নট অল মেন, কিন্তু...
দিনকয়েক আগে চোখে পড়েছিল একটা খবর। ওয়াশিংটন পোস্টে একটি সমীক্ষার খবর। একাধিক মেয়েকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ধরা যাক গভীর জঙ্গলে আপনি একা পড়ে গিয়েছেন। সেই পরিস্থিতিতে যে-কোনো একটি প্রাণীকে আপনি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। হয় একজন পুরুষ, অথবা একটি ভাল্লুক। আপনি কাকে বেছে নিতে চাইবেন?
আশ্চর্যের কথা হল, আটজনের মধ্যে সাতজন মেয়েরই ভোট গিয়েছে ভাল্লুকের দিকে। পুরুষ, নাকি বন্য জন্তু, গভীর জঙ্গলে কে বেশি নিরাপদ? মহিলারা বলছেন, ভাল্লুকই সই।
কেন ভাল্লুক? তার উত্তর এক-একজনের কাছে এক-একরকম। প্রথমেই একজন বলেছেন, পুরুষেরা ভীতিপ্রদ। আর-একজনের যুক্তি, যতদূর জানি, বিরক্ত না করলে ভাল্লুক তো তেড়ে এসে আক্রমণ করে না। কিন্তু পুরুষের থেকে যে বিনা প্ররোচনাতেও আক্রমণ আসা অসম্ভব নয়, সেই আশঙ্কার দিকেই ইঙ্গিত তাঁর। আর-একজন সে কথাই বলেছেন স্পষ্ট করে, যে, কোনও ভাল্লুক কী করতে পারে, সে কথা তো জানি। কিন্তু কোনও পুরুষ, এমনকি চেনা হলেও, আকস্মিক পরিস্থিতির সুযোগ নেবেন কি না, তা তো জানি না। বস্তুত, আমরা মেয়েরা সকলেই কি কমবেশি দেখিনি, হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেলে চেনা মুখগুলো কেমন বদলে যায়? কেবল অচেনা লোকের অবাঞ্ছিত স্পর্শই কি আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে, কখনও কোনও ‘বন্ধু’র অন্যরকম স্পর্শ বিব্রত করেনি? এমনকি সজ্জন বিদ্বান বলে খ্যাত কতজনের প্রতি শ্রদ্ধাকে ঘৃণায় বদলে দিয়েছে ‘মি টু’ মুভমেন্ট। আবার এ কথাও তো আমরা জানি, সেই হেনস্থার অভিযোগ প্রকাশ্যে এলেও আরও অনেকগুলো আঙুল প্রথমেই নিশানা করে অভিযোগকারিণীর দিকে। সে ওই সময়ে ওখানে কী করছিল। সে কী পরে ছিল। সে ধূমপান কি মদ্যপান করে কি না। পুরুষ বন্ধু আছে কি না। ওই পুরুষের সঙ্গে তার কতদিনের যোগাযোগ, আর আগে থেকেই যোগাযোগ থাকলে, বিশেষ করে বন্ধুত্ব থাকলে এখন খামোখা চেঁচামেচির কী আছে... প্রশ্ন, প্রশ্ন, প্রশ্ন। প্রশ্ন ওঠে সে কেন পুরুষটির সঙ্গে একা ছিল, অথচ পুরুষটি কেন মেয়েকে একা পেতেই গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার জারি করে বসল, সে প্রশ্ন তলিয়ে যায় কোথায়! তাই এক মহিলা ভাল্লুককে বেছে নিয়ে বলছেন, অন্তত ভাল্লুকের হাতে আক্রান্ত হলে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। কেউ বলছেন, ভাল্লুক আক্রমণ করলে মানুষ অন্তত বিশ্বাস করবে। কেউ জিজ্ঞেস করবে না, মেয়েটি ভাল্লুককে সিডিউস করেছিল কি না। ভাল্লুকের সঙ্গে ‘দর কষাকষি’-র ঝামেলা নিয়ে কোনও নেতানেত্রী মুখরোচক গল্প বানাবেন না। কিংবা, যে-কোনো যৌন হেনস্থা বা ধর্ষণের পর যেমন মেয়েদের উদ্দেশে উপদেশের বন্যা বয়ে যায়— পালটা মার দিতে হত, কারাটে শিখতে হত, ব্যাগে অস্ত্র রাখতে হত ইত্যাদি প্রভৃতি; অন্তত ভাল্লুকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য তেমন কোনও গাইডবুক আসবে না বলেই আশা করছেন মেয়েরা।
