বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্রের ছাত্রেরা, প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্রেরা

অর্পণ পাল Sep 5, 2020 at 11:52 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

উনিশ শতকের শেষ লগ্ন। লন্ডনে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বিক্রমপুরের ছেলেটি ফিরে এল পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে। তার কর্মজীবন শুরু হল প্রেসিডেন্সি কলেজে, কম মাইনের অধ্যাপক হিসেবে। এই অধ্যাপকই পরে আন্দোলন করে মাইনে বাড়াতে বাধ্য করেন ব্রিটিশ সরকারকে। প্রায় সমসময়ে এখানে অধ্যাপনায় যোগ দেন আর এক বিলেতফেরত স্বদেশিমনোভাবাপন্ন তরুণ, পরবর্তীকালে অধ্যাপনার পাশাপাশি দেশের কাজে যিনি জড়িয়ে থাকবেন সমান মনোযোগ নিয়েই। মূলত এই দু-জনের উদ্যমেই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উঠে এলেন এক ঝাঁক নতুন বিজ্ঞানী। পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার যে জোয়ার আসবে বিশ শতকের শুরুর দশকগুলোয়, এই দুই মানুষের হাতেই তার শুভ সূচনা।

প্রেসিডেন্সি কলেজের এই দুই অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রত্যক্ষ ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে নামডাক যে দু-জনের, তাঁরা অবশ্যই সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর মেঘনাদ সাহা। যদিও দু-জনেই প্রিয় শিক্ষকদের গবেষণা-বিষয়ের (প্রথমজনের জীব-পদার্থবিদ্যা, দ্বিতীয়জনের রসায়ন) সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্যতর জগতের কাজে (কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর আণবিক পদার্থবিদ্যা) প্রখর পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন ছাত্রদশা-পরবর্তী জীবনে। 

ক্লাসরুমে সত্যেন্দ্রনাথের উপদ্রব আর কূটপ্রশ্নের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে বসিয়ে রাখতেন নিজের টেবিলের পাশের একটা ছোট টুলে। দুষ্টুমিতে কম যেতেন না সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদের কেউই। প্রথমজন খাঁটি কলকাত্তাইয়া, উত্তর কলকাতার ঈশ্বর মিল লেনে বাপ-ঠাকুরদার বিরাট বাড়ি। অন্যজন বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁ থেকে আসা ছাত্র। প্রথমজন নিজের বাড়ি থেকেই কলেজে আসা-যাওয়া করলেও দ্বিতীয়জন থাকতেন হিন্দু হোস্টেলে, সেখানে জাতপাত নিয়ে গোঁড়ামির কুফল তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে একাধিকবার। এই কারণেই হয়তো, নিতান্ত জেদের বশে এই মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন অদম্য, ভয়ডরহীন এক আধুনিক মানুষ। অন্যদিকে প্রথমজন অল্পবয়স থেকেই একটু অন্যরকম, বিজ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর বিশেষ আগ্রহ সঙ্গীত সাহিত্য আর আড্ডার প্রতি। কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যময় সেই পরিমণ্ডল থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন সারাজীবনের পাথেয়। বিজ্ঞানী সত্তার বাইরে পরিচিতি পেয়েছে তাঁর রসজ্ঞ সত্তাটিও।  

প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়ে পড়াশুনোতেও দু-জনে সংযুক্ত থেকেছেন বরাবর— ১৯১১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হন সত্যেন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় মাণিকলাল দে, তৃতীয় মেঘনাদ। প্রথম আর তৃতীয়জন এর বছর চারেক পরে বিএসসিতে মিশ্র গণিতের অনার্সে যথাক্রমে প্রথম আর দ্বিতীয় হলেন। সারাজীবনের জন্যই দুটো নাম যেন একীভূত হয়ে গেল বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার উজ্জ্বল কালপ্রবাহে।  


