তেইশ বছর পরের একদিন
.....................
[১]
"রক্তিমবাবু?"
রক্তিম ফিরে তাকাল। এক প্রৌঢ়া। মাথায় স্কার্ফ। বয়েস রক্তিমের চেয়ে কিছু বেশিই হবে। চেনা লাগল না।
"মেমরি ব্যাঙ্কে যাচ্ছেন?”
রক্তিম মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ।"
প্রৌঢ়া কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, "আমাকে চিনতে পারছে না, তাই না?”
চেনার হলে প্রথমবারেই চেনা যেত। চেষ্টা করে লাভ নেই। স্মৃতিটাই নেই। কিন্তু ভদ্রমহিলা যেভাবে কথা বলছেন, চেনা বোধহয় উচিত ছিল। একটু লজ্জিত হওয়া উচিত কি? রক্তিম অপ্রস্তুত মুখ করে বলল, “সত্যিই চিনতে পারছি না। মাফ করবেন। আপনার কোনও মেমোরিই নেই।”
"না না। আপনি খামোখাই লজ্জিত হচ্ছেন,” প্রৌঢ়া কাঁধ ঝাঁকালেন, “সবারই স্টোরেজের টানাটানি।"
"কিন্তু আমাকে আপনার মনে আছে যখন... আচ্ছা, আমরা কি খুবই পরিচিত? মানে, আমি কি খুব জরুরি কোনও মেমোরি ডিলিট করে ফেললাম?"
"একেবারেই না। আমি আপনার জীবনে তেমন জরুরি কেউ নই। অ্যান্ড ভাইসি ভারসা।"
"তাহলে আপনি আমার মেমোরি রেখে দিয়েছেন যে...।”
"আপনার মেমোরি রিস্টোর করেছি গত বছর। তারপর আরও দুবার ব্যাঙ্কে এসেছি। বাকি প্রায় সব মেমোরি যোগ-বিয়োগ করেছি। আপনারটা রেখে দিয়েছি।"
রক্তিম অবাক হল, "কেন বলুন তো?"
প্রৌঢ়া রক্তিমের চোখে চোখ রাখলেন, "আপনি একজন ট্রু জেন্টলম্যান রক্তিমবাবু। আপনার মতো ওয়েল বিহেভড মানুষ আমি কমই দেখেছি।"
রক্তিম অস্বস্তি বোধ করল। নিজের প্রশংসা শুনলে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তের অস্বস্তিটা আরও এক কাঠি বেশি। এমন একজন কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছেন, যার কোনও স্মৃতি রক্তিমের নেই। কমপ্লিমেন্টটাও কেমন ওপেন এন্ড। ভদ্রমহিলা কথাটা বললেনও আশ্চর্যরকম গাঢ় উচ্চারণে। নাকি রক্তিমের কানে সেরকম শোনাল?
একটু ইস্তস্তত করে রক্তিম বলল, "থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু আরেকটু ভেঙে বললে বুঝতে পারতাম। মানে, স্মৃতিটাই নেই যেহেতু…।"
"আমার নাম অরুণিমা। অরুণিমা সান্যাল," প্রৌঢ়ার চোখে কৌতুক, "আপনি তো ব্যাঙ্কে যাচ্ছেন। শাফল করবেন নিশ্চয়ই। নামটা সার্চ দিয়ে দেখে নেবেন। ২০১৮ সাল দিয়ে সার্চ করবেন তাড়াতাড়ি পাবেন।"
"অতদিন আগের কথা?"
"হ্যাঁ। আর তেমন জরুরি কিছু না। রিস্টোর করার মতো কিছু না, আমি তো বললামই। আমি আপনার জন্য জরুরি কেউ না। আপনিও আমার জন্য সেরকম জরুরি কেউ না।"
"অথচ আমার স্মৃতি আপনি দিনের পর দিন রেখে দিয়েছেন। ডিলিট করছেন না।"
"আপনার মেমোরি লুপে চালিয়ে দেখতে আমার ভালো লাগে।”
"খুব সেলফ কনট্রাডিক্টরি হয়ে যাচ্ছে না কথাটা?"
“হচ্ছে হয়তো। তবে আমার ভালো লাগে। অবশ্য জানি না আপনি আগের মতোই আছেন, নাকি পাল্টে গেছেন। কিন্তু আমার ভাবতে ইচ্ছা করে আপনি পাল্টাননি। খুব ঘেঁটে দিচ্ছি, না?"
