব্র্যান্ডের প্রথম পর্বের সাবানগুলির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নম্বর টু’, বিজ্ঞাপন করা হয়েছিল অ্যানি বেসান্ত ও রাজাগোপালাচারিকে নিয়ে। এর জনপ্রিয়তার দরুন দ্বিতীয় পর্বে তৈরি হওয়া ‘নম্বর ওয়ান’ সাবানটিকে নিয়ে আরও বড় পরিকল্পনা করে গোদরেজ। সেই সাবানটির বিজ্ঞাপন করা হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, গোটা দেশ তথা বিশ্বের কাছেও যিনি তখন অন্যতম চেনা মুখ। ১৯২২ সালে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই বিজ্ঞাপন। চর্বিমুক্ত সাবানকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ। লাভের মুখ দেখেছিল সংস্থাও।
...............