উপন্যাস

আখ্যানের খোঁজ (দ্বাদশ পর্ব)

বিবস্বান July 21, 2024 at 4:47 am উপন্যাস

একাদশ পর্বের পর

........................

২৫. 


জঙ্গলে সন্ধে খুব তাড়াতাড়ি নামে। মাধবী খবরে পড়েছিল কলকাতা থেকে নাকি বৃষ্টি হারিয়ে গেছে। ঋতুচক্র থেকে চুরি হয়ে গেছে আরেকটা গোটা ঋতু। অথচ সেই বৃষ্টিই ভাসিয়ে দিচ্ছে চিলাপাতার জঙ্গল। আজ টানা ষোলো দিন, বর্ষার বিরাম নেই। 

এই পৃথিবীর এক প্রান্তের হারিয়ে যাওয়া জিনিস ভেসে ওঠে অন্য প্রান্তে। কোনও কিছুই চিরতরে হারিয়ে যায় না। মানুষের জীবন থেকে মানুষ চলে যায় ঠিকই। কিন্তু স্মৃতি থেকে যায়। সেই স্মৃতি জমতে জমতে তৈরি করেছে এক অন্য পৃথিবী। ঘুমের দরজা ঠেলে সেই আবছায়া পৃথিবীতে ঢুকতে হয়। এইরকম অনেক পৃথিবী আছে আমাদের পৃথিবীর ভেতর। কোনটার দরজা কখন খোলে, কে জানে?

পাহাড়ে এসে মাধবী পাহাড়ের মানুষ হয়ে গেছে। স্কোয়াশের তরকারি দিয়ে ভাত খায়। প্রাত্যহিক নেশার জন্য ঘরে রাখা থাকে তোম্বা। বাঁশের পাত্রের মধ্যে সেই বীজ দিয়ে ঢেলে দিতে হয় গরম জল। তারপর কাঠের পাইপ দিয়ে দিয়ে ঈষদুষ্ণ তরল মদ টেনে নিতে হয় ভেতরে। 

তখুনি পাহাড়ে মেঘ আসেন। কুয়াশা ঢেকে দেয় গহিন জঙ্গল। আবছা স্মৃতির মানুষদের অবয়ব দেখা যায়। ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফেলে আসা চুম্বন। শরীর অস্থির হয়। সমস্ত সত্তা যেন মিশে যায় কুয়াশার পাহাড়ে।

অবশ্য আজ জঙ্গলে সন্ধে নামার পর মাধবী তোম্বা খায়নি। এক বন্ধু এসেছিল পাহাড়ে বেড়াতে। শহর থেকে নিয়ে এসেছিল মাধবীর প্রিয় রাম। টু ইন্ডিজ। অম্রুতের। আজ সেই কড়া হোমিওপ্যাথির ওষুধের স্বাদ চারিয়ে যাচ্ছে মাধবীর মাথায়। সঙ্গে ঝাল ঝাল করে রান্না করা কালো তিল দিয়ে শুয়োরের মাংস। আজ নেশাটা নিশ্ছিদ্র হওয়া বড়ো দরকার মাধবীর। 

খবরের কাগজে শুধু কলকাতা থেকে বৃষ্টি হারিয়ে যাওয়ার খবর ছিল না। ছিল কলকাতা মেট্রোতে আত্মহননেচ্ছু এক যুবকের খবর। রেল পুলিশের তৎপরতা যাকে ফিরিয়ে এনেছে খাদের ধার থেকে। মাত্র একটা লাফ দিয়েই সে চলে যাচ্ছিল আরেক পৃথিবীতে। সেই পৃথিবীর দরজাখানা একটু ফাঁক হয়েছিল। আর সেই ফাঁক দিয়ে ছেলেটির মুখে পড়ছিল আলো অথবা অন্ধকার। তক্ষুনি রেলপুলিশের লোক পেছন থেকে জাপটে ধরে ছেলেটিকে। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। 

আখ্যান ফুরিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ করেই। একটা গল্প পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যে এত ভালো লেগে যায় যে মনে হয় আর কোনোদিন শেষ না হোক। তারপর একদিন গল্পের সমস্ত চরিত্ররা হারিয়ে যায়। গল্পের থেকে সরে যায় প্লট। আখ্যান শেষ হয়। 

অথচ এই পৃথিবীর কোনও আখ্যান কোনোদিন শেষ হয়নি। পাঠকের মাথার ভেতর সে ছড়িয়ে গেছে। কত মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে তাদের অজান্তেই। 

আমাদের আখ্যান কবে যে মাধবীর জীবনের অংশ হয়ে গেছে, মাধবী বুঝতে পারেনি। মহাকাব্যের মেয়ে সে। এক অপার্থিব দার্ঢ্য জুড়ে আছে তার সমস্ত দেহে। সেই মেয়ে যখন দেখল একলা আখ্যান ছুটে বেড়াচ্ছে কলকাতা শহরের এক ক্যালেন্ডার থেকে অন্য ক্যালেন্ডারে, মায়া হল। বড়ো মায়া। সঙ্গে সঙ্গে মহাকাব্যের আলো সরে গেল মাধবীর শরীর থেকে। জঙ্গলে কুয়াশা ঘনাল। 

আর ঠিক সেই সময়েই বেজে উঠেছিল মাধবীর ফোন। মেয়েকে খুব ভয় পাওয়া যযাতি খুব ভয় নিয়েই ফোন করেছিলেন মেয়েকে। ফোনটা তাঁকে করতেই হত। এতদিন যে ঘর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আটকেছিল দুই পৃথিবীর মাঝখানে অবশেষে সেই ঘরে আখ্যান আসছে। সময়ের ভাঙা মন্দিরে জেগে উঠেছে জাগপ্রদীপের আলো। প্রচণ্ড ঢাক বাজছে যযাতির মাথার ভেতরে। ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সমস্ত স্নায়ু। স্মৃতির দরজা একেবারে বন্ধ হওয়ার আগে ব্যর্থ পিতা যেন শেষবারের মতো শুনতে চান এক ডুবে যাওয়া গলা। ফেলে আসা স্বর। 

কলকাতায় সন্ধে নামছে। স্ট্রিট লাইটের আলো মিশে যাচ্ছে দিনের শেষ আভার সঙ্গে। যযাতির গলা সেই বিষণ্ণ কলকাতাকে এলে দিল মাধবীর সামনে। মাধবী দেখতে পেল অনন্ত চাকরির শেষে ক্লান্ত যুবক হেঁটে যাচ্ছে কলকাতা দিয়ে। চুল উসকোখুসকো। চোখের তলায় কালি। প্রচণ্ড ভয়ের চোখ সতর্কভাবে ইতিউতি চাইছে। ভীষণ রাগী সাপের দল যেন তাড়া করেছে তাকে। আখ্যান ছুটতে শুরু করল। 

আখ্যান ছুটছে। ছুটছে আর ছুটছে।



২৬.


-ইট’জ আ ক্লিয়ার কেস অফ স্কিৎজোফ্রেনিয়া। আসলে আমাদের এক এক জনের কাছে বাস্তব তো একেক রকম। এই পৃথিবীর দুটো মানুষের বাস্তব সম্পর্কে ধারণা কখনও এক নয়। কোনও কোনও মানুষের বাস্তব এতটাই অন্যরকম হয় যে তারা আর এই পৃথিবীটার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। বা বলা ভালো আমরা আর তাদের পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারি না। 

চশমাটা চোখের থেকে খুলে আমার দিকে তাকালেন ড. দাস। মনে হল, বিকেলের পিঠে হেলান দিয়ে কেউ নিজের দুচোখের বিষণ্ণ জাল ছুঁড়ে দিল আরেক সমুদ্রচোখে। ড. দাস কলকাতা শহরের নামকরা মনোবিদ। আজ আমি তাঁর কাছেই এসেছি আমার ভীষণ কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে। 

আখ্যান। আখ্যান দত্ত। প্রেসিডেন্সিতে আমরা একইসঙ্গে পড়েছি পাঁচটা বছর। আখ্যান আমার কাছের বন্ধু। তার ওপর আমাদের পদবি এক বলে, কলেজে আমাদের সবাই দুই ভাই বলত। আমি, আখ্যান, রণিতা, সৃজিত, মিছিল, শৌভিক, মাধবী আমরা একইসঙ্গে থাকতাম সবসময়। একসঙ্গে ক্লাস। পড়াশুনা। লাইব্রেরি। নোট তৈরি। তারপর যা হয়। কলেজ শেষ হল। যে যার মতো ছিটকে গেলাম। এখন আর বিশেষ যোগাযোগ নেই কারও সঙ্গেই। অনেকদিন পর আখ্যানের খবরটা কাগজে পড়ে মাধবী আমায় ফোন করে। আখ্যান সুইসাইড করতে গেছিল। আজ তাই আমি নিজে এসেছি আখ্যানের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। 