"খুব।"
"আর ঘাঁটব না। নিজেই দেখে নেবেন। অরুণিমা সান্যাল। কেমন? চলি। ভালো থাকবেন।”
[২]
মিঃ সেনের একটা ভুরু উপরে উঠে গেল। ঠোঁটে স্মিত হাসি নিয়ে বললেন, "প্রাক্তন প্রেমিকা?"
"কথাবার্তা শুনে তো তাই মনে হল,” রক্তিম একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তবে তেইশ বছর আগের।"
"আপনি তো ভাগ্যবান মশাই। হিংসে হচ্ছে আপনাকে। যাক গে, সার্চ মেরে দেখে নেবেন। এবার মাথাটা কাত করুন দেখি। কেমন বুঝছেন? চিপ গণ্ডগোল করছে না তো?"
"না। কিন্তু আর কত দাম বাড়বে বলুন তো? স্টোরেজ একটু না বাড়ালে অসুবিধাই হচ্ছে। জরুরি মেমোরিই তো প্রায় থার্টি পারসেন্ট খেয়ে বসে থাকছে। এদিকে এমন দাম বাড়ছে যে স্টোরেজ বাড়াতে চাইলে খাবার পয়সা থাকবে কিনা সন্দেহ।"
"হ্যাঁ দামটা একটু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ঠিকই। আপনার চিপ তো ৫০০ এক্সাবাইট?"
"হ্যাঁ।”
পরীক্ষা শেষ করে মিঃ সেন নিজের চেয়ারে হেলান দিলেন, "আপনার বয়েসে অন্তত জেটাবাইটে না গেলে মুশকিলই হবে। কিছু করার নেই রক্তিমবাবু। মানুষের লং টার্ম মেমোরি দিন দিন যে হারে কমছে, স্টোরেজের দাম তার তুলনায় কিছুই না। আমাদের ব্রেনের ক্যাপাসিটির ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। সেইজন্যই তো চিপ।"
"আপনারা বিজ্ঞানীরা কিছু করার নেই বললে আমরা যাব কোথায়?"
"আমাকে বিজ্ঞানী বলবেন না। প্রযুক্তিবিদ বলতে পারেন বড়জোর।"
"এখন মেমোরি কনসালট্যান্টদের ঈশ্বর বললেও অর্ধেক বলা হবে মিঃ সেন। রাখলে আপনারাই রাখবেন, মারলেও আপনারাই মারবেন।"
"ছি ছি। কী যে বলেন,” বিনয়ী কিন্তু পোশাকি গলায় বললেন মিঃ সেন, “মেমোরি নিয়ে কোনওরকম ট্যাম্পারিং-এর সুযোগ নেই, জানেনই তো। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমরা রয়েছি জাস্ট আপনাদের গাইড করার জন্য।”
রক্তিম সামনে রাখা স্মার্ট কম্পিউটারের দিকে তাকাল। স্ক্রিনে ওর স্টোরেজ ডিটেল দেখাচ্ছে। সাতাশি পয়েন্ট তিন নয় শতাংশ ভর্তি। নতুন মেমোরি নিতে গেলে পুরনো কিছু ডিলিট করতেই হবে। আজকাল এভাবেই চলে। নিজস্ব ক্লাউড থেকে সার্ফ করে দেখে দেখে ইচ্ছামতো কিছু স্মৃতি রিস্টোর করে নাও, কয়েকদিন জাবর কাটো, তারপর ইচ্ছে হলে ডিলিট করে অন্য স্মৃতি নাও। লকারে গচ্ছিত রাখার মতোই এই ক্লাউড সিস্টেম। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ক্লাউড নাকি আবার যুক্ত থাকে এলাকাভিত্তিক একেকটা মাস্টার ক্লাউড সিস্টেমের সঙ্গে। ভাবলে মাঝে মাঝে মাথা ভোঁ ভোঁ করে রক্তিমের। কী বিরাট কর্মকাণ্ড! মানুষ কত কিছু করে ফেলছে, ভাবলে গর্ব হয়। আবার একটু গা-ছমছমও করে।
মিঃ সেন নিজের কম্পিউটারে খুটখাট করছিলেন। মাথা না তুলেই বললেন, “কী হল? ভরসা হচ্ছে না?”
