নিবন্ধ

মেয়েদের কর্মবিরতি নেই, মিঃ নারায়ণ মূর্তি?

রণিতা চট্টোপাধ্যায় Nov 3, 2023 at 4:42 am নিবন্ধ

যক্ষপুরীর আঁধার গহ্বর থেকে দিনরাত তাল তাল সোনা তুলে আনাই তাদের কাজ। কাজে ফাঁকি দিলে পিঠে পড়ে চাবুক, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। এই ‘ওরা’-পক্ষ থাকে জালের আড়ালে, তাদের চোখে দেখা যায় না, তবে কানে শোনা যায় নির্দেশ। সেই বিধান মেনেই রোজ মাটির নিচে নিজেদের সমস্ত প্রাণশক্তি ঢেলে দিতে হয় তাদের। তাদের নাম নেই, ধাম নেই। ছিবড়ে হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর কপালে একদিন ছুটি জুটে গেলে হয় আরও বেগতিক, সকাল থেকেই কড়া মদের নেশায় ভুলিয়ে রাখতে হয় নিজেকে, পাছে মনে পড়ে যায় কী হারিয়েছে।

গল্প, না? যক্ষপুরী, জালের আড়াল… এ যেন রূপকথার গল্পের মতোই। এবার এই সময়ে ফিরে আসুন। যে কোনও একটা বেসরকারি অফিসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তাকিয়ে দেখুন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর দিকে কিংবা অতিসাধারণ কল সেন্টারের দিকে। সারি সারি কম্পিউটারের সামনে সারি সারি মানুষ। যাদের টার্গেট রিচ করার জন্য দৌড়ে যাচ্ছে লাগাতার, সেই সংস্থার কাছে এমপ্লয়ি কোড ছাড়া তাদের আরও কোনও পরিচয় নেই। তাকিয়ে দেখুন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দিকে, একই হাল। তাকিয়ে দেখুন হাতে বুম বা ক্যামেরা ধরা, কিংবা কপি লিখে যাওয়া কোনও সংবাদকর্মীর দিকে। এমার্জেন্সি সার্ভিসের খুড়োর কলের সামনে নাকচ হয়ে গিয়েছে যাদের ছুটি থেকে ব্যক্তিগত জীবন। এবার বলুন, গল্প আর জীবনের মাঝে থাকা জালটা ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে না?

নারায়ণ মূর্তি আসলে এই জাল সরিয়ে দেওয়ার কাজটাই করেছেন। এতদিন ধরে দেশের বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে যে প্রবণতা লুকোছাপা করে বেঁচে ছিল, তিনি স্রেফ তার আড়ালটা সরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করাই দস্তুর। ৫ দিন ৮ ঘণ্টা করে কাজের আন্তর্জাতিক নিয়ম, ওসব শিকেয় তুলে রেখে দেশকে চাঁদে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সবাইকে আদাজল খেয়ে লেগে পড়তে হবে। আহা, নিজের জন্যে তো আর বলেননি। বলেছেন দেশের, দশের ভালোর কথা। মাহিন্দ্রার সিইও তো আরও একধাপ উপরে। তাঁর বক্তব্য, আসলে ৭০ ঘণ্টার মধ্যে ৪০ ঘণ্টা কাজ দেশের জন্য, যেমনটা আপনারা করেই থাকেন। আর বাকি ৩০ ঘণ্টা কাজ তো নিজের উন্নতির জন্যই। হর্ষ গোয়েঙ্কা আরও কায়দা করে বলছেন, ৫ দিন অফিসে যেতেই হবে, ওসব মান্ধাতার আমলের নিয়ম। বাড়িতে হোক, বেড়াতে গিয়ে হোক, যেখানে ইচ্ছে বসে কাজ করুন। তবে, কাজ করুন। 

তা শিল্পপতিদের এহেন বক্তব্য নিয়ে সংগতভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন কর্পোরেট জগতের কর্মীরা। ক্ষোভ হওয়ারই কথা। কিন্তু কথাটা হল, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক কোন বেসরকারি সংস্থা ওই ৫ দিন ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়মটি পালন করে, বলুন তো? সপ্তাহে ৬ দিন কাজ, ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ, এমনটা তো এখানে জলভাত হয়ে গেছে কবে থেকেই। অফিস থেকে বাড়ি পর্যন্ত কাজ গড়ানোর পথও হরবখত খোলা। আর সে কাজ তো করতেই হবে, কেন-না কবি বলে গিয়েছেন, ‘মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’। তা সেই এক্সট্রা মাইল যে কোথায় গিয়ে থামবে, সে কথা সংস্থাও ভাবে না, কর্মীরাও ভাবেন না। ভাবেন না, কারণ ভারতীয় কর্মসংস্কৃতির মালিক ও শ্রমিক, দুপ্রান্তে থাকা লোকই কর্মীদের স্রেফ ‘রিসোর্স’ বলে মনে করে। একেবারে ‘রক্তকরবী’-র ওই ‘রাজার এঁটো’-দের মতোই, যাদের মন পর্যন্ত নিংড়ে নেওয়া যায়। 

নারায়ণ মূর্তির কথার পর যাঁরা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেলেন, তাঁরা বোধহয় এতদিন মূর্তিপূজার ছলেই এই রিসোর্স-সংস্কৃতিকে ভুলে ছিলেন। শুধু তাই কি? নাকি, এ অভ্যাস তাঁদেরও সযত্নলালিত? কর্মক্ষেত্রের বাইরে, পরিবারের মধ্যেও মানুষকে এই রিসোর্স ভাবার প্রবণতা কি একেবারে নেই? একাধিক শিল্পপতির বয়ানের মধ্যে এক মহিলা সিইও চমৎকারভাবে সেই ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন। তবে বক্তা আর বক্তব্য দুই-ই মহিলাকেন্দ্রিক বলেই হয়তো, তা নিয়েও কেউ বিশেষ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আসলে নারায়ণ মূর্তির মন্তব্যের পর যাঁরা শ্রমনীতি নিয়ে সরব হয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য করে এডেলওয়াইজ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও রাধিকা গুপ্তা বলে বসেছেন, ৭০ ঘণ্টা কাজ করা অমানবিক বুঝি? তাহলে মেয়েদের সারাদিন ধরে কাজ করে যাওয়া নিয়ে কথা হয় না কেন? সেখানে তো কোনও বিতর্ক উঠতে দেখা যায়নি এতদিন। 

মিঃ নারায়ণ মূর্তি, আপনার স্ত্রী অবশ্য ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন সপ্তাহে ৭০-৮০ ঘণ্টা কাজ একসময়ে তিনিও করেছেন, তাঁর স্বামীর বক্তব্যে ভুল কিছু নেই। তবে আমরা জানি না, তিনি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলে আপনি তাঁর হাতেই চা খাওয়ার বায়না ধরতেন কি না। আপনিও বোধহয় জানেন না, এই দেশে ‘গড়পড়তা’ গৃহবধূ থেকে উচ্চপদস্থ অফিসার বউ, অনেককেই এমন বায়না সামলাতে হয় নিত্যদিন। বাড়ির বউকে তাঁরা ‘চাকরি করতে দেন’ বটে, কিন্তু একইসঙ্গে আবার ‘কাজের লোকে’র হাতের রান্না খেতে পারেন না। ফ্রিজে রাখা বাসি খাবারও না। তাই এ দেশের কর্মরতা মেয়েদের অধিকাংশকে সকালে বাড়ির সব দায়িত্ব পালন করে, কর্মক্ষেত্রের সব কাজ সামলে, আবার বাড়িতে ফিরে শাড়ি না ছেড়েই রান্না চাপাতে হয়। উপরিও জোটে বইকি, অফিসে দেরি হলে বসের টিপ্পনী আর বাড়ি ফিরতে দেরি হলে পরিবারের মুখভার। স্বামী চাকরি করার পরেও মেয়েদের কেন টাকার পিছনে ছুটতে হবে, পরিবার থেকে এই প্রশ্ন ওঠে; আবার কোনও কোনও পুরুষ সহকর্মী অম্লানবদনে বলে বসেন, তোমাদের চাকরি তো গয়না কেনার জন্যে! মেয়েদের কাজে নিতে অনেক কর্তৃপক্ষেরই এখনও পরোক্ষ আপত্তি কাজ করে— পাছে তাঁদের ঋতুকালীন কিংবা মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হয়। মহিলা কর্মীর প্রোমোশন হলে সহকর্মীদের একাংশ বলেন, রূপের জোর। তাই অনেক কর্মরতা মহিলাই আক্ষেপ করে জানান, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য অনেকসময়ই বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের, নিতে হয় বেশি দায়িত্ব পালনের ভার। ‘মানবীজার্নাল’ নামে একটি কবিতায় চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন একটি মেয়ের সারাদিনের চব্বিশ ঘণ্টার বিবরণ। যে বাচ্চার টিফিন ভরে রেখে অফিসে যায়। সন্ধেতে স্বামীর বন্ধুকে রেঁধে খাওয়ায়। তার ছুটি নেই। কাজে বেরোনোর আগে বা পরে ঘর গোছানো থেকে সন্তানের দায়িত্ব পালন-- এর একটা বড় অংশ, কখনও কখনও আবার সবটাই যে মেয়েদের উপরেই ন্যস্ত, সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। এমনকি কর্মসহায়িকা থাকলেও তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে বাড়ির গৃহিণীকেই, তা তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন। যে দায়িত্বে বিচ্যুতি ঘটলে ধেয়ে আসে কাজে অবহেলার অভিযোগ। সে অভিযোগের মুখোমুখি হতে ভয় পান অনেক প্রতিষ্ঠিত নারীও। যার ফল দাঁড়ায় ঘরে আর বাইরে মেয়েদের লাগাতার কাজ করে চলা-- যে কাজের মোট সময়টা আদতে কোনও কর্মনীতিরই ধার ধারে না। ভারতের সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ আমলা যশোধরা রায়চৌধুরী আবার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়েও দ্বিধায় পড়েন, পাছে কেউ নালিশ জানানো কিংবা ভিক্টিম কার্ড খেলার অভিযোগ তোলে! তার মধ্যে থেকেও টুকরো টুকরো জানা হয়ে যায় মেয়ের পরীক্ষার সময় ছুটি নিতে চাইলে বসের মুখঝামটা, দূরের রাজ্যে অফিস সামলানো আর নিজের যাযাবর আস্তানা সামলানোর পাশাপাশি বাড়ির চাল-ডালের হিসেব রাখা, ফোনে বরের জ্যাকেট খুঁজে দেওয়া কিংবা মেয়ের জ্বর হলে শাশুড়ির স্তোকবাক্য ‘মা দুষ্টু, আপিস গেছে’... নারায়ণ মূর্তিকে কটুকাটব্য করে চলা প্রতিবাদীরা এই মেয়েদের কথা জানতেন না, সত্যিই? আরেক আইএএস অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখেছেন, দুর্নীতি ধরার শাস্তিতে বদলির অর্ডার এসেছিল, যখন তাঁর সন্তানের ভূমিষ্ঠ হতে মাত্র একমাস বাকি। লিখেছেন, একসময় রাজধানী থেকে ছশো কিলোমিটার দূরের জেলায় দায়িত্ব নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী-- “কোলের শিশুকে রেখে চলে গেলাম, পুরুষের সঙ্গে নিজের সমকক্ষতা প্রমাণ করতে? সমকক্ষ হতে গেলে যে দ্বিগুণ হতে হয়, সেই শিক্ষা পেলাম সাড়ে তিন দশক ধরে।” (রোদবাতাসের পথ) আপনি শুনছেন, মিঃ নারায়ণ মূর্তি?

গৃহশ্রমের বাইরে যে নারীরা সরাসরি আর্থিক পারিশ্রমিক পাওয়ার মতো কাজে যুক্ত, তাও রীতিমতো হোয়াইট-কলার জবে নিযুক্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেই সপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টা কাজের হিসেব বরাদ্দ থাকে না। কৃষকরমণী, শ্রমিকবস্তির কামিনদের ক্ষেত্রে তো সময়ের হিসেব, সমান মজুরি, মাতৃত্বের ছুটি, সবই সোনার পাথরবাটি। আর বাকি রইলেন যেসব কর্মহীন নারী? সত্যি বলতে, নারীর গার্হস্থ্য শ্রম নিয়ে রক্ষণশীলদের তো মাথাব্যথা নেই-ই, এমনকি যারা সমাজে সাম্য আনার কথা ভাবেন তাঁদের চিন্তা থেকেও সে কথা হারিয়েই যায়। “গৃহশ্রমে মজুরি নেই বলে/ মেয়েরা কেবল বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে?/ আর কমরেড শুধু যার হাত কাস্তে হাতুড়ি?” (আপনি বলুন, মার্কস) কবিতায় এ প্রশ্ন তুললে মল্লিকা সেনগুপ্তকে ‘নারীবাদী’ ট্যাগ লাগিয়েই তাঁরা হাত ধুয়ে ফেলেন। অথচ গৃহশ্রমের পিছনে জীবনের অনেকখানি সময় ব্যয় করে ফেলতে হয় এ দেশের অধিকাংশ মহিলাকেই। দেশের জিডিপি কমে যাওয়ার আবহে স্টেট ব্যাঙ্ক সম্প্রতি দাবি করেছিল, মেয়েদের অবৈতনিক কাজের অর্থমূল্য যোগ করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে দেশের মোট জিডিপি-র সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ মেয়েদের বিনাশ্রমে কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করলে দেশের জিডিপির হারের খানিক উন্নতি ঘটতে পারত বলেই জানিয়েছিলেন গবেষকেরা। যাঁদের ‘অফিস’ ২৪*৭ খোলা রাখতে হয় আর তারপরেও শুনতে হয় ‘খেটে রোজগার করার মর্ম কী বুঝবে’, তাঁদের জন্য আপনাদের প্রতিবাদ কি কোনও দিন দানা বেঁধেছিল, প্রতিবাদী বন্ধুরা? তাহলে আজ নারায়ণ মূর্তি যা বলছেন, যা ভাবছেন, আপনারাও কি এতদিন সেই ভাবনারই শরিক হয়ে ছিলেন না? তাও তো গিগ ওয়ার্কারদের কাজের সময় নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলিনি, তেমন প্রশ্ন তুলিনি লোকাল ট্রেনের সেইসব মাসিপিসিদের নিয়েও। রাত থাকতে উঠে যারা অনেকগুলো পেটের ভাত জোগাতে শহরে ছোটে চালের পুঁটলি কি সবজির বস্তা নিয়ে, আর বাড়ি ফিরে স্বামীর হাতের মার মেখে নিজের রান্না ভাত মুখে তোলে, তাদের ৭০ ঘণ্টা কাজে দেশের কোনও উন্নতি হয় না, মিঃ নারায়ণ মূর্তি?

মিঃ নারায়ণ মূর্তি, আমি ভারতবর্ষের সেই মুষ্টিমেয় মেয়েদের একজন, যে নিজের উপার্জনে সম্পূর্ণ নিজের একখানা মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাতে পেরেছে। অফিসের সময় হয়ে গেলে যেখানে সে অনায়াসে ঘরের পোশাক ছড়িয়ে রেখে, এঁটো প্লেট সিংকে নামিয়ে দরজা টেনে বেরিয়ে যেতে পারে (এ কথা লিখতে গিয়েও ভাবছি, কে আবার কী মনে করল বুঝি! মেয়েদের ‘লক্ষ্মী’ হওয়ার চাপ ঠিক কতখানি, আপনি জানেন, মিঃ নারায়ণ মূর্তি?)। কিন্তু আমার প্রৌঢ়া মা যখন ৫০-৫৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে এ বাড়িতে চলে আসেন, তিনি প্রতি মুহূর্তে বাড়ি গুছিয়ে চলেন। ওয়ার্ডরোবের কোনা থেকে, কার্পেটের নিচ থেকে, সবজির বাস্কেট থেকে টেনে টেনে বের করে আনেন কাজ। কেন-না আপনাদের সমাজ তাঁকে ‘ছুটি’ শব্দটা শেখাতেই চায়নি।

আমার মায়ের কর্মবিরতি হবে না, মিঃ নারায়ণ মূর্তি? 


................

#N. R. Narayana Murthy #Work Culture #Gender Equality #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

3

Unique Visitors

219597