হ্যাঁ, পুরো প্রশ্নোত্তরের প্রক্রিয়াটিই একটি কাল্পনিক পরিস্থিতির উপর ভর করে আছে। কিন্তু কোনও কাল্পনিক পরিস্থিতিতেও নির্বাচনের সুযোগ পেলে মেয়েরা যে পুরুষের সাহচর্যকে নাকচ করছেন, সেই মানসিক পরিস্থিতি একান্ত বাস্তব। তার দিকে চোখ ঠেরে থাকলেই মেয়েদের বিপন্নতার পরিস্থিতিটিকে নাকচ করা যায় না। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁরা আসলে কোনও আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে নীতিপুলিশির অভ্যাসটিকেও চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। অথচ, সেই সমীক্ষার কমেন্টবক্সেই দেখছিলাম, বেশিরভাগ পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘নট অল মেন’ তত্ত্ব নিয়ে। পুরুষবিদ্বেষ থেকে নারীবাদ, সবকিছুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু সেই বিপন্নতাকে অনুভব করতে চাননি। বন্য জন্তুর হাত থেকে কী কী আক্রমণ আসতে পারে, তার তালিকা ধরিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, মেয়েরা আদতে নির্বোধ। আচ্ছা, এই যে মেয়েরা বন্য জন্তুর আক্রমণের কথা জানে না ধরে নেওয়া হচ্ছে, এই ম্যানস্প্লেনিং-ও কি একরকম নির্বুদ্ধিতা নয়? অথচ মজার কথা হল, এক পুরুষকে যখন তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করছেন, তাঁদের মেয়ের ক্ষেত্রে তিনি কোন পরিস্থিতি বেছে নিতেন, ভেবেচিন্তে সেই পুরুষও ভাল্লুকের দিকেই সায় দিচ্ছেন। অথচ ভাল্লুক না মহিলা, এই নির্বাচনে নির্দ্বিধায় ভোট দিচ্ছেন মহিলাকে।
বন্য জন্তুর হিংস্র স্বভাবের কথা জেনেও যে মেয়েরা পুরুষের বদলে তাকে বেছে নিচ্ছেন, তার পিছনে পুরুষের দীর্ঘ নির্যাতনের ইতিহাসকে না ভেবে দেখলে কি চলে? রাষ্ট্রসংঘের তথ্য জানায়, তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা তাঁর সঙ্গী অথবা অপরিচিত পুরুষের হাতে যৌন হেনস্থা বা হিংসার শিকার হন। গোটা পৃথিবীর নিরিখে সে সংখ্যাটা মোটামুটি সাড়ে ৭৩ কোটি। শুধু ২০২২ সালেই এইভাবে খুন হয়ে গিয়েছেন নানা বয়সের ৮৯ হাজার মেয়ে। ‘নট অল মেন’ যুক্তির সমস্যা হল, তা নিজের উপর থেকে অভিযোগের তির সরাতে এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ‘আ লট অফ মেন’-এর ইতিহাসকেও অস্বীকার করে বসে।
আর জি কর-এর ঘটনার পরে যেভাবে মেয়েদের ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ মুভমেন্ট ফিরে এসেছে, যেভাবে মেয়েরা অর্ধেক আকাশের অধিকার দাবি করছেন, সেখানে ‘আ লট অফ মেন’-এর ইতিহাস আর ‘আ লট অফ উইমেন’-এর নির্যাতনের ইতিবৃত্ত জড়িয়ে গিয়েছে। নিজের একান্ত চেনা পরিসরে, সরকারি কর্মক্ষেত্রেও যে একটি মেয়েকে তার সরকার, তার রাজ্য, তার দেশ নিরাপত্তা দিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ, সেই তুমুল