“না না। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।”
“কী? বলুন না।”
“আচ্ছা, লং টার্ম মেমোরির মতো আমাদের অন্যান্য ধরনের মেমোরিগুলোও কি আস্তে আস্তে ম্যালফাংশনের দিকে যাচ্ছে?
“না না। এত তাড়াতাড়ি সেটা হবার আশঙ্কা নেই। সেনসরি মেমোরি বাকিগুলোর মতো কাজ করে না, ফলে সেটা ওভাবে নষ্ট হবে না। ওয়ার্কিং মেমোরি আর শর্ট টার্ম মেমোরি এই দুটোরও ক্যাপাসিটি কমছে। তবে সেটা বিপজ্জনক জায়গায় যেতে সময় লাগবে। এখনই চিন্তার কারণ নেই।”
“এমন একটা দিন কি খুব শিগগিরই আসতে চলেছে মিঃ সেন, যেদিন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য ছাড়া আমাদের সমস্ত স্মৃতিই স্বাভাবিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেবে?”
মিঃ সেন মুখ তুলে তাকালেন। চশমার ওদিকে তাঁর উজ্জ্বল চোখকে সামান্য বিষণ্ণ দেখাল কি? গলা খাঁকড়ে নিয়ে বললেন, “এ নিয়ে এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি রক্তিমবাবু।”
রক্তিম চায়ের কাপে চুমুক দিল।
চা নয় ঠিক। চায়ের সঙ্গে আরও কীসব মিশিয়ে একটা ককটেল জাতীয় পানীয় দেওয়া হয় এখানে, খেলে বেশ ফুরফুরে লাগে। মস্তিষ্কের পুষ্টি বাড়ায় নাকি। স্বাদ একটু ঝাঁঝালো। এই জিনিসটা ‘আলফা মাইন্ড’ নামে বাইরেও বিক্রি হয়। রক্তিম কেনে না। অনেক দাম। অবশ্য এখানে এলে খেতে ছাড়ে না, কারণ প্যাকেজে এর দাম ধরা থাকে।
শেষ চুমুকে কাপ খালি করে রক্তিম জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, এই যে এত এত মেমোরি ক্লাউডে জমা হচ্ছে; এই যে বিরাট একেকটা ক্লাউড স্টোরেজ তৈরি হচ্ছে, এগুলো হ্যাক হবার চান্স রয়েছে তো?”
মিঃ সেন দু-দিকে মাথা নাড়লেন, “খুবই হাই লেভেলের সিকিওরিটি সিস্টেম। থিওরিটিকালি দেখলে ক্লাউড স্টোরেজ হ্যাক হওয়া অসম্ভব, তা নয়। কিন্তু কার্যত ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব। তবে যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই ক্লাউড কোনোদিন হ্যাক হল, তাতেও বিরাট ক্ষতির কিছু নেই। কনফিডেনশিয়াল কোনো তথ্য তো ক্লাউডে থাকছে না। সেগুলো তো ব্রেনেই থাকছে।”
"তাহলে ব্রেনে যে চিপগুলো ইন্সটল করতে হচ্ছে, তাদের এক্স্যাক্ট কাজটা কী? সেগুলোয় কোনও তথ্য থাকে না?"
“না, চিপে কোনও তথ্য থাকে না। চিপের কাজ হচ্ছে ব্রেনের মেমোরির অরগ্যানাইজার হিসেবে কাজ করা। আর ইচ্ছেমতো অডিও বা ভিডিও সিমুলেটর হিসেবে কাজ করা।"
কিউবিকলের ঘষা কাঁচের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলল, "একটা জিনিস খেয়াল করছি, বুঝলেন মিঃ সেন। আজকাল আর সিনেমা দেখা হয়ে উঠছে না। এককালে সিনেমা-সিরিজের পোকা ছিলাম। আজকাল স্মৃতি হাঁটকেই দিন চলে যায়।"
"স্মৃতিকেই সিনেমার মতো দেখতে পেলে কে আর সিনেমার দিকে যাবে বলুন। বিশেষত আজকাল কমবেশি সকলেই যখন এত নিঃসঙ্গ।"
"হ্যাঁ। ওইটাই আসল কথা। লোনলিনেস। আচ্ছা মিঃ সেন, এত মানুষ চারদিকে। তবু সবাই এত নিঃসঙ্গ কেন বলুন তো? কী মনে হয় আপনার?”
