ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম মহিলা তারকা পেশেন্স কুপার
প্যাক আপ (তৃতীয় পর্ব) :''দেহপট সনে নট সকলি হারায়''।সময়ের চেয়ে বড় সুপারস্টার কেউ নেই। তার সামনে সবাই পকেট-সাইজ। সময় কারো রোয়াব দেখে না বেশিদিন।খ্যাতি? সে তো বালির বাঁধ। আজ যে রাজা, কাল সে ফকিরেরও ফকির। সত্যজিৎ রায়ের কোনও এক গল্পে একটি চরিত্র বলেছিল, অভিনেতারা আক্ষরিক অর্থেই 'শুটিং স্টার'। উল্কার মতো আসেন। উল্কার মতোই চলে যান। মানুষ অল্পেই মাথায় তুলে নাচে, তার চেয়েও অল্পে অবহেলাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ক'দিন পর। বড় নিষ্ঠুর সেই গণ-প্রত্যাখ্যান। বড় অশ্লীল সেই গণ-বিস্মৃতি। বেঁচে থাকতে থাকতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান শতকরা নিরানব্বই ভাগ। বিরাট মাপের সুপারস্টারেরা মৃত্যুর পর দু' এক দশক অবধি টেনে দেন কোনওমতে।আসলে সময়ের চেয়ে বড় ঠগবাজ আর কে আছে! তার সাময়িক বশ্যতা- স্বীকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নিলেই পিঠে ছুরি খেতে হয়। সিলি পয়েন্টের এই নতুন ফিচার-সিরিজে আমরা তুলে আনব পুরোনো দিনের এমন কিছু অভিনেতার গল্প, যাঁদের আমরা আজ পরিপাটি ভুলে গেছি - অথচ সময় একদিন তাঁদেরও তাঁবেদারি করেছে। প্রতি শুক্রবার সিলি পয়েন্টের ফিচার-সিরিজ 'প্যাক আপ'। আজ তৃতীয় পর্বে পেশেন্স কুপার।.....................................................................................................................
ভারতের প্রথম মহিলা চলচ্চিত্র তারকা বলা হয় যাঁকে, সেই পেশেন্স কুপারের জন্ম ১৯০৫ সালে, ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী এই কলকাতায়। কুপার পেশাদার জীবন শুরু করেন ‘ব্যান্ডম্যানস মিউজিকাল কমেডি’ নামক এক ইউরেশিয়ান ট্রুপের নর্তকী হিসেবে, তারপর জামশেদজী ফ্রামজী মদনের করিন্থিয়ান স্টেজ কোম্পানিতে মঞ্চাভিনেত্রী হিসেবে যোগদান। রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে দুইয়ের দশকে হিন্দু মহিলাদের কাছে চলচ্চিত্র জগৎ ছিল অচ্ছুৎ, তাই পর্দা কাঁপাতেন কুপারের মত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীরাই।
তাঁর প্রথম সাফল্য ১৯২০ সালের ‘নল- দময়ন্তী’ ছবিতে, যার পরিচালক ছিলেন ইতালির ইউজিনিও দি লিগুয়োরো। মজার ব্যাপার, ভারতীয় ছবির এই প্রথম অধ্যায়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা চরিত্র কলুষিত হবার ভয়ে চলচ্চিত্র বা অভিনয়-শিল্পে আসতে চাইতেন না এবং প্রাধান্য ছিল পারসি ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের, তবে ছবির বিষয়বস্তু কিন্তু নির্ধারিত হত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দর্শকের কথা মাথায় রেখে - বিভিন্ন ধর্মীয় ও পৌরাণিক আখ্যান ভিত্তি করে। কুপারের অভিনয় জীবনের প্রথমদিকের তালিকায় তাই নল দময়ন্তী ছাড়াও রয়েছে 'বিষ্ণু অবতার' (১৯২১), 'ধ্রুব চরিত্র' (১৯২১), 'বেহুলা' (১৯২১), 'রাজা ভোজ' (১৯২২) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি পৌরাণিক ছবি। দুইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনি 'কৃষ্ণকান্তের উইল' (১৯২৭), 'দুর্গেশনন্দিনী' (১৯২৭), 'কপালকুণ্ডলা' (১৯২৯) ইত্যাদি একাধিক বঙ্কিম-কাহিনিভিত্তিক ছবিতে অভিনয় করেন, যেগুলির পরিচালক ছিলেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রিয়নাথ-পরিচালিত ও কুপার-অভিনীত ১৯৩০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাল পরিণয়’ ছবিটির কথা আমরা পাই সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইটির স্মৃতিচারণে। তিনের দশক থেকে আস্তে আস্তে সাহিত্য-নির্ভর ও আখ্যানমূলক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সমসাময়িক সমাজভিত্তিক মৌলিক ছবির প্রবেশ ঘটতে থাকে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় কুপারের 'সমাজ কা শিকার' (১৯৩১), 'এডুকেটেড ওয়াইফ' (১৯৩২), 'নকলি ডক্টর' (১৯৩৩), 'গরিব কি দুনিয়া' (১৯৩৪), 'সুলগতো সংসার' (১৯৩৫) প্রভৃতি ছবিগুলিতে। অনেকে মনে করেন, 'পত্নী প্রতাপ' (১৯২৪) সিরিয়ালে দুই বোনের চরিত্রে এবং 'কাশ্মীরী সুন্দরী' (১৯২৫) ছবিতে মা ও মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে পেশেন্স কুপার ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করবার কীর্তি স্থাপন করেন। তবে এই কৃতিত্ব অভিনেত্রী আনা সালুঙ্কের প্রাপ্য। ১৯১৭ সালে আনা সালুঙ্কে লঙ্কাদহন ছবিতে রাম ও সীতা দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন।
কুপারের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর চেহারার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লক্ষণ ও টেকনিশিয়ানদের দক্ষ কাজের যুগল-মিলনে গড়ে ওঠা ‘হলিউড লুক’। তাঁর শেষ ছবি ১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'খান সাহেব'। অভিনয়জীবন থেকে অবসর নেবার পর কুপার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তাঁর নতুন নাম হয় সাবরা বেগম। তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত হয় পাকিস্তানের করাচিতে, পালিতা কন্যা জিনাত ও হালিমার সাহচর্যে। ১৯৯৩ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিজে নিঃসন্তান হলেও জীবদ্দশায় সতেরোটি পালিত সন্তানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন কুপার। ভারতের রুপোলি পর্দার প্রথম তারকা অভিনেত্রীর এ-ও এক নাটকীয় কীর্তি বটে।
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস]