বিজ্ঞানে কেমব্রিজের প্রথম ভারতীয় স্নাতক প্রমথ বসু : প্রথম বাঙালি ভূতাত্ত্বিক
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞান স্নাতকের নাম জানা আছে? কিংবা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রথম বাঙালি ভূতাত্ত্বিকের নাম? অথবা, যে খনি থেকে এখনও দেশের সবচেয়ে বেশি আকরিক লোহা উত্তোলন হয়, ময়ূরভঞ্জের সেই খনির আবিষ্কর্তার নাম? এই সবকটা প্রশ্নের উত্তর একটাই - প্রমথনাথ বসু। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র উভয়েই দেশখ্যাত বিজ্ঞানী। এঁদেরও আগে আর একজন বাঙ্গালী বিলাত থেকে বিজ্ঞানে কৃতবিদ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন, তিনি ভূতত্ত্ববিদ্ প্রমথনাথ বসু। প্রমথনাথের জীবনধারা কালে কালে তাঁকে বাঙ্গালা দেশের পূর্বাচার্যদের সমআসনে উঠিয়েছিল।”
প্রমথনাথ বসু-র জন্ম হয় ১৮৫৫ সালে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার গোবরডাঙার কাছে গৈপুর গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় খাঁটুরা আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয়ে। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে বৃত্তি পেয়ে প্রমথনাথ ভর্তি হন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে, সেখান থেকে এন্ট্রান্স ও এফ.এ পরীক্ষায় পাশ করেন। তাঁর অসামান্য মেধা দেখে অধ্যাপকরা তাঁকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হতে পাঠিয়ে দেন। এরপর গিলক্রিস্ট বৃত্তির পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক হন। তারপর ১৮৭৯ সালে রয়াল স্কুল অব মাইনসের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং প্যালিওন্টোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেন। এখানেও প্রমথনাথ সমস্ত বিদেশি ছাত্রদের পিছনে ফেলে পরীক্ষায় প্রথম হন।
লন্ডনে লেখাপড়া করলেও পাকাপাকিভাবে বিলেতবাসী হবার কোনও বাসনা প্রমথনাথের ছিল না। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তিনি Geological Survey of India (GSI)-তে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষের কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রমথনাথ চাকরি পাননি। তখন খরচ চালানোর জন্য তিনি বিলেতে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। এই সময়েই তাঁর আলাপ হয় দাদাভাই নৌরজি, আনন্দমোহন বসু, লালমোহন ঘোষের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে লন্ডনে 'ইন্ডিয়া সোসাইটি' গঠন করে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন প্রমথনাথ, তাঁর এই সময়ের বক্তৃতায় উঠে আসতে থাকল পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকের অপশাসন, অত্যাচার, বঞ্চনার কথা। তাঁর এইসব কার্যকলাপ দেখে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আর লন্ডনে থাকতে দেওয়া নিরাপদ মনে করলেন না, তাঁকে GSI-এর অ্যাসিসট্যান্ট সুপারিন্টেনডেন্ট পদে নিয়োগ করে দেশে পাঠিয়ে দেন। ১৮৮০ সালে, চব্বিশ বছর বয়সে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ভূতাত্ত্বিক প্রমথনাথ বসু।
চাকরিজীবনে প্রমথনাথের পায়ের তলায় ছিল সরষে। বছরের ছ' মাস তাঁকে ফিল্ড সার্ভে করতে হতো, অর্থাৎ পাহাড়, জঙ্গল, সমতলে ঘোড়া আর উটের পিঠে ঘুরে ঘুরে, তাঁবুতে থেকে অনুসন্ধানের কাজ চালাতেন। এই কাজ করতে গিয়ে বরাকর-রানিগঞ্জে অভ্র খনি, দার্জিলিংয়ে কয়লা, সিকিমে তামা, আসামের রাইপুর ও বালারহাটে আগ্নেয় শিলা, মধ্যপ্রদেশের ধুলি ও রাজহরায় আকরিক- লোহা, রায়পুরে লিগনাইট কয়লা ও লৌহ খনিজ, জব্বলপুরে ম্যাঙ্গানিজ ও লোহা, নর্মদা অববাহিকায় খনিজ সম্পদ, ব্রহ্মদেশে কয়লা ও গ্রানাইট পাথর খুঁজে বার করেন প্রমথনাথ। এইসব কাজকর্মের ওপর ভিত্তি করে তিনি মোট তেরোটি গবেষণাপত্র ও একটি 'মেময়ার্স' লেখেন। এই বিপুল কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত থাকা সত্ত্বেও সাত বছর পর প্রমোশন পেয়ে তিনি ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট পদ পান। টানা দু'বছর কার্যকরী সুপারিন্টেনডেন্ট-এর দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও তাঁর পদ পাকা হয়নি, পরিবর্তে অনেক পরে চাকরিতে যোগ দেওয়া টমাস হেনরি হল্যান্ড তাঁর চেয়ে উচ্চপদে নিযুক্ত হন। এই ঘটনায় অপমানিত ও ক্ষুব্ধ প্রমথনাথ চাকরিতে ইস্তফা দেন।
প্রমথনাথের কর্মকাণ্ড সমসাময়িক সমাজে বেশ প্রচার পেয়েছিল। চাকরি ছাড়ার পর পরই উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের বাঙালি দেওয়ান মোহিনী মোহন ধর তাঁর কাছে ওই অঞ্চলে খনিজ পদার্থ পাওয়ার সম্ভাবনা জরিপ করার প্রস্তাব নিয়ে আসেন৷ এই প্রস্তাবে প্রমথনাথ রাজি হন এবং পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই গরুমহিষানি পাহাড়ের ঢালে ভূগর্ভস্থ লৌহ-আকরিকের সন্ধান পান। এখানে সঞ্চিত খনিজ পরিমাণে ছিল বিপুল। এ বিষয়ে নিজের নোটবুকে প্রমথনাথ লিখেছিলেন, "আমার বিশ্বাস এটা একরকম অফুরন্ত এবং বেশ কয়েকটা আধুনিক ফার্নেসকে এই খনি অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবিরাম জোগান দিতে পারবে।" তাঁর অনুমান কিন্তু ভুল ছিল না। উড়িষ্যার এই খনি থেকে আজও দেশের সর্বাধিক আকরিক লোহা উত্তোলিত হয়। তিনি বুঝেছিলেন, সেই সময়ে স্বদেশি শিল্পস্থাপন কতটা জরুরি। তাই এই বিশাল লৌহ আকরিকের সঞ্চয় শুধু আবিষ্কার করেই তিনি থেমে থাকেননি, নিজের উদ্যোগে জামসেদজি টাটা-কে চিঠি লিখে এই খনির কথা জানান এবং অনুরোধ করেন এই অঞ্চলে শিল্পস্থাপনের জন্য। এর আগে টাটাদের দাল্লি-রাজহরার কারখানাও তৈরি হয়েছিল প্রমথনাথের গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে, তাই টাটাগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালোই ছিল। এবারেও ক্ষেত্রসমীক্ষা করে সুবর্ণরেখা ও খরকাই নদীর সঙ্গমের কাছে সাকচিতে তৈরি হল কারখানা, যার হাত ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে জামসেদপুর শহর।
পেশাগত জীবনে অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রচুর লেখালেখি করেছেন প্রমথনাথ। লন্ডনে পড়াশোনা করার সময়ে লিখেছিলেন 'ভারতে বিলাতী সভ্যতা' প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি ভারত ও ইংল্যান্ড দুই দেশের সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ভারতের অবস্থার জন্য শুধুই ঔপনিবেশিক শাসনের ওপর দোষারোপ করেননি তিনি, দেশের প্রচলিত কুসংস্কার, দুর্বলতাকেও দেখিয়েছেন। আবার দেশে ব্রিটিশের শিক্ষাবিস্তার, রেল প্রচলনের মতো কাজের প্রশংসাও করেছেন। কাজের জন্য প্রায় সারা দেশেই ঘুরতে হয়েছে প্রমথনাথকে, এই ঘোরাঘুরির সূত্রে তাঁর কর্মোদ্যোগী সত্তা যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনই তাঁর সৌন্দর্যরসিক মনও খোরাক জুটিয়ে নিয়েছে। হিমালয়ের খরস্রোতা নদী দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখছেন — "কি তেজ, কি বীর্য্য, কত স্ফূর্ত্তি, কত আনন্দ!... জীবনের প্রারম্ভে এইরূপই হইয়া থাকে।" স্বদেশপ্রেমিক প্রমথনাথ দেশের শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। তাঁর 'উপায় কী?' প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, "তুলা হইতে কাপড়, ইন্ডিয়া রবার হইতে ওয়াটার প্রুফ, লৌহঘটিত আকরিক পদার্থ হইতে লৌহ, এবং লৌহ হইতে ছুরি কাঁচি ইত্যাদি প্রস্তুত করাই শিল্পকর্ম্ম। শিল্পই দেশের ধনবৃদ্ধির প্রধান উপায়।" এছাড়াও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তারের জন্য বেশ কিছু প্রবন্ধ ও পুস্তিকাও লিখেছিলেন। ১৮৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত তিনটি বইয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক তৃতীয় খণ্ডটি সম্পাদনা করেন তিনি। প্রমথনাথ বসুর সারাজীবনে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিরিশেরও বেশি। তিনি ১৮৮০ সালে প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, যা থেকে জানা যায় হরিদ্বার থেকে জম্মু পর্যন্ত বিস্তৃত জীবাশ্ম সমৃদ্ধ শিবালিক পাহাড়ে শিব-পিথেকাস, ব্রহ্ম-পিথেকাস ও রাম-পিথেকাসের ফসিল পাওয়া যায়।
স্বদেশি শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের দিকেও প্রমথনাথের নজর ছিল। স্বদেশি শিল্পস্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৮৯১ সালে কলকাতায় 'ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ সম্মেলন'-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আসানসোলের কয়লাখনির পরিচালন কমিটির কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আবার পূর্ব ভারতের প্রথম আধুনিক সাবান কারখানাও তিনি স্থাপন করেছিলেন। তবে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশে আধুনিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতিও যে প্রয়োজন তা তিনি অনুধাবন করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট' প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন, পরে ডিরেক্টর হন।
বিস্মৃতির রোগ বাঙালির রক্তে। বড় সহজে সে ভুলে যেতে পারে নিজের ইতিহাস। প্রথম বাঙালি ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুকেই বা ক'জন মনে রেখেছে!
..................