নাটককার পিকাসোর দ্বিতীয় নাটক
নাট্যজগৎ ও পিকাসো (তৃতীয় পর্ব) ............................... তৃতীয় পর্ব : নাটককার পিকাসোর দ্বিতীয় নাটক
*********************************
জীবনের স্বল্প দৈর্ঘ্য বা মানুষের সীমিত ক্ষমতা, নাকি কবি ও শিল্পীর স্বভাবগুণের বৈপরীত্য – কোন কারণে কবিরা চিত্রকর কিংবা চিত্রকররা কবি হন না, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একই ব্যক্তির পক্ষে কল্পনাকে রং-তুলি প্রয়োগে ছবিতে এবং কলমের আঁচড়ে লেখনিতে প্রকাশ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। তবে, এই কাজটিই করে দেখিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পাবলো পিকাসো। ভিক্টর উগো, লুইস ক্যারল লেখালিখির পাশাপাশি ছবিও আঁকতেন, মিকেলাঞ্জেলো সনেট লিখেছিলেন, আর এ সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। সেই পথেরই পথিক পিকাসোও। ভাস্কর্য-বিদ্যা, মৃৎশিল্প, ফটোগ্রাফি, লিথোগ্রাফি – সবেতেই হাত পাকিয়েছিলেন পিকাসো।
তিনের দশকের মাঝামাঝি থেকেই শিল্পকর্ম ছেড়ে লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেছিলেন পিকাসো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বন্দিদশায় প্যারি শহরে বসে লিখেছিলেন তাঁর প্রথম নাটক। মাত্র তিনদিনের প্রচেষ্টায় উগড়ে দিয়েছিলেন সেই বন্দিদশা, নাৎসি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ 'Desire Caught by the Tail'-এ। যুদ্ধশেষে ১৯৪৭-এ পিকাসো দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সে ভ্যালুরিস প্রদেশে সপরিবারে বাস করতে শুরু করেন। এখানেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় নাটক Les Quatre Petites Filles [ইংরাজি অনুবাদে নাটকটির শিরোনাম The Four Little Girls] লেখেন। ২৪শে নভেম্বর ১৯৪৭ থেকে ১৩ই আগস্ট ১৯৪৮ – প্রায় ন’মাস সময় ধরে নাটকটি লিখেছিলেন পিকাসো। ১৯৪৭-এর মে মাসে পিকাসোর তৃতীয় সন্তান ক্লদ-এর জন্ম হয় এবং অন্য দুই সন্তানের বয়স তখন সাতাশ ও তেরো বছর। পিকাসোর বিভিন্ন পর্বের শিল্পকর্মে বারবারই তাঁর আশেপাশের জীবন, ঘটনাসমূহ ফুটে উঠেছে, এই নাটকের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটেনি। নিজের সন্তান এবং বন্ধুবান্ধবের সন্তানদের কর্মকান্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন পিকাসো, আর তারই ফসল হল এই নাটক যেখানে তিনি চার বালিকার খেলাধূলা, কথাবার্তা, কল্পনার জগতকে তুলে ধরেছেন।
নাটকটির শিরোনাম স্রেফ চার বালিকার কাজকর্মের ইঙ্গিত দিলেও, নাটক জুড়ে যে হিংস্রতা, মৃত্যুর ছবি বারবার ফিরে এসেছে তা জাঁ ককতু-র ১৯৩০-এর উপন্যাস Les Enfants terribles-কে মনে করিয়ে দেয়। এই উপন্যাসের শিরোনাম পিকাসোর নাটকের নামের ঠিক বিপরীত দিকের ইঙ্গিত বহন করে, শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর দিকগুলি নিয়েই সেই উপন্যাস। পিকাসোর নাটকে চারটি বালিকার চরিত্র থাকলেও অধিকাংশ সময়ে তিনটি বালিকাই কথা বলে, আর একটি বালিকা কুয়োর মধ্যে লুকিয়ে সময় কাটায়। তিন বালিকার কথাবার্তার ধরণ গ্রিক ট্র্যাজেডির কোরাসের ন্যায় শুনতে লাগে, তারা কথা বলে একস্বরে, এমনকি তারা তিনজন স্বগতোক্তি করে সমস্বরে। একটি শিশুর কুয়োর মধ্যে লুকিয়ে থাকার ঘটনা বাস্তবে মৃত্যুর প্রতি পিকাসোর এক ইঙ্গিত যা স্মরণ করিয়ে দেয় এক ইংরাজি শিশুভোলানো ছড়াকে – “Ding dong bell, Pussy’s in the well”.
