বিবিধ

ফারাও-এর জার্নাল (প্রথম কিস্তি)

পথিক মিত্র June 10, 2022 at 6:22 am বিবিধ

মিশর বলতে একজন বাঙালি ঠিক কী বোঝে বলুন তো? মাধ্যমিকে ভূগোলে নীল নদ নিয়ে একটা ১০ নম্বরের প্রশ্ন থাকত, মনে পড়ে? ইতিহাস-ভূগোল না হয় বাদ দিন। ভাবুন টিনটিনের কথা। সেই ফারাও-এর চুরুট। বা ধরুন কাকাবাবুর মিশর রহস্য। গুপ্তধনের সন্ধানে সোজা পিরামিডের পেটের ভিতরে। শেয়াল দেবতা আনুবিস-কে মনে আছে? ফেলুদার শেয়াল দেবতা রহস্য? প্রোফেসার শঙ্কুর আতঙ্কের কথা ভোলেননি নিশ্চয়ই? মোদ্দা কথা এই সব রসদ নিয়ে প্রায় সব বাঙালীর মনে মিশর একটা রহস্যপুরি, যার প্রতিটি ইটে ইতিহাস ফিসফিস করে কথা বলে। তবে বাস্তবে যে মিশর এতটা রহস্য -রোমাঞ্চে ভরা তা মিশর না গেলে বোঝা অসম্ভব। আমার এই স্মৃতিরোমন্থন কিন্ত কোনোমতেই ভ্রমণকাহিনি নয়। একে জার্নাল বলাই ভালো, যা মিশরে থাকাকালীন লেখা। এ লেখা কিছু এমন ঘটনার ধারাবিবরণী, যা এই ভেতো বাঙালিটিকে আপাদমস্তক শিহরিত করেছিল। চলুন তবে, এগোনো যাক।

মমির অভিশাপ (কাইরো জাদুঘর, কাইরো)

 

কিছুদিন আগে আমার শ্বাশুড়িমা বশীকরণসিদ্ধ কোন এক বাঙালি বাবার সন্ধান জিগ্যেস করায় বেদম হাসি পেয়ছিল। তবে বুঝেছিলাম আজকের দিনে মূল খেলা হল পারসেপশন তৈরি করা। যেমন, বাঙালি’-র সঙ্গে কালাজাদু’-র সহাবস্থানের নোশনটা যত্ন সহকারে জাতীয় মিডিয়া রিয়া চক্রবর্তীর সময় নির্মাণ করেছিল। যেমন আটের দশকে হলিউড অত্যন্ত নিপুণভাবে বিভিন্ন হিট ছবির মাধ্যমে ভারতের ‘Land of snake charmers & black magic মার্কা একটি ইমেজ তৈরি করেছিল। টিনটিন স্রষ্টা হার্জ-কে আমাদের সত্যজিৎ রায় একটি চিঠিতে লিখেছেন এই বিষয়ে।

 

এখন কথা হচ্ছে মমির অভিশাপ ও তার পারসেপশন নিয়ে। ইন্ডিয়ানা জোন্স থেকে দা মমি রিটার্নস এর মত বহু ছবি ও বই এমন পারসেপশন তৈরি করেছে যে মমি বললেই অভিশাপ কথাটা আপনা থেকেই মাথায় চলে আসে। তাই এই মিশর রহস্য সমাধান করতেই আমাদের কাইরোর গাইড মহসিনকে অভিশাপের ব্যাপারটা বললাম। শুনে মহসিন এক গাল হেসে ভাঙ্গা ইংলিশে বলল, এসব ইংরেজদের ফন্দিফিকির। যাতে নতুন কোন সমাধি আবিষ্কার হলে ভয়ে কোন মিশরয় লোক না ঢুকে, তাদের ডাকে

প্রতিবাদ করে বললাম, কিন্তু তুতেনখামেনের সমাধির ব্যাপারটা? থুরি, ওরা আবার বলে "তুতানখামুন"! ছোটো থেকে পড়া ইতিহাস তো আর মিথ্যে হতে পারে না। মহসিন বলল, মমি তৈরির প্রক্রিয়াতে সাতরকম তেল লাগে। এই অদ্ভুত জৈব রসায়নিক মিশ্রণের জন্যই মৃতদেহটি হাজার হাজার বছর অখ্যত থাকে। ৫০০০ বছর ধরে বন্ধ ঘরে সেই তেলের বাষ্প আর বিভিন্ন খাদ্যের থেকে নির্গত গ্যাস রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। লোভের বশে যে লোক কোন প্রোটোকল না মেনে দুদিনের মধ্যে তুতেনখামেনের সমাধিতে ঢুকতে যায়, তার মৃত্যুর কারণ অভিশাপ নয়, বিষক্রিয়া ছিল কিন্তু কায়দা করে রটানো হল অভিশাপ বুঝতেই পারছ কেন?”