মিঃ সেন একটু ভাবলেন। ডানহাতের আঙুলগুলো এক-এক করে মটকাতে মটকাতে বললেন, "এককথায় বলা মুশকিল। কোথাও একটা বিরাট ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়ে গেছে। একটা গাইগ্যানটিক এলিয়েনেশন। নিজেদের সবকিছুই আউটসোর্স করে দিয়েছি আমরা।"
"ভালো বলেছেন। সবকিছুই আউটসোর্স করে দিয়েছি। ঠিকই।”
“ভাবুন তো, যে স্মৃতি এখন আমাদের সবচেয়ে বড়ো সম্বল, সেই স্মৃতিকেও আমরা আউটসোর্স করতে বাধ্য হয়েছি।”
রক্তিম চুপ করে থাকে। মাটির ঢেলার মতো লাগে নিজেকে। ফুরফুরে, হাল্কা, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আলগা হয়ে গেছে আণবিক গঠন। টোকা খেলেই ধসে পড়বে সবশুদ্ধু। এই মহিলাই কি সেই ‘টোকা’? কে জানে! রক্তিম একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “কী চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি দেখুন, এই যে একটু আগে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হল, আমি জানিই না তিনি কে। কারণ তার কোনও স্মৃতিই আমার মাথায় জমা নেই। তিনি আমার প্রাক্তন স্ত্রী, নাকি প্রাক্তন প্রেমিকা নাকি কলিগ? কিছুই জানি না। এমনকি নামটা যাতে ভুলে না যাই, নোট করে রাখতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের কি নিজেদের নিয়ে দুঃখ পাওয়া উচিত?"
"চমৎকার প্রশ্ন,” মাথা নাড়লেন মিঃ সেন, “তবে কিনা নিজেদের নিয়ে দুঃখ করার জন্য একটা মিনিমাম মানসিক গভীরতা লাগে। সেটা মানুষ দ্রুতই হারাচ্ছে। বাই দ্য ওয়ে, আমি খেয়াল করছি, আপনি খুব দুঃখের মেমোরি রিস্টোর করছেন আজকাল।”
রক্তিম বিষণ্ণ গলায় বলল, "কী জানি। এখনও কেন হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসি। মাঝে মাঝে মনে হয় দুঃখই ভালো। দুঃখ পেলে বেঁচে থাকাটাকে টের পাই। এখন তো দিনগুলো আলাদা করা যায় না। আজকের দিনটা অবিকল গতকালের দিনটার মতো। গত কালকেরটা অবিকল গত পরশুর মতো। দুঃখ পেলে তবু ঠিক আছে। আলাদা কিছু তো হল। খুব ভালো কিছু হলে ভয় করে। রাখতে পারব তো? কিংবা আবার স্ট্রাগল করতে হবে, অন্য কোনও পছন্দের মেমোরি সরিয়ে হয়তো তাকে জায়গা করে দিতে হবে।”
“এরই মধ্যে এক রহস্যময়ী এসে আপনার স্থিতাবস্থা ঘেঁটে দিয়ে গেলেন।”
রক্তিম হাসল, “আপনার সঙ্গে কথা বলে একটু ভরসা পাই, জানেন? আমার আগের কনসালট্যান্ট একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এমন নয় যে জিগ্যেস করলে বুঝিয়ে বলতেন না। কিন্তু নিজেরই একটা বাধো বাধো ঠেকত। দুটোর জায়গায় তিনটে কথা জিগ্যেস করতে কেমন একটা লাগত। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আপনি ট্রান্সফার হয়ে গেলে আমার ভালো লাগবে না মিঃ সেন।”
মিঃ সেনও হাসলেন। প্লাস্টিক হাসি নয়। অসাবধানে বেশি তাপ পেয়ে যাওয়া দুধের মতো সে-হাসি যেন উথলে উঠে পেশার বাইরে গড়িয়ে এল খানিকটা পথ। নাকি রক্তিমেরই চোখে সেরকম দেখাল? হাসিমুখে মিঃ সেন বললেন, "আমার মেমোরি তাহলে আপনি রেখে দেবেন বলছেন?"
