ফারাও-এর জার্নাল (দ্বিতীয় কিস্তি)
(প্রথম কিস্তির পর)
মরীচিকা
ধূ-ধূ মরুভূমির বুক চিরে কালো পিচের হাইওয়ে। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু বালি আর বালি। নেই বসতি, নেই জনজীবন, নেই আড়ম্বর, নেই উদযাপন। কিছু পাথরের টিলা আর বোল্ডার, সুর্যের তেজে উত্তপ্ত দিগন্ত প্রান্তর। আবু সিম্বল থেকে আসওয়ান ফেরার পথটা এরকমই ।
হঠাৎই আমাদের তন্দ্রা কাটিয়ে গাড়ি থামল। সামান্য টয়লেট যাওয়া। কিন্তু টয়লেট সেরে যেই মুখ তুলে তাকালাম, স্পষ্ট দেখা গেল হাইওয়ের ওপারে জল। প্রায় জলাশয়ই বলা যায়। টলটলে জল, হালকা দুলছে।
মিশরে আসার পর থেকে আমার ইতিহাস ও ভূগোল ক্লাসের কথা বারবারই মনে পড়েছে। কিন্তু আজ মনে পড়লো ফিজিক্স ক্লাসের কথা। পূর্ণ অভন্তরীণ প্রতিফলন বা ‘Total Internal Reflection’, যা সৃষ্টি করে Mirage বা মরীচিকা।
চোখে না দেখলে এ জিনিস বিশ্বাস করা অসম্ভব। সম্পূর্ণ মিথ্যা জেনেও কোন জিনিসকে বিশ্বাস করার প্রবল ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে মরীচিকা। আগে নাকি প্রচুর বেদুইন মরীচিকার পিছনে ছুটে প্রাণ হারাত। আজ সেসব অতীত। কিন্তু মরীচিকা কী নাগরিক জীবনেও নেই?
আমরা urban nomad-রা কি একদম ছুটি না মরীচিকার পিছনে? অফিসের প্রমোশন, আর একটু বড় ফ্ল্যাট, আর একটা গাড়ি, প্রাক্তন প্রেমিকা, বন্ধুর স্ত্রী, ‘আচ্ছে দিন’ এরকম কত মরীচিকার পিছনে রোজ অবিরাম ছুটে চলেছি - নিজেদেরই খেয়াল থাকে না।
কিন্তু ছুটে যেতেই হবে। এটাই আমাদের ট্রাজেডি, আবার এটাই তো জীবন।
"Enjoy the Journey as the destination is a mirage"
- Steven Furtick
..................................................................
ভাঙাভাঙির গল্প (আবু-সিম্বল)
মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা,
মন্দির ভাঙে ধার্মিকেরা,
তারপর দাবি করে তারা ধার্মিক,
আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই,
তারা নাস্তিক ও অধার্মিক!
- হুমায়ূন আহমেদ
ইতিহাস সাক্ষী আছে যে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে কিছু মানুষ গড়ে আর কিছু ক্ষমতালোভী মূর্খ সেই সৃষ্টিকে ভেঙে নষ্ট করে। মজার কথা হল ভারতে আজকাল পুরাণ, ইতিহাস, মহাকাব্য, রূপকথা, হোয়াটসঅ্যাপ চুটকি মিশিয়ে এমন এক ককটেল সার্ভ করা হচ্ছে যে আমাদের নিজেদেরই সব গুলিয়ে যাবার জো। আর সেই ককটেলের নেশাতে আমরা ধর্মের নামে নির্দ্বিধায় ঐতিহাসিক সব নির্মাণ গুঁড়িয়ে দিতে তৈরি।
কাল আমরা আবু সিম্বল গেছিলাম। ৩৫০০ বছর আগের শিল্পকলা ও ভাস্কর্যের নমুনা দেখে আমার মতো আর্ট-অজ্ঞেরও হাঁ বন্ধ হতে চাইছিল না। ফারাও দ্বিতীয় রামসেস নিজের মন্দিরের পাশেই বানান নিজের স্ত্রী নেফারতারির মন্দির। সেখানে আবার রাজা ও রানির মূর্তির মাপ সমান। মিশরের ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল। এটা প্রেম না ফেমিনিজম তা নিয়ে তর্ক আপাতত তোলা রইল।
কাট-টু ১৯৭০। প্রেসিডেন্ট নাসির মিশর কে বন্যা ও অনাবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে নীল নদের উপর বানাবেন হাই-ড্যাম। কিন্তু গেরো করল আবু সিম্বল মন্দির। এমনিতেই জল ঢুকে অনেক দিন ধরে রং নষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু বাঁধ হলে তো পুরো জলের তলায়। তাহলে উপায়?