-স্কিৎজোফ্রেনিক মানুষেরা যে সব সময় সুইসাইডাল হবেন তা নয়। কখনও কখনও কেউ কেউ হয়ে পড়েন। তবে আমার মনে হয় আপনার বন্ধু ঠিক সুইসাইডাল নন। উনি একটা অল্টারনেটিভ রিয়েলিটিতে বাঁচেন। এমনিতে চিন্তার কিছু নেই। ওষুধগুলো যা দিয়েছি সব কন্টিনিউ করতে হবে।

শান্ত হেসে ডাক্তার বললেন।  

আমি আখ্যানকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ক্রিস্টাল মাইন্ড থেকে। যে বন্ধুরা একসময় মা বাবার থেকেও বেশি কাছের ছিল, তারা কবে যে এত দূরে সরে গেল! খবরের কাগজ পড়ে তাদের কথা জানতে হয়। রোজকার স্কুল, পিএইচডির কাজ এইসবের মাঝখানে আমিও তো কারও সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখতে পারিনি। বন্ধুরাও পারেনি। তবু কোনও বিপদ-আপদ এলে আমরা একে অন্যের পাশে থাকার চেষ্টা করি। 

এই যেমন মাধবীও এক ভীষণ পারিবারিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ওর বাবা মারা গেছেন। রণিতা, সৃজিত, মিছিল সবাই গিয়েছে ওর বাড়িতে। শৌভিক অবশ্য অফিস থেকে ছুটি পায়নি। আমি একাই আখ্যানকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এলাম। 

আখ্যান কিন্তু এমনিতে বেশ স্বাভাবিক। এই যেমন এখনই একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছে আমার পাশ দিয়ে। 

-কীরে বিবস্বান, থিসিস তো জমা দেওয়া হয়ে গেল। ডিফেন্স কবে?

সিগারেটের ছাই ঝেড়ে প্রশ্ন করে আখ্যান। মহানির্বাণ রোড দিয়ে আমরা হেঁটে আসছি রাসবিহারী অ্যাভিনিউর দিকে। এইবারে বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে কলকাতায়। খানিকক্ষণ আগে অবশ্য এক পশলা হয়েছে। রাস্তাগুলো ভিজে। সেইদিকে তাকিয়ে আমি আখ্যানকে বললাম যে কবে ডিফেন্স সেটা আমি বা আমার গাইড কেউই জানি না। 

-কেউ কিছু জানে না। তবু খুঁজে যেতে হয়। খুঁজে যাওয়া ছাড়া আমরা আর কীই বা করতে পারি বল। এই যে দ্যাখ, কলকাতার এত এত মানুষ, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু খুঁজছে। 

আখ্যানের কথা খুব একটা অস্বাভাবিক লাগল না আমার । সেই কলেজবেলা থেকেই ও এই রকম দার্শনিক কথাবার্তা বলত। ডি বেস আঁতেল যাকে বলে। পড়াশুনায় এত ভালো ছিল। হঠাৎ করে কী যে হল! 

আখ্যানকে আজ একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। ওর শরীরটাও ভালো নেই। এই অবস্থায় একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। ইন ড্রাইভার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আখ্যান বলল যে একটু হেঁটে তারপর ট্যাক্সি করতে। ছোটোবেলা থেকেই আমরা হাঁটতে ভালোবাসি। আমরা বন্ধুরা মিলে তো পায়ে পায়েই চষে বেরিয়েছি কলকাতা। ট্যাক্সির কথা কেউ ভাবতেও পারতাম না। হাঁটতে হাঁটতেই আমাদের শহর চেনা। তাই আখ্যানের কথায় আমি আর না বলিনি।

