প্রমীলা ও একটি হত্যাকাণ্ড
সত্তর দশকের উত্তাল দিন। সংবাদে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ। শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থার জন্য যুবক-যুবতীরা রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু আন্দোলনের ভেতরে দুষ্কৃতি ঢুকে পড়েছে, বলা ভাল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুন-জখম চলছে, চলছে শ্রেণিশত্রু খতম। বাগুইহাটি রেলপুকুরপাড় অঞ্চলে সুজয়, তার স্ত্রী প্রমীলা ও দুবছরের শিশু পুত্র অম্লান ওরফে অমুকে নিয়ে বসবাস করে। জায়গাটা এমনিতে আপাত শান্ত কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী ঘটবে তা কল্পনাতীত। তেমনই ঘটেছিল সেদিন।
তখন রাত্রিবেলা। প্রমীলা অমুকে বাইরের বারান্দায় খাওয়াতে বসিয়েছে। গরমকাল, দক্ষিণের ফুরফুরে হাওয়ায় বেশ মনোরম পরিবেশ। আজকেই বাজার থেকে নতুন বাল্ব কিনে লাগিয়েছে সুজয়কে দিয়ে। হঠাৎই দূর থেকে কানে এল কোলাহলের শব্দ। শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ক্ষীণস্বরে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে হইহই-এর আওয়াজ। প্রমীলা বিপদ আসছে বুঝতে পেরে বারান্দার লাইটটা নিভিয়ে শিশু সন্তানকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ক্রমশ আওয়াজটা এগিয়ে আসছে এই গলিতে। দরজার ফাঁক থেকে দেখল, একজন মানুষকে অনেকজন মিলে তাড়া করেছে। ভদ্রলোক প্রাণপনে দৌড়চ্ছেন এবং আর্তনাদ করছেন, “বাঁচাও, বাঁচাও”। তাড়া করা দলের একজন সেই ভদ্রলোকের পিছনে ক্রমাগত কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে চলেছে। ভয়ে দরজাটাকে বন্ধ করে দিয়ে আবার ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য বসে গেল। সুজয় একটু রাত্তির করেই বাড়ি ফিরল অফিস থেকে। ইউনিয়ন অফিসে গিয়েছিল কাজের পর। সেক্রেটারি রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ওরফে রবিদার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল অফিসের পরে ইউনিয়নের কাজ। কাজ ফাঁকি দিয়ে ইউনিয়ন করা চলবে না। সামনে পেনডাউন স্ট্রাইক, সরকারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে। সেই সব মিটিং-মিছিল সেরে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়েছে। প্রমীলা জিজ্ঞেস করল “হ্যাঁ গো! রাস্তায় কিছু দেখলে?”
“না তো। কেন কিছু হয়েছে নাকি?”
“ঘণ্টাখানেক আগে এক ভদ্রলোককে একদল ছেলে মিলে তাড়া করেছিল।”
“ধুর, সেসব তো রোজদিন লেগেই আছে।”
“না গো। আজকের ঘটনাটা তার থেকেও ভয়ঙ্কর বলেই মনে হয়।”
“তাই? বটে!” ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকলো সুজয়।
রাতের খাওয়া শেষ হতে সাড়ে দশটা বাজল। “না, আজ অনেক খাটাখাটনি গেছে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি”, বলল সুজয়। “কাল আবার সকাল বেলা উঠে বাজার করে অফিস যাওয়া।”
মধ্য রাত। হঠাৎ সদর দরজা ধাক্কানোর দুমদুম আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল সুজয়ের। “সুজয়বাবু দরজাটা খুলুন। বাগুইহাটি থানা থেকে আসছি।” একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ সুজয়। থানা-পুলিশের সাতে-পাঁচে থাকেনা। সেখানে কিনা তার নাম ধরেই মাঝরাতে ডাকাডাকি চলছে! প্রমীলা বুঝতে পারল ব্যাপারটা। “চলো তো। আমিও তোমার সঙ্গে যাই।”
“দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমার.. আমার বাথরুম পাচ্ছে!”
প্রমীলা দরজাটা খুলল। ইন্সপেক্টর পাকড়াশি গলা তুললেন, “সুজয় বাবু কোথায়?” “বাথরুমে গেছে। আসছে।” প্রমীলা এমনিতে খুবই ডাকাবুকো আর নার্ভও স্ট্রং। খুব ছোট বেলাতেই মাকে হারিয়েছিল, সেই থেকে পরের বাড়িতে মানুষ। না, ঠিক পরের বাড়ি বলা যায় না। বাবার অফিসের কোয়ার্টারের পাশেই সেনকাকুর ফ্ল্যাট। সেখানে সেনকাকিমার কাছে দিনের বেলাটা কাটত। তাই তো যেদিন সুজয়ের অফিস ইউনিয়নের কেষ্টবাবু অনুরোধ করেছিলেন একটি ছেলেকে কিছুদিনের জন্য রাখতে, একটুও দ্বিধা করেনি অজানা অচেনা মুকুলকে রাখতে। তখন খুব পুলিশি ধরপাকড় চলছে; গালে দাড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ আর সদুত্তর না দিতে পারলেই জেলে পুরে দেওয়া। মাসখানেক আগেই মুকুলকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল। মুকুল নকশাল, সুজয় চুপিচুপি বলেছিল। যদিও মুকুল ক্লিন শেভ্ড হয়েই এসেছিল। ভেতরের ঘরে ঠাঁই হয়েছিল তার। সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকত। মাঝেমধ্যে সারা ঘর জুড়ে অম্লানকে কোলে করে ঘুরত। “বৌদি, অমুর শিরদাঁড়া ব্যথা হয়ে গেছে শুয়ে শুয়ে, তাই একটু কোলে নিলাম।” “তুমি ওর অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ” – মৃদু আপত্তি জানায় প্রমীলা, “যখন থাকবে না তখন কোলে ওঠার জন্য সারাক্ষণ বায়না করবে।” একমাস কাটিয়ে মুকুল চলে যায়। ততদিনে সত্যিই অমুর কোলে চড়ার অভ্যেস বেড়ে গেছে।
“আপনাদের বাড়ির সামনে একটা বডি পড়ে আছে দ্যাখেননি? ঘুমোচ্ছেন?” গর্জে উঠলেন ইন্সপেক্টর পাকড়াশি।
“কী করব স্যার, অফিস থেকে গাধার খাটনি খেটে ফিরে রাত্রিবেলা একটু না ঘুমোলে পরের দিনের পরিশ্রমটা করব কী করে?”