"অবশ্যই। একটা-দুটো সিটিং অবশ্যই রাখব। তবে স্টোরেজের যা দাম বাড়ছে। আর ব্যাঙ্কের প্রসেসিং ফি-টাও তো আপনারা টুকটুক করে বাড়িয়েই চলেছেন মশাই।"
“আমি সিস্টেমের অংশমাত্র রক্তিমবাবু।”
“তা ঠিক। তবে সামনে আপনাকেই পাচ্ছি, আপনাকেই কথা শোনাই একটু। আর কাকেই বা বলব বলুন।”
"হা হা। যাক গে, আপনি এবার ভল্টে যেতে পারেন। আপনার রহস্যময়ীর খোঁজ করুন। হ্যাপি সার্ফিং।”
[৩]
নম্বরটা সেভ করে এনেছিল রক্তিম। বাড়ি ফিরেই ফোন করল।
“হ্যালো?”
"হ্যালো, অরুণিমা সান্যাল বলছেন?"
"হ্যাঁ বলছি।"
"আমি রক্তিম ঘোষ।"
"কী সৌভাগ্য!" ফোনের ওপাশ থেকে উছলে উঠল অরুণিমার গলা, "আমার মেমোরি রিস্টোর করলেন নাকি?"
"হ্যাঁ।"
"তাহলে তো জেনেই গ্যাছেন যে আমি সত্যিই জরুরি কেউ নই।"
"কী বলব বুঝতে পারছি না। এইমাত্র লুপে দেখছিলাম সেই দিনটা।"
"দিন না তো। রাত।"
"ওই হল, রাত। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আপনার এতজন কাস্টমারের মধ্যে আমাকে মনে রাখার ইচ্ছে হচ্ছে কেন?"
"সকালে বললাম যে। আপনি একজন ট্রু জেন্টলম্যান। আপনি মানুষকে সম্মান করতে জানেন। একটা কেজো ডিলকেও যথাযথ সম্মান করতে জানেন।"
"ধন্যবাদ।"
"আমার দ্বিতীয় প্রেমিক তন্ময় বাদে কেউ আমার সঙ্গে এত যত্ন করে ইন্টারকোর্স করেনি, জানেন! লোকে ভাবে টাকা দিলে আর-কিছু দেবার দরকার পড়ে না। অথচ আপনি প্রথম সাক্ষাতেই কী বললেন আমায়? বললেন, 'ঘরে স্মোক করলে আপনার অসুবিধা হবে না তো? তাহলে আমি বারান্দায় গিয়ে খেয়ে আসছি।' ইন্টারকোর্সের আগে আমাকে কাঁপতে দেখে আপনি জানতে চাইলেন আমার ঠাণ্ডা লাগছে কিনা, এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দেবেন কিনা।” গলা দ্রব হয়ে এল অরুণিমার।
এ-কথার উত্তরে ঠিক কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিল না রক্তিম। একটু সময় নিয়ে বলল, “অনেক ধন্যবাদ। এত বছর আগের এই সামান্য জেসচারটুকু যে আপনি মনে রেখেছেন…।”
“সামান্য নয়। আমার এত বছরের জীবনে আর কোনও পুরুষকে দেখিনি যে মনে করে, টাকা দিলেও সম্মান দিতে হয়। দুটোই একসঙ্গে দেওয়া উচিত, দেওয়া জরুরি। এমনকি একজন এসকর্টকেও।”
“আমি কিন্তু অত কিছু ভাবিনি। আমি এমনিই…।”
“সে বুঝেছি। আপনি স্বাভাবিক ভদ্রতা থেকেই বলেছেন। এই বোধটা আপনার ন্যাচারাল। সেইজন্যই তো বলছি আপনার মতো ট্রু জেন্টলম্যান আমি আর দেখিনি। কিন্তু এটাকে সামান্য জেসচার বলবেন না প্লিজ। আপনার এই আচরণটুকু আমাকে নিজের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছিল, জানেন? তার আগে পর্যন্ত আমি নিজেকে জাস্টিফাই করতে পারতাম না। প্রবল আত্মগ্লানিতে ভুগতাম। নিজেকে ঘেন্নাই করতাম বোধহয়। আপনি এলেন বলে নিজেকে সম্মান করতে শিখলাম। আপনার চোখে সম্মান দেখলাম বলে। বিশ্বাস করুন।” অরুণিমার গলা কাঁপছে।
রক্তিম কিছু বলতে পারল না।
সামান্য বিরতি নিয়ে অরুণিমাই আবার শুরু করলেন, "গত এক বছরে কতবার ভেবেছি জানেন, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। করা হয়নি। ফোন করে কী বলতাম বলুন? যে আমি অরুণিমা সান্যাল, পঁচিশ বছর আগে আমি এক রাতের জন্য টাকার বিনিময়ে আপনাকে আনন্দ দিয়েছিলাম? এটা ফোন করে বলা যায় একজনকে? আপনার জন্য তো রাত গয়ি, বাত গয়ি ব্যাপার। কিন্তু আমার জন্য তো সেটা নয়। মোট পাঁচজন প্রেমিক ছিল আমার। তন্ময় বাদে কারোর মেমোরি সেভ রাখিনি। ইন ফ্যাক্ট তন্ময়, আমার এক স্যার আর আপনি - এই তিনজন বাদে অন্য কোনও পুরুষের মেমোরি আমি সেভ রাখিনি। অথচ আপনি আমার কেউ না। আপনি শুনছেন তো?”