 

কেন?” আমি জিগ্যেস করলাম।

কারণ একমাত্র এই সমাধিতেই বিপুল পরিমা ধনসম্পত্তি ছিল। আগের একটিতেও না। তাই রাজার ঘুম ভাঙানোর গল্প সব বাজে কথা

কিন্তু হাওয়ার্ড কার্টার? তিনি তো মারা গেছিলেন লন্ডন ফিরে?”

তিনি কিন্তু পাক্কা দুই সপ্তাহ বাদে ঢুকেছিলেন। অভিশাপ জানলে নিশ্চিত তিনি না ঢুকেই ফিরে যেতেন। দু সপ্তাহে সমাধির ভেন্টিলেশন হয়ে যাবে তিনি জানতেন বিষাক্ত গ্যাস না থাকলে আর কসের চাপ? এবার কার্টার সাহেবের বিখ্যাত হওয়ার সময়। এতবড় আবিষ্কার বলে কথা। তাই নতুন জামাকাপড় পরে, দাড়ি কামিয়ে চলে গেলেন রাজার ঘুম ভাঙাতে। সঙ্গে ফোটোগ্রাফার। ছবি উঠল। লন্ডনের নামজাদা কাগজে বের হল সে সব ছবি। সবই ঠিক ছিল, গেরো করল দাড়ি কামানোটা। দাড়ি কামানোর ফলে আমাদের মুখ কিছু ক্ষুদ্র ছিদ্র বা micropore অনাবৃত হয়ে যায়। কিছু ব্যাকটেরিয়া সেই সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে। সেদিন কিন্তু উনি ছাড়া আর কেউ দাড়ি কামায়নি, তার প্রমা সেই ছবি আসলে কার্টার সাহেব হয়ত নিজের ছবি নিয়ে বড় বেশি সচেতন ছিলেন অসুস্থ বোধ করার পরেও কিন্তু তিনি সেখানে ডাক্তার না দেখিয়ে লন্ডন ফেরত যান। ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ার পর্যাপ্ত সময় পাওয়াতে লন্ডন ফিরেই তার মৃত্যু হয়। রটে যায় অভিশাপ লন্ডন অবধি ধাওয়া করেছে অবশ্য যদি ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মমির পোষ্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে আভিশাপই বটে

এরপর মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রোটোকল বানানো হয় - সমাধি আবিষ্কারের দু-মাসের মধ্যে নো এন্ট্রি! আর  তিন মাস চুল-দাড়ি কামানো বন্ধ সবার! এবার বোঝা গেল লোকগুলো জাস্ট আত্মভোলা বলে দাড়ি কামায় না, তা নয় এমনকি ঋতুমতী মহিলাদেরও প্রবেশ নিষেধ।

মজার কথা হল প্রোটোকল ফলো করার পর থেকে কিন্তু মমির অভিশাপে আর কোনো মৃত্যু ঘটে নি। 

শেষ কথাটুকু মহসিনের নিজের বয়ানে শোনাই - “আর যদি সত্যি সমাধিতে ঢুকলে অভিশাপ লাগে সবার আগে আমার লাগা উচিত ছিল, আমি শুধু যে মিশরের সমস্ত সমাধিতে ঢুকেছি তা-ই নয়, গার্ডের চোখ এড়িয়ে মমির সারকোফেগাসের (কফিন) মধ্যে শুয়ে সেলফি অবধি তুলেছি কলেজে থাকাকালন।"

 

এই ভার্সনটা পুরোপুরি মহসিনের।

তবে বিশ্বাস করুন বা না করুন, লুক্সরে valley of kings’-এ যখন তুতানখামনের সমাধির ভিতর ঢুকে ঘুমন্ত রাজার মমিকে চাক্ষুষ করলাম, বুকটা ধুক করে উঠেছিল।

“Truth is often stranger than fiction” 



 

ছবি : লাক্সরের “valley of kings”  ঘুমিয়ে আছেন ফারাও তুতানখামুন 



................................................................................... 