“আসুন আমাদের সঙ্গে। দেখুন কিভাবে স্ট্যাব করেছে।”
ঘটনাস্থল সুজয়ের বাড়ি পেরিয়ে কয়েক পা দূরে। সুশীল বাবুর বাড়ির সামনে। লাইটপোস্টের ঠিক তলায় পুলিশের ড্রেস পরা একটি শরীর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। জামার উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার পিছনে ছাকনির মত ছুরি মারার দাগ। “কী ভয়ঙ্কর!” সুজয় বলল। পাশে দাঁড়িয়ে বিদেশবাবু আর সুশীলবাবু, দুই প্রতিবেশী। বিদেশবাবু থরথর করে কাঁপছেন। “এই তো সুজয়, আমি পুলিশকে তোমার নাম বলেছি।” মনে হল সুজয়কে দেখে যেন তাঁর ধড়ে প্রাণ এল। “আপনারা কেউ কিছু দেখেননি, কিছু শোনেননি?” ইন্সপেক্টর পাকড়াশির প্রশ্ন। প্রমীলা এগিয়ে এল। “তখন সাড়ে আটটা বাজে। রেডিওতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলছিল। আমি তো বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিলাম। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। বাড়িতে একা ছিলাম তো।” “আর সুশীল বাবু? আপনার তো বাড়ির সামনে ঘটনা” ইন্সপেক্টর পাকড়াশি বললেন। “স্যার, আমি ফ্রন্টটা ইউজ করি না। আমার আর সুজয়ের কমন প্যাসেজে এন্ট্রান্স আছে, ওটা দিয়ে রেগুলার যাতায়াত করি। আর যা ঘটল আজ, সদর দরজা জীবনেও খুলব না। এপাড়া একেবারেই সেফ না।” “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। প্রাথমিক তদন্তে আমাদের ধারণা সার্ভিস রিভলবারটা নেওয়ার জন্যই এই খুন। ওটাই মিসিং”; একটু থেমে বললেন, “আপনাদের থানায় যেতে হবে না। শুধু উইটনেসে একটু সই দিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যান।” রাত দুটো বাজে। পুলিশ বডি নিয়ে চলে গেল নিয়মমাফিক ময়নাতদন্তের জন্য, আততায়ীদের খোঁজে তল্লাশি অভিযানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
বাড়ি ফিরে সুজয় শুয়ে পড়ল। অমু হিসি করেছে। প্রমীলা অমুর কাঁথাটা বদলে দিল। নিকষ অন্ধকার অমাবস্যার আকাশ। তারাগুলো ঝলমল করছে। সপ্তর্ষিমন্ডল, কালপুরুষ আরও কত নাম না জানা নক্ষত্র। বারান্দায় এসে প্রমীলা একদৃষ্টে চেয়ে রইল আকাশপানে। যে পুলিশকর্মী খুন হলেন তাঁকে প্রমীলা বাড়ির সামনের রাস্তায় যেতে দেখেছে। নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। নিশ্চয়ই খুন করার আগে কদিন এই অঞ্চলে রেইকি করেছে। আশেপাশের সমস্ত স্ট্রিটলাইট খারাপ। ঢিল ছুঁড়ে ভেঙেছে। মনে পড়ল, গতকালই অচেনা কয়েকটি মানুষ এসেছিল। বেপাড়ার লোক, বারান্দার গ্রিলে ঠুকঠুক করে ডেকেছিল “বৌদি একটু বারান্দার লাইটটা জ্বালাবেন, পয়সা পড়ে গ্যাছে।”
“না ভাই। বাল্বটা কাটা জ্বলবে না।”
“ঠিক আছে বৌদি। লাগবে না।”
আজ মনে হল যদি বাল্ব ঠিক থাকত তবে ওরা ঠিকই ঢিল ছুঁড়ে ভাঙত নিশ্ছিদ্র অন্ধকার করার জন্য। একটি তারা হঠাৎই খসে পড়ল। প্রমীলার মনে হল, তারা খসে কোথায় পড়ে? তার বাড়ির ছাদে নয়তো? ক্রমশ রাত শেষে ভোর হয়ে আসছে। পূর্ব দিকে যতটা দেখা যায় লালচে আভা। এবার সত্যি সত্যিই বড্ড ঘুম পাচ্ছে প্রমীলার। বিছানায় এলিয়ে পড়ল সে।