নজরে থাকুক


বারবারা ম্যাক্লিনটক ও সমকালীন পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞানচর্চা


এমএসসি পাশের পর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ডাকে সদ্যস্থাপিত রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে মিশ্রগণিত বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দিলেন সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদ। এরপরে তাঁরা নিজেদের চেষ্টায় আধুনিক পদার্থবিদ্যার চর্চা শুরু করলেন নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করবার তাগিদে। জোগাড় করলেন জার্মান ভাষার বইপত্র, আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে অনুমতি নিয়ে নিজেরাই সরাসরি জার্মান থেকে অনুবাদ করলেন তাঁর লেখা মূল আপেক্ষিকতাবাদের বই; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বই প্রকাশিতও হল। পরে জানা গেল, সেটাই পৃথিবীতে প্রথম আপেক্ষিকতাবাদের ইংরাজি-অনুবাদ। 

পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণা চালিয়ে যাওয়া যে খুব জরুরি, দু-জনেই বুঝেছিলেন ভাগ্যিস। শুধু ছাত্র পড়িয়ে গেলে কি আর তাঁদের আমরা ততটা চিনতাম, যেমনটা চিনতে পারি এখন? প্রথমদিকে যুগ্মভাবে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেও আস্তে আস্তে তাঁদের আগ্রহের জায়গা গেল আলাদা হয়ে। সত্যেন্দ্রনাথ বেছে নিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগৎ, মেঘনাদ চলে গেলেন তাপীয়-আয়ননবাদের দিকে। পরে দু-জনেই নিজের ক্ষেত্রে শিখরে পৌঁছেছিলেন। অধ্যাপনার ক্ষেত্র  হিসেবেও দু-জনে বেছে নিলেন আলাদা দুটি স্থান— সত্যেন্দ্রনাথ চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেঘনাদ এলাহাবাদে। প্রবাসে (ঢাকা যদিও তখন বাংলাপ্রদেশেরই অন্তর্গত, তাকে ঠিক প্রবাস বলা চলে না, তবু কলকাতাকেন্দ্রিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্নতাকে এক হিসেবে প্রবাস বলাই চলে) দু-জনে লেগে পড়লেন যোগ্য ছাত্র-নির্মাণের কাজে। 

মেঘনাদের কাজের ক্ষেত্র সূর্যের তাপীয় আয়নন। যথেষ্ট পরিচিতি পেলেন তিনি। আর সত্যেন্দ্রনাথ প্ল্যাঙ্কের শক্তি নির্গমন নিয়ে তরুণ বয়সেই একটি গবেষণাপত্র লিখে আইনস্টাইনের নজরে পড়লেন। তাঁর সেই লেখা ছাপা হল আইনস্টাইনের মন্তব্যসহ। পরে যে কাজটি পরিচিতি পাবে সত্যেন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন দু-জনের নামের সঙ্গে জড়িয়েই। দুটো কাজই প্রখরভাবে আন্তর্জাতিকমানের, তবু অজ্ঞাত কারণে দু-জনের কেউই কাজের স্বীকৃতিতে  নোবেল পেলেন না। মেঘনাদ তিন-তিনবার মনোনীত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গেই মনোনয়ন পাওয়া চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন একবার পেয়ে গেলেন সে পুরস্কার; অথচ তাঁর কপালে জোটেনি সেই সম্মাননা। মেঘনাদের কাজকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন ঠাঁই দিয়েছিলেন গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর সংঘটিত শ্রেষ্ঠ দশটা জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত আবিষ্কারের মধ্যে, আর সত্যেন্দ্রনাথের নামেই আজ পৃথিবীর এক জাতের যাবতীয় কণার নাম ‘বোসন’। সত্যেন্দ্রনাথের কাজের ওপরে ভিত্তি করেই নোবেল পেয়েছেন একাধিক বিজ্ঞানী, একাধিকবারই। আমাদের মনে পড়বে হয়তো, ২০১৩ সালে সত্যেন্দ্রনাথের নামে নির্ধারিত এই বিশেষ জাতের কণা কীভাবে পদার্থের ভর জোগায় তা নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন ফ্রাসোঁয়া ইংলার্ট আর পিটার হিগস। এই কি আমাদের সান্ত্বনার কারণ হিসেবে যথেষ্ট বলে ভাবতে পারি?  

সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদ বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। তবে তাঁদের সঙ্গে  প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে তৈরি অন্য ছাত্রদের কথা উল্লেখ না করাটা খুবই অন্যায় হবে। আমরা সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদের নামের সঙ্গে (কাজের কথা বাদই দিলাম) কিছুটা পরিচিত হলেও এঁদের নাম একাডেমিক পরিসরের বাইরে সেভাবে মোটেই উল্লিখিত হয় না। প্রফুল্লচন্দ্রের প্রিয় ছাত্র এবং মেঘনাদ সাহার কাছের বন্ধু রসায়নবিদ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন সদ্য স্থাপিত হওয়া আইআইটি খড়গপুরের অধ্যক্ষ। জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন কালাজ্বরের ওষুধ বানিয়ে। রসায়নবিদ নীলরতন ধর একাধিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন সক্রিয়ভাবে। অসীমা চট্টোপাধ্যায় সংযোগ ঘটিয়েছেন উদ্ভিদবিদ্যার সঙ্গে রসায়নশাস্ত্রের (যদিও ইনি প্রফুল্লচন্দ্রকে পেয়েছিলেন কিছু পরে, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পড়বার সময়)— এঁদের পাশাপাশি উল্লেখ করা যায় গোপাল চক্রবর্তী, রসিকলাল দত্ত, পুলিনবিহারী সরকার, সুশীল মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বা বীরেশচন্দ্র গুহর নামও। এঁদের অনেকেই গবেষণা-কাজে সক্রিয় সাহায্য পেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের। 

দুঃখের ব্যাপার, জগদীশচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত কাজকে (জীবপদার্থবিদ্যা বা উদ্ভিদশারীরবিদ্যার অন্তর্গত) সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম এমন কোনও ছাত্রগোষ্ঠী বা গবেষকদল তৈরি করতে পারেননি। যদিও বসু বিজ্ঞান মন্দির তৈরি করে জ্ঞানচর্চার দিগন্ত খুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। অস্বীকার করবার জায়গা নেই যে ভারতীয় বিজ্ঞানের এই দুই প্রধান স্তম্ভ তাঁদের ছাত্রদের যথেষ্ট সহমর্মিতার সঙ্গেই লালন করেছেন, শিখিয়েছেন জীবনবোধ ও সমাজ-সচেতনতা। যদিও তাঁদের সবচেয়ে উজ্জ্বল দুই ছাত্রই বিশিষ্টতায় একক এবং গুরু-নিরপেক্ষ, ‘পরম্পরা’ কথাটা অন্তত তাঁদের ক্ষেত্রে নেহাতই জলের দাগ বলে ভ্রম জাগায়। 

তবু, পরাধীন ভারতের সেই অন্তিম লগ্নে সত্যেন্দ্র-মেঘনাদ এবং এই ছাত্রদল দেশকে বিশ্ববিজ্ঞানচর্চার মানচিত্রে স্পষ্ট রেখায় এঁকেছিলেন। তাঁদের সেই সাফল্যের পিছনে দুই বটবৃক্ষকে অস্বীকার করি কী করে? 


#Jgadish Chandra Bose #Prafulla Chandra Roy #Satyendranath Bose #Meghnad Saha #Upendranath Brahmachari #Jnanchnadra Ghosh #জগদীশচন্দ্র বসু #প্রফুল্লচন্দ্র রায় #সত্যেন্দ্রনাথ বোস #মেঘনাদ সাহা #নিবন্ধ #অর্পণ পাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

215843