এদিকে রাসবিহারী এভিনিউতে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল। বাধ্য হয়েই উঠে বসলাম একটা হলুদ ট্যাক্সিতে। খুব তাড়াতাড়ি এইসব ট্যাক্সি কমে আসছে কলকাতা থেকে। এখনও অবশ্য পুরোপুরি ডোডোপাখি হয়ে যায়নি। মাঝেমধ্যে হলুদ ট্যাক্সি আর ধূসর জামাপরা ট্যাক্সি ড্রাইভার, দুইয়েরই দেখা মেলে কলকাতায়। যদিও কোনওদিনই তাদের কোথাও যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে দেখিনি। নো রিফিউজাল লেখা থাকে বটে। কিন্তু এঁরা মেজাজে চলেন। ইচ্ছে না হলে খুব একটা প্যাসেঞ্জার নেন না। 

আর নিলেও মিটারে চলেন না। আজকেই যেরকম, ধর্মতলা পর্যন্ত সটান পাঁচশো টাকা চাইল। একটু দরাদরি করে সাড়ে চারশোয় রফা। বেশি নিচ্ছে। কিন্তু কী আর করা যাবে। ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। আর বৃষ্টি এলেই কলকাতা শহরের সমস্ত অ্যাপ ক্যাব একইসঙ্গে মহার্ঘ্য এবং ডুমুরের ফুল হয়ে যায়। 

অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আখ্যানের বাড়ি। বেশ ভিজেছি দুজনেই। আখ্যানই বলল, জামাটা বদলে যা। ভুঁড়ি অনেকটা বাড়িয়েছিস বটে, কিন্তু এখনও মনে হয় আমার জামা তোর গায়ে হয়ে যাবে। 

কথাটা সত্যি। প্রেসিডেন্সির সময় থেকেই আমাদের এক সাইজ। একে অন্যের জামা কতবার যে পরেছি তার ইয়ত্তা নেই। আমার আবার সর্দির ধাত। অল্প ভেজাতেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাই আমি ঢুকেই পড়লাম আখ্যানের বাড়িতে। 

আখ্যানের মা খুবই খুশি হলেন আমায় দেখে। অনেকদিন পর দেখা। সেই কলেজের সময়ে। তখন দলবেঁধে আখ্যানের বাড়ি যেতাম আমরা। তখন অবশ্য আখ্যান ওদের পুরনো বাড়িতে থাকত। সদ্য উঠে এসেছে নতুন ফ্ল্যাটে। এইখানে আমার আগে আসা হয়নি। প্রচুর আইনি ঝামেলা করে এই ফ্ল্যাটের পজেশন মিলেছে। এইসমস্ত গল্প করছিলেন কাকিমা। আখ্যানের জন্য কান্নাকাটিও করছিলেন। ততক্ষণে আমি জামা বদলে নিয়েছি। আখ্যান এসেই নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। 

কাকিমা বললেন, যাও তুমি তোমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করো। আমি তোমাদের চা করে দিচ্ছি। 

তখন বৃষ্টির দাপট প্রচণ্ড বেড়েছে বাইরে। শহর কলকাতা ছেয়ে ফেলেছে ইন্দ্রমেঘ। অনেক দিনের জমানো বৃষ্টির ঘাটতি যেন কয়েক নিমেষে পূরণ হয়ে যাবে। প্রচণ্ড বাজ পড়ছে। আওয়াজে তালা লেগে যাচ্ছে কানে।

এই বৃষ্টির দিনে আখ্যানের জামা পরে আমি ঢুকে পড়লাম আখ্যানের ঘরে। 



২৭.


একটা তীব্র ছাতিম ফুলের গন্ধ। আখ্যানের ঘরের একটা জানলার ঠিক বাইরেই ছাতিম গাছ। খুবই কাছে। এতটাই কাছে যে মনে হয় যেকোনও সময় ঘরে ঢুকে পড়বে। ছাতিমের গন্ধ যে এত তীব্র হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। দরজা খুলতেই আমার ওপর সেই গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেন কবেকার ক্ষুধার্ত বাঘ গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করছিল এই ঘরের ভেতর। শিকারের দেখা পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। 

-বাবা! এ তো একদম ঢুকে এসেছে ঘরের ভেতর! 