এবার তাহলে ভাঙাই হোক। কিন্তু গড়ার জন্য। অবিশ্বাস্যভাবে তারা পুরো মন্দিরটাকে টুকরো করে কাটল। বলাই বাহুল্য, অতি সাবধানে। টুকরোগুলো ২ টনের অধিক ওজন। একটি কৃত্রিম পাহাড়ের উপর নিখুঁতভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াল আবু-সিম্বলের বিরল ভাস্কর্য। নীলনদের বাঁধও হল, এদিকে মন্দির ভেঙেও ভাঙল না। এইভাবেই আসওয়ানের ফিলাই মন্দিরও প্রতিস্থাপিত হয়। মিশর আজ একটি মুসলিম রাষ্ট্র কিন্তু, ৩০০০ BC-র মিশরীয় ধর্মের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। সে সময়টুকু যেন তাদের ইতিহাসের সোনায় মোড়া এক অধ্যায়। তা তাদের গর্বের জায়গা।
লাক্সর মন্দিরে আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম যেটার কথা না বললেই নয়। একটি ১১০০ বছর আগের মসজিদ, যার দরজা মাটি থেকে প্রায় ১৪ ফুট উপর। খুব আশ্চর্য। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম খুব ভালো লাগল। ৬০ AD তে খ্রিস্টধর্ম মিশরে আসে। তখন মসনদে রোমানরা। ৩০০ AD নাগাদ লাক্সরে একটি গির্জা নির্মাণ করেন খ্রিস্টানরা। ১৫০ বছর পর রোমানরা সেই গির্জা তছনছ করে। তারপর আরও অনেক স্থাপত্যের মতোই মরুভূমির বুকে হারিয়ে যায় এই গির্জা।
ছবি : আবু-সিম্বল মন্দির
৬৪৫ AD নাগাদ অমর ইবন অলসের হাত ধরে ইসলাম আসে মিশরে। আগামী ৩৫০ বছর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন প্রচুর মানুষ। ১০০০AD নাগাদ লাক্সরে অনেক মসজিদ স্থাপন করে তারা। দেখুন মজাটা। মসজিদ তৈরি হল একটি টিলার উপরে, যার নিচে ঘুমিয়ে ছিল সেই গির্জা। তাহলে কি দাঁড়াল? ফারাওদের মন্দির, গির্জা ও মসজিদ এক চত্বরে। মসজিদের ঠিক তলায় গির্জা!
ছবি : নীচে গির্জা আর উপরে মসজিদ (লাক্সার)
কাট টু 1980। UNESCO-র স্বীকৃতি পেয়েছে লাক্সর মন্দির। গোটা মন্দির আবিষ্কার হয়েছে মরুভূমির বুকে। মসজিদের দরজা এখন শুন্যে। কারণ তলায় গির্জা। এখন মিশর কিন্তু ইসলামিক স্টেট। পুরো চত্বরটাকে সযত্নে সাজিয়ে তুলে সারা পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসুদের আহবান করল মিশর। চাইলেই কিন্তু গির্জা গুঁড়িয়ে ঝাঁ-চকচকে মসজিদ নির্মাণ করতেই পারত। তারা তা করেনি।
যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে শিল্প কে ধংস করে তারা বর্বর, ইতর। সে তালিবান হোক বা হনুমান। নিজেদের ধর্মের কলঙ্ক তারা।
.......................................
সোবেক ও মিশরীয় উপকথা
মিশর বলে কথা। মানবসভ্যতার আঁতুরঘর বললে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না। এখানে কুমিরের ভগবান হয়ে ওঠাও একটা গল্প।
সব সভ্যতাই তাদের আরাধ্য দেবতাদের সৃষ্টি করে একই ছক মেনে। প্রাকৃতিক শক্তি, যাদের কাছে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অসহায় বোধ করেছে - তারাই পেয়েছে দেবতার স্ট্যাটাস। মানে, যদি তাদের তুষ্ট রাখা যায় আরকি। প্রাথমিক ভাবে সব সভ্যতাতেই বায়ু, জল, সূর্য ইত্যাদির পূজার প্রবণতা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে মায়ান সভ্যতার সূর্য দেবতা 'আহকিন', ইনকাদের 'ইনতি', চিনের ‘ডৌমু’ , ও মিশরীয়দের 'আমুন রা'!