ছয়টি অঙ্কে বিভক্ত এই নাটকে এক শাকসবজির বাগানে চার বালিকার হই-হল্লার বর্ণনা রয়েছে। তারা নিজেদের মত করে নানা খেলাধূলা করে, নিজেদের আনন্দচঞ্চলতাকে জিইয়ে রাখে। নাটকে চার বালিকার চরিত্রের কোনও নাম রাখেননি পিকাসো, তাদের চিহ্নিত করেছেন ১,২,৩,৪ সংখ্যার মাধ্যমে। শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তির প্রসার ও তাদের চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন পিকাসো। পেনরোস লিখেছেন – “It was important for him to understand their imaginary world and their habits in this case just as it had been all his life”. পিকাসোর সন্তানেরা এই নাটকের রচনায় এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। নাটকের চারটি বালিকার চরিত্রই নিষ্পাপ, কিন্তু কথাবার্তা, ভাবনার জগত ও কর্মকান্ড জীবন-মৃত্যু-ভালোবাসা সম্বন্ধে অনেক গভীর অর্থ প্রকাশ করে। নাটকে তাদের নিরপরাধ খেলাধূলা ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে ওঠে, তাদের চরিত্রগুলি যাত্রা করে ‘innocence’ থেকে ‘violence’ এর দিকে। পিকাসো দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে শিশুরাও তাদের চাওয়া-পাওয়ার পূরণের জন্য হিংসার পথ বেছে নিতে পারে।
শিশুদের পবিত্রতা ও সেই নিরীহতার বিপথে গমন এই নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম। নাটকের শুরুতে তাদের প্রবেশ তাদের নিষ্পাপ, পবিত্র হিসেবে স্থাপন করে। তারা সমস্বরে গান গায়, তাদের খেলাধূলা শৈশবের পরিচায়ক। তারা লুকোচুরি খেলে; তারা বিয়ের দৃশ্যে, জাহাজডুবির ঘটনায় অভিনয় করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নাটকে তাদের খেলাধূলা নিষ্পাপ থাকে না, তাদের নিষ্পাপ, নিরপরাধ সত্তার মধ্যে বাসা বাঁধে হিংস্রতার বীজ। প্রথম অঙ্কে প্রথম বালিকা বলে ওঠে, “Let’s play at hurting ourselves and hug each other with fury making horrible noises”, সে আরও বলে, “make the best you can of life. As for me, I wrap the chalk of my desires in a cloak, torn and covered with black-ink stains that drip full-throated from bloind hands searching for the mouth of the wound.” এই শিশুসুলভ ইচ্ছাপ্রকাশের মধ্যে নিহিত রয়েছে এক প্রবল হিংসা। লুকোচুরি খেলার দৃশ্যে প্রথম বালিকা তৃতীয় বালিকাকে বলে, “If you don’t come back, we shall all go and hang ourselves….” দ্বিতীয় অঙ্কে একটি দৃশ্যে তৃতীয় বালিকার একটি ছাগলের গলা কেটে সেটি নিয়ে নাচ করার ঘটনা এই নাটকের সবচেয়ে হিংস্র ঘটনা, বাকি তিন বালিকাও এই দৃশ্যে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে, এভাবেই পিকাসো নিষ্পাপ প্রাণীদের হত্যার মাধ্যমে দেখিয়েছেন বালিকাগুলির হিংস্র হয়ে ওঠার ছবি।
পিকাসোর এই নাটকটি আসলে একটি ‘play within a play’, বালিকাগুলির অভিনয় করার ঘটনা বাস্তবে ‘রোল-প্লেয়িং’, তাদের জাহাজডুবির ঘটনার পুনর্নির্মাণ আসলে একটি মঞ্চ তৈরি করে একটি দৃশ্য উপস্থাপনের পরিচায়ক। গোটা নাটক জুড়ে পিকাসো একাধিক চিত্রকল্পের প্রয়োগ করেছেন, পুতুলের মাধ্যমে বালিকাদের নিষ্পাপ সত্তা, কিংবা শেষ দৃশ্যে সাদা রঙের পশ্চাদপটে লাল ওয়াইনের মাধ্যমে বালিকাদের শৈশব থেকে কৈশোরে যাত্রা – সবই তিনি করেছেন নিখুঁতভাবে। নাটকে পিকাসো Surrealism-এর ছোঁয়া দিয়েছেন ‘Grave Diggers’ Carnival’ দৃশ্যটির মাধ্যমে, সেখানে তাদের মদ্যপান, নাচ ও কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অত্যন্ত ‘surreal’. পিকাসোর এই নাটকটিও অ্যাবসার্ড থিয়েটারের বিভিন্ন ধারণাকে প্রদর্শিত করে – ঘটনার পুনরাবৃত্তি, অর্থহীন কথাবার্তা ও কাজকর্ম এবং বাস্তব থেকে প্রস্থান এসব বারবার ফিরে এসেছে এই নাটকে।
১৯৭১ সালে পিকাসোর নব্বইতম জন্মদিন উদযাপনের জন্য এই নাটকের রোলান্ড পেনরোস-কৃত ইংরাজী অনুবাদটি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল লন্ডনের ওপেন স্পেস থিয়েটারে। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইংরেজ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার। ১৯৮২-তে ব্রাইটন ফেস্টিভ্যালে পিকাসোর জন্মশতবর্ষ পালনের সময় এই নাটকটির পুনর্মঞ্চায়ন হয়েছিল। পিকাসো রচিত দুটি নাটকই মঞ্চায়নের জন্য নয়, বরং পাঠ করার জন্যই লেখা – এমনই মনে করেন অনেক পিকাসো গবেষক। তবে পিকাসোর এই নাটকদুটি নিঃসন্দেহে পাঁচের দশকের বেকেট-ইয়োনেস্কো-আদামভের হাতে জনপ্রিয় হওয়া অ্যাবসার্ড নাট্যধারার অগ্রদূত।
...........................
তথ্যসূত্র :
Picasso, Pablo. Les Quatre Petites Filles. Éditions Gallimard, 1968.
Picasso, Pablo. The Four Little Girls. Trans. Roland Penrose. London: Calder and Boyars, 1970.
**************************************