“শুনছি। আপনি বলুন।”
“আপনার অনেক সময় নষ্ট করছি, না?”
“একদম না। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছে। তবে আমি সত্যি সত্যি খুব একটা ভদ্রলোক নই অরুণিমা। আমার স্ত্রী দু-বছরও টিকতে পারেননি আমার সঙ্গে।”
“তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। সম্পর্ক টেকেনি বলে আপনাদের দুজনের কোনও একজন অবশ্যই খারাপ, এমন সরলীকরণে না-আসাই ভালো। সব ডিজাইন সব খাপে বসে না। দ্যাটস ইট।”
কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর রক্তিম বলল, “আচ্ছা, তন্ময়বাবু এখন কোথায়?"
"কে জানে! মেমোরিগুলোই আছে শুধু।"
"আপনি কিন্তু একদম পাল্টাননি অরুণিমা। চুলটাই যা ধূসর হয়েছে।”
“আপনিও বিশেষ পাল্টাননি। শুধু একটু মুটিয়েছেন। ওটুকু গুড ফ্যাট। থাকাই ভালো। আচ্ছা, এখনও কি দাড়ি রাখেন?”
"রাখি।”
"মাস্কের জন্য সেটা দেখতে পাইনি। একা থাকেন?”
“হ্যাঁ।”
"আমারও কেউ নেই। শুধু ফুড সার্ভিসের মেয়েটার সঙ্গে দিনে দুবার দেখা হয়।”
"এত মানুষ চারদিকে। তবু সবাই এত নিঃসঙ্গ কেন বলুন তো?"
"কী জানি।"
"প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছাড়া কিছুই তেমন টের পাই না আজকাল। শরীরে কেউ যেন ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে।”
"কী প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে না এবার?"
"হ্যাঁ। কলকাতায় নাকি বরফ পড়বে।”
“দেখা করবেন নাকি একদিন?”
“আমি কিন্তু এখন রিটায়ার্ড।” বলেই শব্দ করে হেসে ফেললেন অরুণিমা।
রক্তিম মহা অপ্রস্তুত, “আরে ছি ছি! তাই বললাম নাকি!”
অরুণিমার হাসি থামছেই না। খিলখিল করে হেসেই চলেছেন। রক্তিম লজ্জিত গলায় বলল, “আপনি ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি ওভাবে বলিনি কিন্তু।”
“আমি জানি,” হাসতে হাসতেই অরুণিমা বললেন, “আমি তো ইয়ার্কি মেরেই বললাম।”
“তবু, কথাটা আমার বলা উচিত হয়নি। বয়েস হচ্ছে।”
“এবার একটু বেশি বেশি হচ্ছে। এতটা ভদ্র হওয়াও কাজের কথা নয়।”
“ভদ্র বলায় আপত্তি আছে। অন্তত আমার প্রাক্তন স্ত্রী-র। লাজুক বলতে পারেন।”
“দুটো প্রায় একই জিনিস। দুটোই বেশি হলে ওভারথিঙ্কিং-এ পৌঁছে যায়।”
“বুড়োবয়েসে একটু ওভারথিঙ্কিং আসে। ছোকরাবয়েসে ওভারথিঙ্কিং আপত্তিকর হতে পারে। বুড়োবয়েসে খানিক স্বাভাবিকই।”
“তা ভুল বলেননি। বুড়োবয়েসে পুরনো মেমোরি ঘাঁটা আর ওভারথিঙ্ক করা - এই তো কাজ।”
“ঠিকই। কিন্তু বিষয়টা কষ্টকর। শুধু ফেলে আসা সময়ে বাঁচা যায় নাকি?”