নীল নদের তীরে কিন্তু প্রধানত কৃষিগত কারণে মিশরের জন্ম। অর্থাৎ ধূ-ধূ সাহারা মরুভূমির বুকে নীল নদই ছিল মিশরীয়দের একমাত্র অবলম্বন। এ ক্ষেত্রে অফ-টপিক একটি ট্রিভিয়া না দিয়ে পারলাম না। ‘সাহারা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল মরুভূমি তাই সাহারার পর আলাদা করে মরুভূমি শব্দটা মিশরীয়দের কাছে হাস্যকর। ফেরা যাক মূল গল্পে।
সমস্যা বাঁধল এবার নীল নদের মনুষ্যেতর অধিবাসীদের সঙ্গে, যারা মানুষের অনেক আগে থেকেই এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। নীল নদের কুমির। নীল নদের বিভীষিকা। শুরু হল মানুষ-কুমির সংঘাত। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে এলেন দেবতা-অপদেবতার মাঝামাঝি কুমির-বদন দেবতা সোবেক। আর কী চাই? একদিকে কুমিরের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, অন্য দিকে বাড়ছে সোবেকের স্টাটাস ও ফলোয়ার।
এ ছাড়াও আর একটা কারণ ছিল। কুমির সাধারণত বন্যা আঁচ করতে পারে। বন্যার পূর্বাভাস পেলেই তারা দিন পনেরো আগেই গভীর জলে চলে যেত। তাদের এই আচরণ থেকেই মানুষ বন্যার প্রস্তুতি নিতে পারত। সমীকরণটা সহজ। যারা ভবিষ্যত বলতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে ভগবানের দূত।
মজার বিষয় হল সোবেক কিন্তু আবার উর্বরতার দেবতাও। মহিলাদের গর্ভবতী হওয়ার জন্য সোবেক-কে পুজো করার রীতি ছিল। অবাক করার মতো কথা হল, কিছু উপকথা অনুযায়ী সোবেক আবার যৌন হেনস্থাকারী এক অপদেবতা, যে নগ্ন মহিলাদের চুরি করে নরকের গুপ্তকুঠিতে যৌনদাসী বানিয়ে রেখে দেয়। মজার কথা দেখুন, নিশ্চয় নীল নদে স্নান করতে গিয়ে বেশ কিছু মহিলা শিকার হন কুমিরের। স্বাভাবিক কারণেই তাদের মৃত দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাই গুজব আস্তে আস্তে উপকথার রূপ নিয়েছে।
ছবি : কুমিরের মমি
ইতিহাস সাক্ষী আছে যে যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতারা ধর্মভীতিকে সুন্দর করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে নিয়েছেন। আমরা যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ও এর ব্যাতিক্রম নয়। যেসব অঞ্চলে কুমিরের উপদ্রব বেশি সেখানে গজিয়ে উঠল সোবেকের একাধিক মন্দির। এগুলো আবার উৎকৃষ্ট শিল্পকলার নিদর্শনও বটে। যেমন, কোমোম্বোর সোবেক মন্দির। কিছু কিছু ফারাও নিজেদেরকে সোবেকের আশীর্বাদধন্য প্রমাণ করার জন্য নিজেদের নাম পরিবর্তন করতে শুরু করেন। যেমন, ফারাও সোবেকনেফরূ (অর্থাৎ সোবেকের সেবক)।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে সম্রাট আলেকজান্ডারের হাত ধরে মিশর দখল করল গ্রীকরা। তারা মিশরীয়দের সঙ্গে কিন্তু নিজেদের বেশ মানিয়ে-গুছিয়ে নিল । জন্ম হল এক উৎকৃষ্ট মিশ্র-সংস্কৃতির। এই জাতিগত সংমিশ্রণের ফল টলেমি রাজবংশ, যাদের শেষ রানি ক্লিওপেট্রা। অনেকেই যদিও তাঁকে মিশরীয় ভাবেন কিন্তু তাঁর আদি বংশের সঙ্গে গ্রীকদের যোগ আছে।
এই টলেমি বংশের এক ফারাও-এর ছেলে নদীর তীরে খেলতে গিয়ে কুমির বাবাজির লাঞ্চ হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ ফারাও সব ভুলে আদেশ দিয়ে দিলেন - সব কুমির মারো। হত্যা করা হয় ৩৫০ টির কাছাকাছি কুমির। কিন্তু হুঁশ ফিরতে সোবেকের অভিশাপের ভয় তাঁকে পেয়ে বসল। ফলে ফারাও ঘটা করে মমি বানিয়ে কুমিরদের কবরও দিলেন। কোমোম্বো মন্দিরের ঠিক পাশেই। আজ সেই জায়গায় সোবেক সিমেট্রি, যেখানে কুমিরের, থুড়ি 'সোবেক রা' এর মমি সংরক্ষিত আছে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখুন। একদা নীল নদের ত্রাস, একাধারে দেবতা ও অপদেবতার তকমা পাওয়া ‘দ্য গ্রেট নাইল অ্যালিগেটর’ এখন একটি বিপন্ন প্রজাতি। তাহলে ভাবুন আসল অপদেবতাট আসলে কারা? "Crocodilus nilotictus" নাকি "Homo sapiens sapiens"?
ছবি : সোবেক-এর মূর্তি
.........................................................
ছবি : রানি হাচিপসুর স্ফিনক্স (কাইরো মিউজিয়াম)