গাছের দিকে তাকিয়ে আমি আখ্যানকে বললাম। ঘরের আরেকটা জানলার ধারে তখন আখ্যান দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে আমায় বলল, ওদেরই তো ঘর। 

শালা আবার পোস্ট-হিউম্যানিজম কপচাতে না শুরু করে। সেই কলেজবেলা থেকেই তো দেখছি। যেখানে সেখানে থিওরি গুঁজে দেওয়া ছিল আখ্যানের স্বভাব। এখনও কি সেই স্বভাব আছে? 

ঘরের চারপাশ জুড়ে বেশ কিছু স্নেক প্ল্যান্ট। আখ্যানের গাছের শখ ছিল আমি জানতাম। কিন্তু এত তেজি স্নেক প্ল্যান্ট আমি অন্তত আগে দেখিনি। মনে হচ্ছে কত শতাব্দী আগের মরে যাওয়া গাছেদের শিকড় আখ্যানের টেবিল ফুঁড়ে উঠে এসেছে এইখানে। তাদের শরীরে লেপটে আছে রাগী সবুজ সাপেদের দল। অন্য এক পৃথিবীর দরজা যেন হাট হয়ে আছে এইখানে। 

ঘরের মধ্যে হালকা হলুদ আলো। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দ। এ যেন এক অন্য কলকাতা। অন্য সময় থেকে উঠে আসা। আমার চেনা কলকাতায় কোনও ঘর এমন থাকতে পারে না। এত স্যাঁতস্যাঁতে! যেন ঘরটা রয়েছে মাটির নীচে। দেওয়াল দিয়ে চুঁইয়ে আসছে জল। ছাতিমের গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কবেকার সোঁদা মাটির গন্ধ। দেওয়ালের কোনা দিয়ে শ্যাওলা উঁকি মারছে। কলকাতা এই মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে আশ্চর্য বৃষ্টিতে। রাস্তায় জল জমছে। মেঘ এতটাই ঘন হয়ে এসেছে যে বোঝা যাচ্ছে না দিন না সন্ধে। কলকাতার সমস্ত মানুষ এখন নিজস্ব বিবরে। কোনও এক সরীসৃপজন্ম কি গ্রাস করল ওদের? নাহলে দিনের ঠিক মাঝখানটায়, সে যতই বৃষ্টি হোক, কলকাতা কি এমন ফাঁকা হয় কখনও?

এ যেন এক পরিত্যক্ত শহর। এক অন্য মেসোপটেমিয়া। সভ্যতার কিছু চিহ্ন রেখে সমস্ত মানুষ উবে গেল। আর এক অভিমানী শহর ডুবে গেল মেঘভাঙা জলে। 

-বিবস্বান, কেমন দেখছিস আমার নতুন ঘর? 

কত শতাব্দীর ওপার থেকে ভেসে এল আখ্যানের গলা।  

কেমন দেখলাম আমি? 

মেঝেতে চকমেলানো সাদা কালো খোপের টাইলস। দেওয়ালের রঙ নীল। কাঠের জানলা। কালো পালঙ্ক। একটা রিডিং ডেস্ক। একটা আরাম কেদারা। ওপর থেকে ঝোলানো হ্যাঙ্গিং লাইট। পালঙ্কের ওপরের দেওয়ালে তিনটে ফটো ফ্রেম। সেইখানে তিনটে তাসের ছবি। 

হরতন রুইতন আর ইস্কাবন…


…                                      …                               …


ঘরের মধ্যে একটা জানলা দিয়ে আখ্যান তাকিয়ে রয়েছে কলকাতার দিকে। কোনও অন্য পৃথিবী থেকে অলীক অপার্থিব মৃদু এক আলো এসে পড়ছে তার মুখে। ভাবলেশহীন, নিস্পৃহ সেই মুখ। সেইখানে বাসা বেঁধেছে কবেকার মেঘ। মরা মাছের মতো দুটো চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে আছে কলকাতার দিকে। 


তার খোঁজ এখনও জারি?


(সমাপ্ত) 

.................. 

[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]  


আগের পর্ব পড়ুন : আখ্যানের খোঁজ (একাদশ পর্ব)

#ধারাবাহিক উপন্যাস #বাংলা উপন্যাস #আখ্যানের খোঁজ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

54

Unique Visitors

204987