“তাছাড়া উপায় কী। বর্তমানটাকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। সেটা এই সময়টারই দোষ নাকি বুড়ো বয়েসটার দোষ, কে জানে! আপনার কী মনে হয়?”
কী মনে হয়? ভাবার চেষ্টা করল রক্তিম। কিছুই মনে হচ্ছে না। কোনও প্রশ্নেরই এখন ঠিকঠাক উত্তর হয় না। সব প্রশ্নই এখন ওপেন এন্ড। অরুণিমাও সম্ভবত উত্তর চাইছেন না। কেউই আজকাল কোনও উত্তর প্রত্যাশা করেন না বোধহয়। প্রশ্ন এখন কথার বিন্যাসমাত্র।
“এখন তো সপ্তাহের প্রতিটা দিনই সমান," রক্তিম একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, "নাথিং হ্যাপেন্স। নোবডি কামস। নোবডি গোজ। পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গেলাম, চিনতে পারল না। আমার মেমোরি নেই তার কাছে। নাম ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে এলাম, এখনও ফোন বা মেসেজ কিছুই এল না। হয়তো প্রয়োজন নেই। আমি হয়তো তেমন দরকারি কেউ নই। শুধু শুধু মহামূল্য মেমোরি নষ্ট করা কেন?”
“প্রয়োজন ইজ আ বিচ,” অরুণিমা বললেন, “তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, ঠিকই আছে। ভালোই হয়েছে মানুষের লং টার্ম মেমোরির মেয়াদ কমে যাচ্ছে। কত অবাঞ্ছিত স্মৃতির হাত থকে রেহাই পাচ্ছি বলুন তো? যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই রাখছি। সেদিক থেকে দেখলে এটা প্রিভিলেজ নয়, বলুন?”
“কী জানি! সব মেমোরি হারিয়ে আমরা শিগগিরই একটা রক্তমাংসের পুঁটলি হয়ে যাব, এ.আই. ছাড়া চলতে পারব না, এটা ভাবলেও তো ভালো লাগে না। আর এরই মধ্যে, আপনি এলেন। ভাগ্যিস এলেন।”
খানিকক্ষণ দুজনেই আবার চুপচাপ। পুরনো দিনের ফোনকলে যেমন মৃদু একটা যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা যেত, এখনকার ফোনকলে তেমন শোনা যায় না। কোথাও আজকাল কোনও বাহুল্য নেই। সব কঠোরভাবে যথাযথ। ওপাশ থেকে যে শব্দটা পাওয়া যাচ্ছে সেটা সম্ভবত অরুণিমার শ্বাস। ভদ্রমহিলা কি নাক বা মুখের একেবারে সামনে ধরে আছেন ফোনটা? রক্তিম কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না। ভিতরটায় হালকা কাঁপুনি ধরছে। শীত বেড়ে উঠছে।
বেশ কয়েক মুহূর্ত পর অরুণিমার গলা শোনা গেল, “রক্তিমবাবু!”
"হুমম?”
“ফার্ন রোডে একটা নতুন ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁ খুলেছে। বিরাট এরিয়া। প্রচুর গাছপালা।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। প্রায় ছোটখাটো একটা জঙ্গল তৈরি করে ফেলেছে,” ঘন হয়ে এল অরুণিমা সান্যালের গলা, “এয়ার কোয়ালিটি ভালো। মাস্ক খুলে বসা যায়।”
শীতে কাঁপতে কাঁপতে রক্তিম বলল, “বলেন কী? দারুণ তো।”
“সো?”
“সো হোয়াট?”
“নতুন মেমোরি বানানো যাক, নাকি?”
[ঋণ : Black Mirror (Netflix), জীবনানন্দ দাশ, স্যামুয়েল বেকেট, ভাস্কর চক্রবর্তী]
….……………………..
অলংকরণ : বিবস্বান
অলংকরণে চিপের মাঝে ব্যবহৃত ছবি : René Magritte
#গল্প #Short Story #বাংলা গল্প #silly পয়েন্ট