Size Does Matter (গিজা)

 

সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে নিদারুণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছে তার নিদর্শন আমরা ইতিহাসে বহুবার পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা যে এত প্রাচীন তার ধারণা ছিল না। মিশরের ফারাও কিঅপ্স, যিনি খুফু নামে পরিচিত, তিনিই নির্মাণ করেন বিশ্বের বৃহত্তম পিরামিড - ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’। তাও আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে কিন্তু দেখুন খ্যাতির বিড়ম্বনা, কোথায় খুফু ভেবেছিলেন তাঁর সমাধির জন্য ইতিহাস তাকে চিরকাল মনে রাখবে, কিন্তু সে গুড়ে বালি 

তাঁর পরবর্তী ফারাওরা এতটাই‌ ঈর্ষাকাতর ছিলেন যে তারা খুফুর অস্তিত্বটাই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে উঠলেন - খুফুর সমস্ত মূর্তি ভেঙে দিলেন। তাঁর বৃহৎ পিরামিডের বুক থেকে চোরেরা সাফ করে দিলে সমস্ত ধনসম্পদ, এমন কি তার মমিটিও! 


ছবি :  গিজার “The Great Pyramid”


সে ঘটনার অসহায় সাক্ষী হয়ে থাকল গিজার প্রকান্ড পিরামিড ও তার নিঃশব্দ প্রহরী।

ভাগ্যিস ১৯০৩ সালে Sir William Matthew Flinders Petrie আবিস্কার করেন খুফূর একমাত্র মূর্তি। ছোট্ট, খর্বকায়।উচ্চতা মাত্র ৭.৫ সেন্টিমিটার যদিও তাঁর হাতের কার্তুস প্রমান করে তিনিই খুফু  


ভাবুন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৩৮ মিটার উচ্চতার পিরামিডের নির্মাতার এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া একমাত্র মূর্তির উচ্চতা‌ কিনা ৭.৫ সেমি

বর্তমানে সেই মূর্তি রয়েছে কায়রো মিউজিয়ামে। 


ছবি : খুফুর একমাত্র মূর্তি


...................................................................................


ইতি আনুবিস ( আল খালিলি বাজার, কাইরো)

 

কাইরোর আল খালিলি বাজারের এক দোকান থেকে সংগ্রহ করলাম শেয়াল দেবতা আনুবিসের একটি মূর্তি। ফেলুদা-কাহিনিতে পড়েই এই ইজিপ্সিয়ান দেবতাটির প্রতি আগ্রহ জেগেছিল। আনুবিসের সম্বন্ধে বিশদে জানলাম বিক্রেতা গালালের থেকে

 

আনুবিস মৃত্যুর দেবতা। আমাদের যমরাজের মত। পিরামিডের ভিতরের চিত্রকলা বলছে, তিনি নিরপেক্ষ ও কড়া স্বভাবের। মৃত্যুর পর ফারাও-এর বিদেহী আত্মাকে নৌকা করে একটি আগুনের সাগর পার হয়ে যেতে হয় তার কাছে। সেখানে এক বৃহৎ সাপ তার দিকে বিষ নিক্ষেপ করে। জীবনে যা পুণ্য করেছেন তার বিনিময়ে ফারাও নিজেকে রক্ষা করেন। সমস্ত ফারাও-এর সামাধিতে তাই একটি নৌকা রাখা হত। এরপর ফারাও হাজির হ আনুবিসের দরবারে। সেখানে আনুবিস তাঁর হৃপিণ্ড চেয়ে নেবেন। মমির মধ্যে এই কারণেই হৃৎপিণ্ড রেখে দেওয়া হত। তারপর একটি দাঁড়িপাল্লাতে একটি পালকের সাথে হৃৎপিণ্ড ওজন করা হবে। যদি পালকের থেকে হৃৎপিণ্ড হালকা হয় তবে স্বর্গের টিকিট পাকা, কিন্তু যদি হৃৎপিণ্ড ভারী হয়, আনুবিস সেই হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করবেন। অর্থাৎ বাকি অনন্তকাল তাকে নরকে থাকতে হবে, পুনর্জন্মের কোনো সু্যোগ থাকবে না।

 

আনুবিসের মূর্তিকে সঙ্গী করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম এই নিয়ম যদি আজকের অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের উপর লাগু হত, তাহলে নরকে আজ ভারতের দ্বিগুণ জনসংখ্যা হত!

................................................................ 


(পরবর্তী কিস্তিতে সমাপ্য) 

 


#Egypt #Pyramid #Travelogue #মিশর #Silly পয়েন্ট #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

55

Unique Visitors

181972