পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ
বই : পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ লেখক : স্বপ্নময় চক্রবর্তী
তখনও আমাদের প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যায়নি; আমরা সব ক্লাস IV এর ছাত্রী। সেই সময় থেকে একটু একটু করে আমার পরিচিতি গড়ে উঠছে মাথার উপরকার ঐ উল্টানো কড়াই-এর মত কালো আকাশ আর তার বুকে বাসা বেঁধে থাকা অজস্র তারার মধ্যে গুটিকতকের সঙ্গে। সেই শুরু। গ্রহ – নক্ষত্রের পার্থক্য দিয়ে শুরু করে ক্লাস বদলের সাথে সাথেই আকাশের সঙ্গে আমার সখ্যতার সীমা বিজ্ঞান আর ভূগোল বইয়ের পাতায় পাতায় কালপুরুষ, নীহারিকা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ পেরিয়ে পৌঁছেছিল ক্যাসিওপিয়া পর্যন্ত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গল্প, তাদের আবিষ্কার, বিড়লা তারামণ্ডলের লাইট এণ্ড সাউন্ড শো, এমনকি নেচার ক্যাম্প-এর রাতের তারা দেখার ক্লাস – বারবার উন্মুখ করেছিল বটে ঐ অসীম বিস্ময়ের পাড়ে কি আছে জানতে, কিন্তু সে ঐ পর্যন্তই। কিন্তু সবাই তো এমন হয়না। কেউ কেউ হয়ত হয় নয়নচাঁদ ঘরামী। দুচোখ ভরে থাকে যাদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে। ঘরে অসুস্থ বাবা, প্রচন্ড অর্থাভাব-ও পারেনা তাদের পরম বিস্ময়মাখা চোখের সামনে থেকে অজানাকে জানবার বাসনাকে মুছে ফেলতে । আর গ্রামের এই সহজ সরল শিশুর মনে জ্ঞানলিপ্সার এই বীজটি যিনি স্বযত্নে বপন করেছিলেন তিনি আমাদের ছেলেবেলার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতই একজন, বুধখালি কৃপাসিন্ধু বিদ্যালয়ের ভূগোলের মাস্টার মনিলাল স্যার। ঠিক আমাদের স্কুলের দিনগুলোতে যাঁরা পথ চিনিয়েছেন, বুঝিয়েছেন, আশীর্বাদ করেছেন, শাসন করেছেন, আবার ভালো-ও বেসেছেন ; আর সর্বোপরি নিজেদের সবটুকু স্বপ্ন দিয়ে আমাদের উজ্জ্বল ভাবে দেখতে চেয়েছেন বারবার, তাঁদের-ই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে এই মনিলাল স্যার-এর মধ্যে। তাঁর-ই হাত ধরে নয়নচাঁদ পেয়েছে সেই ‘পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ’খানা, যা কিনা তার ঐ ছোট্টো গ্রাম্য জীবনে বয়ে এনেছিল হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা তারার আলোর আহ্বান। আর ছাত্র শিক্ষকের এই সুনিবিড় সম্পর্ককে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর অসাধারণ উপন্যাস ‘পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ’। আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে চাকুরীরত অবস্থায় লেখকের পরিচয় ঘটে পূর্ব মেদিনীপুরের অখ্যাত শাউরি গ্রামের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানার স্বল্প জীবনকালের অসামান্য কাজ সম্পর্কে এবং পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীর জীবনে তাঁর স্কুল ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক মনীন্দ্রচন্দ্র লাহিড়ীর অসামান্য অবদান সম্বন্ধে। তাঁদেরই প্রতি লেখকের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে এই উপন্যাসের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন : আসা যাওয়ার মাঝের গল্প / উদিতা আচার্য
সামান্য পাউডার কৌটোর মধ্যে লেন্স বসিয়ে বানানো টেলিস্কোপ, আপাত দৃষ্টিতে অমিয় বড়ালের এই সৃষ্টি খুব সাধারণ; তবু এই সাধারণ সৃষ্টি-ই এক জীবন থেকে আর এক জীবনে সঞ্চারিত করেছে অসীম জ্ঞানপিপাসা। মনিলাল স্যার-এর হাত ধরেই নয়নের আকাশের ম্যাপ দেখার হাতেখড়ি। নয়নের চোখে আকাশ জেগে উঠল এক অসীম শক্তির আঁতুড়ঘর হিসেবে। ক্লাস-এর প্রথম স্থানাধিকারী মণিলালের এই প্রিয় ছাত্রটি জীবনের বাধা পেরিয়ে উচচমধ্যমিকে চব্বিশ পরগণা জেলায় প্রথম হয়ে প্রেসিডেন্সির পর গ্রামের গন্ডি টপকে পাড়ি জমালো বিদেশেও । অসীম অনুসন্ধিৎসাকে সঙ্গী করে নয়ন পেরিয়ে যেতে লাগলো জীবনের ঝুঁকি, দারিদ্রের পিছুটান , চিকিৎসার অসাধ্য ‘লেফ্ট বান্ডিল ব্রাঞ্চ ব্লক’ -এর চোখ রাঙানি। আর তাই নয়নের সাধনা , মনিলাল স্যার-এর স্বপ্নের কাছে বারবার হার মেনেছিল থেমে যাওয়ার গল্প। শুধুমাত্র ছাত্রকে সমৃদ্ধ করেই সন্তুষ্ট এক শিক্ষক আর তার উপযুক্ত গুণী শিষ্যের মেলবন্ধনের এ এক অবিরাম চলমান কাহিনী। নয়ন আর মনিলাল স্যার এর এই গতিময়তা ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্ররাও । অমিয় বড়াল, মণিমালা, অভিমানী মানিনী বা নয়নচাঁদ নিজেও - জীবন-মৃত্যুর আবর্তে এক সময় মিশে গিয়েছে মহাজীবনের সাথে, শাশ্বত নিয়মেই ধাবমান জীবন হয়ে গিয়েছে স্তব্ধ; তবু শুধু জীবন মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে মূর্ত রয়ে গিয়েছে সীমাহীন এক অনন্ত জিজ্ঞাসা, নিরন্তর গতিশীল অসীম বিস্ময়ভরা মহাবিশ্ব। ‘এ জীবনে সব-ই যে হারায়’; তাই ক্ষণিকের জন্য আসা মানুষগুলো চলে যাওয়ার আগে বারবার বাঁচিয়ে রেখে যেতে চায় নিজেদের। মনিলাল স্যার এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে স্কুলের কচি-কাঁচাদের তারা-দেখা চোখে, নতুন পিতলের জ্যাকেট পরিয়ে তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর পুরোনো টেলিস্কোপ রেখে স্যার আবারও হাজার হাজার চোখে পৌঁছে দেন তারার আলোর ডাক। আর নয়ন বেঁচে থাকে কসমোলজির বইয়ের এন. সি. জি. মেথডে আর স্মৃতি ভরা ডায়েরির পাতায়। জীবনের চিরন্তন প্রবাহমানতা অব্যহত থাকে অসীমকাল ধরে বয়ে চলা এক প্রাণের চেতনায়। এখানেই ‘পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ’ মিলে গিয়েছে জীবনের সাথে আর জীবনের পারে মহাশূন্যে।
#স্বপ্নময় চক্রবর্তী #পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ #বই রিভিউ #Book Review #উদিতা আচার্য #সিলি পয়েন্ট