ক্ষমতা, লিঙ্গসাম্য ও বার্বি
...............
ছবি : বার্বি
পরিচালক : গ্রেটা গারউইগ
অভিনয় : মার্গট রবি, রায়ান গসলিং, আমেরিকা ফেরারা, উইল ফেরেল প্রমুখ
গোলাপি রঙে মোড়া এক খেলনা শহরে থাকে বার্বির দল। নির্মাণকারী সংস্থা ম্যাটেলের মতো তারাও মনে করে, বার্বিল্যান্ডের মতো সত্যিকারের দুনিয়াতেও বুঝি মেয়েরাই রাজ করে। বার্বিল্যান্ডে মেয়েরা রাষ্ট্রপতি হয়, নোবেল পায়, বই লেখে, বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। কিন্তু প্রত্যেকটি মেয়ের একে অপরকে একইভাবে ‘বার্বি’ সম্বোধন থেকেই বোঝা যায়, দিনের শেষে এরা সবাই ছাঁচে ঢালা অর্ডারি পণ্য, ফ্যান্টাসির ফাঁপা জগতে এদের বিচরণ। দিনের পর দিন বার্বিদের বাহারি নাচগান বুঝিয়ে দেয় বাস্তব থেকে এরা কতটা বিচ্ছিন্ন, লকডাউনের দিনগুলোয় পরিযায়ী শ্রমিকদের না খেতে পেয়ে মরবার সময়ে কারা যেন ধুমধাম করে হাউস পার্টি করছিল? এবার এই বার্বিরা আপনাকে বেভারলি হিলসের কথা মনে করিয়ে দেয় না গড়িয়া যাদবপুরের, সেটা অবশ্য আপনার ব্যাপার।
এমন সময়ে ঘটে ছন্দপতন, নাচতে নাচতে বার্বি হঠাৎ বলে বসে, ‘আচ্ছা তোমরা কখনও মরে যাবার কথা ভাবো?’ তার কাটতে থাকে আরও নানা জায়গায়, বার্বি খাবারে স্বাদ পায় না, ভেসে বেড়াতে গিয়ে ধড়াম করে আছাড় খায়, পায়ে সেলুলাইটের দাগ দেখে আঁতকে ওঠে। সমস্যা মেটানোর জন্য সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে বাস্তব জগতে পাড়ি জমায় বার্বি, সঙ্গে জুড়ে বসে কেন। এবং সেই দুনিয়ার রকমসকম দেখে তাক লেগে যায় তাদের। খোদ ম্যাটেলের পরিচালন সমিতিতে কোন মহিলা নেই কেন জিজ্ঞেস করলে সিইও তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, ‘মহিলাদের আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেই, আমার মা একজন মহিলা।‘ অকাট্য যুক্তি!
ক্ষমতা, সম্পর্ক, লিঙ্গভেদ - ভারী ভারী শব্দগুলোকে অনায়াসে মজাদার ফ্যান্টাসি আর তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গের মোড়কে কাটাছেঁড়া করতে থাকে এই ছবি। ‘বার্বি’ উপভোগ করতে গেলে আপনাকে গাবদা বই পড়ে প্রস্তুতি নিতে হবে না, একটা খোলা মন নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গেলেই হল। ‘বার্বি’ শুধু মেয়েদের দেখার ছবি নয়, এ পৃথিবীর কোনকিছুই যেমন শুধু মেয়েদের বা ছেলেদের নয়। এ ছবি পৌরুষ প্রমাণ করবার চাপে ভিতরে ভিতরে ফালাফালা হয়ে চলা ছেলেদেরও, ‘আয়াম জাসট কেন’ গানখানা তাই শেষের দিকে অসহায় আর্তনাদের মতো শোনায়। বাস্তব জীবনে পুরুষতন্ত্র যেমন ভোল পালটে আরও ধুরন্ধর হয়েছে, বার্বিল্যান্ডের মাতৃতন্ত্রও তেমনি সামাজিক সাম্য আনতে পারে না- গর্ভধারিণী বা অসুন্দর বার্বিদের জায়গা নেই সেখানে, ছেলেদের দেওয়া হয় না ন্যূনতম সম্মান। এই অবিচারই ক্রমশ দরজা খুলে দেয় কেনদের সংবিধান সংশোধনের জঙ্গি চক্রান্তের। ছবির শেষে তাই একে অপরের সংজ্ঞায়িত পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষ ও নারীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা খুঁজে বের করবার উপর জোর দেওয়া হয়, অবাস্তব অসাধারণত্বের লক্ষ্যমাত্রা বর্জন করে নিতান্ত সাধারণ মহিলার আদলে তৈরি বার্বির কথা বলা হয়। ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোর জাল সরিয়ে ইতিহাসের ধুলোপড়া পাতা থেকে বের করে আনা হয় বার্বি তৈরির মূল কারিগর শ্রীমতী রুথ হ্যান্ডলারকে।
দৃশ্য, শব্দ এবং সংলাপের সার্থক মিশেলে যথার্থ সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে এ ছবি। অভিনয়ে প্রত্যেকেই দুর্দান্ত। রবি ও গসলিংয়ের পাশাপাশি মারকাটারি অভিব্যক্তির মাধ্যমে নজর কেড়ে নেন আমেরিকা ফেরারা এবং কেট ম্যাককিনন। গারউইগ এবং বাউমবাখের টানটান চিত্রনাট্যের যোগ্য সঙ্গত করেছে রডরিগো প্রিয়েতোর ক্যামেরা ও রন্সন-অয়াটের আবহসঙ্গীত। নবীনা পরিচালক গারউইগ ‘লেডি বার্ড’ আর ‘লিটল উইমেন’ ছবির পর আবার একখানা ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ‘বার্বি’ দেখুন, দেখান। লিঙ্গবিদ্যার ক্ষেত্রে গাদাগাদা একঘেয়ে সেমিনার বা গোমড়া আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি কাজ দেবে এই মজারু ছবিখানা।
...........................
#Barbie #Margot Robbie #Greta Gerwig #Ryan Gosling #Film Review