প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি ও মহাশ্বেতা দেবী
“আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে আমি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছি। ...আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হল সেই মানুষগুলি যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হল এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলি। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলি আসলে তাদেরই হাতে লেখা।”
প্রান্তিক মানুষদের উপস্থিতি ছাড়াও মহাশ্বেতা দেবীর রচনায় পাই প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি সম্বন্ধে গভীর অনুসন্ধান, এবং পক্ষপাতদুষ্ট সমাজের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া কিছু অমোঘ প্রশ্ন। ষাটের দশকে উত্তরাধুনিকতা এবং অন্যান্য তত্ত্বগুলির উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে, একমুখী চিন্তাধারা থেকে সরে এসে ক্রমশ মান্যতা পেতে থাকে ভাবনার বহুমাত্রিকতা। গ্রাহাম সুইফটের ওয়াটারল্যান্ড প্রভৃতি গ্রন্থ মানুষের ইতিহাস পাঠের প্রাথমিক বোধকেই প্রশ্ন করে বসে; প্রথানুগ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আখ্যানের পাশাপাশি ছোট ছোট আপাত অনুল্লেখিত ঘটনাগুলিকেও হাজির করে নতুন তাৎপর্যের সঙ্গে - বুঝিয়ে দেয় ইতিহাসের লিখন মোটেই নিরপেক্ষ নয়; তার পরতে পরতে রয়েছে কায়েমি স্বার্থের অনিবার্য উপস্থিতি। ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছেন তাঁরা নিশ্চিতভাবেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক বা আদর্শগত অবস্থানে বিশ্বাসী, ফলে তাঁদের রচনায় সচেতন বা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবেই বাদ পড়ে যায় একাধিক বিকল্প সম্ভাবনা। তাই অনিল শীল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পুরোটাকেই পশ্চিমি ধ্যানধারণার সস্তা অনুকরণ বলে বসেন, আবার বিপান চন্দ্র ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস ব্যতীত অন্য কোনো ধারাকে গুরুত্ব দিতে রাজি হন না। উত্তরাধুনিক ইতিহাসচর্চা এই অবহেলিত বিকল্প পাঠগুলিকেই সামনে নিয়ে আসতে চায়। মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ তাই উপন্যাসের গণ্ডী ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে ইতিহাসচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। বিরসা মুণ্ডার আন্দোলনকে একটি স্থানীয় গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে না দেখে তাকে স্থাপন করা হয় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পুরোভাগে, একের পর এক নিদর্শনের সাহায্যে মহাশ্বেতা তুলে আনেন আন্দোলনের নেপথ্যে পুঞ্জীভূত অজস্র ক্ষোভের খতিয়ান। ‘বান’ গল্পেও পাই একই ধরনের ইতিহাসবোধের পরিচয়, বৈষ্ণব আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই কাহিনিতে চৈতন্যদেবের বদলে প্রধান হয়ে উঠেছে এক দলিত বালকের আত্মোপলব্ধি। প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে লেখা একের পর এক কাহিনিতে মহাশ্বেতা বারেবারেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ধর্ম, দেশ, সমাজ ও সংবিধানের মত সর্বজনস্বীকৃত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলির প্রতি। ‘স্তনদায়িনী’ গল্পে সিংহবাহিনির মূর্তির পাশাপাশি যশোদার জীবনের করুণ পরিণতি প্রমাণ করে দেয় দৈনন্দিন জীবনে হিন্দুধর্মের শক্তিপূজন রীতির অন্তঃসারশূন্যতা। যশোদার মতোই পুরুষদের হাতে নির্মমভাবে ব্যবহৃত হয় ‘চোলি কে পিছে’ গল্পের গাঙ্গোর বা ‘দ্রৌপদী’ গল্পের বিদ্রোহিনী দোপদি মেঝেনের ধর্ষিত শরীর, কখনও যার নিমিত্ত হয়ে ওঠে বুদ্ধিজীবীর নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত উপীন পুরী, আবার কখনও সেনানায়কের মত রাষ্ট্রের পরোয়ানায় বলীয়ান সামরিক উৎপীড়নকারী। ‘মৌল অধিকার ও ভিখারী দুসাদ’ গল্পে প্রমাণিত হয় গ্রামীণ ভারতবর্ষের ব্যবহারিক জীবনযাত্রায় জাতীয় সংবিধানের অসারতা। বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলন প্রহসনে পরিণত হতে দেখানো হয় ‘বিছন’ গল্পে। ‘ভাত’ গল্পে প্রশ্ন উঠেছে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আচারের বিরূদ্ধে, আবার ‘দৌড়’ গল্পে উঠে এসেছে চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দলিতদের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস। ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে শিক্ষিত ভদ্রবিত্ত বাঙালি সমাজের প্রতি যে শাণিত বিদ্রূপ বর্ষিত হয়েছে, তৎকালীন ক’জন গদ্যসাহিত্যিকের কলমে তা দেখা গেছে? মহাশ্বেতার চরিত্ররা হামেশাই কাহিনির পরিশেষে ভেঙে চুরমার করে দেয় চেনা ছক। দোপদি ও গাঙ্গোর পুরুষতন্ত্রের বিধান অগ্রাহ্য করে নিজের নগ্ন শরীর স্বেচ্ছায় মেলে ধরে পুরুষের সামনে, শোষক-শোষিতের চিরাচরিত সম্পর্ক উল্টে দিয়ে দুলন গঞ্জু অত্যাচারী জমিদারকে পিটিয়ে লাশ গুম করে দেয়, উচ্চশিক্ষিত বাঙালি সমাজের আত্মশ্লাঘা ছিন্নভিন্ন করে দেয় ব্রতীর মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ। শুধু লেখনীতে নয়, প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে মহাশ্বেতা দেবীর সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে সম্ভবত তাঁর জীবনযাপনে। বুদ্ধিজীবীর নিরাপদ বৃত্ত ছেড়ে, প্রচলিত সাংসারিক জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি নিত্যসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রান্তিক মানুষদের, হয়ে উঠেছেন শবরদের মাতা ও সাঁওতালদের বড়দিদি। প্রচারের আলোয় আসতে সাহায্য করেছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারির মত সাহিত্য প্রতিভাকে। মহাশ্বেতা দেবী তাই অবিস্মরণীয় এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নাম, প্রচলিত সাহিত্য-সমালোচনার মাপকাঠিতে যাঁকে বিচার করতে যাওয়া বাতুলতা।