নিরাপত্তাহীনতা সমস্ত মেয়ের বিপন্নতার মূল ধরে টান দিয়েছে। মনে পড়ে গিয়েছে বাড়িতে কোনও আত্মীয়ের আদর করার ঘিনঘিনে স্মৃতি। মনে পড়ে গিয়েছে বাড়িতে কি বাইরে বাথরুমে উঁকি দেওয়া মুখগুলো। মনে পড়েছে একান্ত বিশ্বস্ত পরিসরে দীর্ঘদিনের কোনও বন্ধুর আচমকা অস্বস্তিকর ছোঁয়া। মনে পড়েছে প্রেমিকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘনিষ্ঠতা। মনে পড়েছে রাস্তায় ট্রেনে বাসে যৌনগন্ধী মন্তব্য বা আক্রমণের স্মৃতি। কালেক্টিভ সাইকিতে এই যে বিপন্নতার বয়ান রয়েছে, সেখান থেকে কোনও মেয়ে যদি তার চেনা পুরুষের উপর থেকেও ভরসা হারিয়ে বসে, তার দায় কি তারই? মেয়েরাই মার খাবে, ধর্ষিতা হবে, আবার মেয়েরাই পোশাকে-আশাকে-চলায়-বলায় পুরুষকে ‘উত্তেজিত’ না করার নির্দেশিকা মেনে চলবে, অথবা পালটা মারার জন্য কারাটে শিখবে, পেপার স্প্রে কিনবে; মেয়েরাই বিপন্ন হবে, আবার মেয়েদেরকেই সেই বিপন্নতা কাটিয়ে উঠতে হবে— বলি, সব দায়ই কেবল মেয়েদের এমন দাসখত লিখে দিল কে?
এই খবরটা আমায় যে জানিয়েছিল, ঘটনাচক্রে লিঙ্গপরিচয়ে সে মেয়ে। অথচ কপি ব্রিফ করার পর দেখা যায়, একজন ছাড়া প্রত্যেক পুরুষের মতামত ভাল্লুককে নির্বাচন করা মেয়েদের বিপক্ষে। উলটোদিকে সেখানে থাকা আর-একজন মেয়ের ভোট কিন্তু ভাল্লুকের দিকেই গিয়েছিল। আশ্চর্যের কথা হল, এই পরিসরে যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তারা প্রত্যেকেই কমবেশি সংবেদনশীল। নারীর অর্ধেক আকাশের অধিকারকে তারা শুধু স্বীকার করে তা-ই নয়, যাপনেও তা মেনে চলে অধিকাংশই। কিন্তু তাদের বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না, কেন রাতে বাড়ি ফেরার সময় ফাঁকা রাস্তায় ভয় করে, আবার সেই রাস্তায় একটিমাত্র পুরুষ দেখলে আরও বেশি আশঙ্কা হয়। গভীর রাতে অঝোরে বৃষ্টি হলে কোনও শেডের তলায় অনেক মেয়ের সঙ্গে একা দাঁড়াতে যে পুরুষটি অস্বস্তি বোধ করবেন না, তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেন পরিস্থিতিটা উলটে গেলে একটি একা মেয়ে পুরুষদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে স্বস্তি পাবে না। এই না-বুঝতে-পারা আমায় এতটাই আশ্চর্য করেছিল যে পরে বন্ধুদের আড্ডাতেও এই প্রসঙ্গ তুলে এনে দেখি। খুব আশ্চর্যের, সেখানেও সিনারিও বিশেষ পালটায়নি। ততক্ষণে এই না-বোঝায় এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে সঙ্গীর বিপরীতধর্মী অবস্থান দেখেই বরং নতুন করে আশ্চর্য হতে হয়েছিল।
যে পুরুষেরা অনেকটা বুঝেও এই বিপন্নতাকে বুঝতে পারছিলেন না, আর জি করের নারকীয় ঘটনা হয়তো সেই বিপন্নতাকে চিনতে সাহায্য করবে তাঁদের। বড্ড বেশি দামে, এই যা।
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ
অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত
চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী