নিশি রাত বাঁকা চাঁদের কবি : গীতিকার প্রণব রায়
নজরুল-উত্তর আধুনিক বাংলা গানের কথায় প্রথম দিকপাল প্রণব রায়। নজরুলের স্নেহধন্য এই গীতিকার বাংলা গানে এক নতুন যুগের সূচনা করে গেছেন। রেখে গেছেন অজস্র জনপ্রিয় গান, যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে গানের কথাই শুধু না, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
প্রণব রায়ের জন্ম ১৯১১ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতায়। পিতার নাম দেবকুমার রায়চৌধুরী। পরিবারে গানের আবহ ছিল। কমবয়েসেই বাজাতে শিখেছিলেন অরগ্যান ও পিয়ানো। কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সিটি কলেজে ভর্তি হন। নজরুলের কাছে প্রতি রবিবার গান শেখার সুযোগ পান। সাহিত্যচর্চার আগ্রহ ছিল শুরু থেকেই। ফলে গানশিক্ষার পাশাপাশি লেখালিখিও চলতে থাকে। লেখায় ছিল চড়া ব্রিটিশ-বিরোধিতার সুর। 'বিশ্বদূত' পত্রিকায় তিনি 'কমরেড' শীর্ষক এক কবিতা লেখেন এবং সেজন্য তাঁকে কারাবাস করতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর নজরুলের ফরমায়েশে প্রথমবার গান লেখার জন্য কলম ধরেন। নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির চিফ ট্রেনার। তাঁর রচিত চারটি গান কাজী নজরুল ইসলামের অনুমোদনে ১৯৩৪ সালে শারদীয় হিজ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ডে প্রথম প্রকাশিত হয়। তুলসী লাহিড়ীর সুরেও কথাযোজনার সুযোগ পান। এরপর থেকে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বন্ধু, সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তৈরি হয়ে যায় প্রণব রায়ের অমর জুটি। তাঁর কথায় ও কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ ও ‘আমি ভোরের যূথিকা‘ গান দুটি যূথিকা রায়ের কণ্ঠে প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। এতে যূথিকা রায় যেমন জনপ্রিয় শিল্পী হিসাবে পরিচিতি পান, তেমনি গীতিকার হিসাবে প্রণব রায় এবং সুরকার হিসেবে কমল দাশগুপ্তও খ্যাতি অর্জন করেন। কমল-প্রণব জুটি একের পর এক উপহার দেয় বহু স্মরণীয় গান। ১৯৩৬ সালে তাঁরা প্রথম ছায়াছবিতে কাজ করেন। ছবির নাম 'পণ্ডিতমশাই'। এরপরেই কিংবদন্তী গায়ক-সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র দে ও সুরসাধক হিমাংশু দত্তের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে। ১৯৪১ সালে পরিচালক নীতিন বসু ও সুরকার রাইচাঁদ বড়াল 'পরিচয়' নামে একটি ছবির জন্য রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি গান লেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখতে সম্মত না হয়ে প্রণবের নাম প্রস্তাব করেন। এই অভূতপূর্ব সুযগের সদ্ব্যবহার করেন প্রণব। রাইচাঁদের সুরে সায়গল সাহেবের গলায় সেই গান তাঁকে এক আলাদা সম্মান এনে দেয়। ১৯৪২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া-কাননদেবী অভিনীত ছবি 'শেষ উত্তর'-এর জন্য লিখলেন বিখ্যাত গান 'আমি বনফুল গো'। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া এই মানুষটি কাননদেবী, যূথিকা রায় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের আশা ভোঁসলে , শ্যামল মিত্র, অনুপ ঘোষালের মতো বহু বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠের জন্য গান লিখেছেন। পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করে গেছেন প্রবাসী, কল্লোল, ভারতবর্ষের মতো পত্রিকায়। বসুমতী পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও সামলেছেন কিছুদিন। কবিগুরু ও কাজীসাহেব ছাড়াও স্নেহ পেয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ছায়াছবির জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন। বিখ্যাত কৌতুক ছবি 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট'-এর চিত্রনাট্য তাঁরই রচনা। নিজে ছবি পরিচালনাও করেছেন। পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি 'রাঙামাটি'। পরে কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজ তৈরি করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করার আগেও তাঁর হাতে জমে ছিল এগারোটি ছবির কাজ।