অগাধ জীবনের কথকতা : প্রতিভা সরকারের 'সদাবাহার'
প্রতিভা সরকারের একটিমাত্র উপন্যাসের খোঁজ আমি পেয়েছি। ‘মানসাই’। সেটা আমার পড়া হয়নি। তবে তাঁর দুটো গল্পসংকলন পড়ে আমার মনে হয়েছে ছোটগল্প শিল্পরূপটাই তাঁর নিজের খাসতালুক। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের যেমন বাদাবন, রাফায়েল নাদালের যেমন ক্লে-কোর্ট, তৃণমূলের যেমন ভবানীপুর। এই মাঠে তিনি নেমেছেন বিপুল, বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিয়ে। অবশ্য দেখার পরিধি বড় হলেই তো আর সবাই চক্ষুষ্মান হন না। প্রতিভা সরকারকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে তাঁর অতল অনুভবী মনন আর নিবিড় ডিটেলিং। ছোট ছোট হারজিত, আপস, রিপুর সূক্ষ্ম তাড়না চমৎকার মূর্ত হয় তাঁর কলমে। আপাত-অদৃশ্য সব সামাজিক আধিপত্যের নকশা অনায়াসে বেআব্রু হয়ে পড়ে। অসম্ভব শক্তিশালী তাঁর পরোক্ষ বাচনের ব্যবহার। নির্মেদ, ধারালো তাঁর ন্যারেটিভ; যা প্লটের প্রয়োজনে অ্যাক্সিলিয়েটরে চাপ দিতে বা ছাড়তে সমান স্বচ্ছন্দ। একেকটা আকাঁড়া নতুন উপমা সটান বুকে এসে বিঁধে ছিটকে দেয় রক্ত। এবং তাঁর নির্লিপ্তি। সংযম। যা দেখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মান্টোর কথাও। এলিয়ট যাকে বলেছিলেন ‘Depersonalization’, তার এত সার্থক উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ের কথাসাহিত্যে খুব বেশি চোখে পড়েনি আমার।
'সদাবাহার' আমার পড়া প্রতিভা সরকারের প্রথম বই। প্রথম দু-তিনটে গল্প পড়েই বড় আক্ষেপ হয়েছিল, তাঁকে খুঁজে পেতে অনেক দেরি হয়ে গেল বলে। তারপর জানলাম আমার দোষ নেই তেমন। লেখালিখিতে নিয়মিত হতে তিনি দেরি করেছেন যথেষ্ট। অবশ্য দেরি করেছেন বলেই বোধহয় তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও গল্পগুলো নির্মাণের দিক থেকে এত অবিশ্বাস্য রকমের শিথিলতাহীন। এ-বইয়ে চোদ্দটা গল্প রয়েছে। গল্পের শেষে পত্রিকা/ওয়েবজিনের নাম থাকলেও প্রকাশকাল নেই। ফলে ঠিক কতটা সময়পর্ব জুড়ে গল্পগুলো লেখা, তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের আঁতের কথা আর প্রান্তিক মানুষের ভুবন - প্রতিভা সরকারের আখ্যানবিশ্বে দুই-ই হাজির। লেখক নিজে অবশ্য এককথায় এদের একই গোত্রে রাখতে চেয়েছেন। ‘সাধারণ মানুষ।’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি তাঁর ‘সাবজেক্ট’-দের বিষয়ে বলছেন - “দধীচির হাড়ে তৈরি আশ্চর্য সব মানুষ, সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যাদের লড়াই লাগাতার, যে বাঁচে জীবনের ফাঁকফোকর নিয়েই,…।” সত্যিই এতরকম মানুষের ছবি এসেছে এই গল্পগুলোয় যে প্রতিভা সরকারের মুখে দিব্যি মানাবে সেই বিখ্যাত উক্তি - “Nothing human can be alien to me”। সাহিত্য-সমালোচনায় 'Naturalism' নামে একটা সাহিত্যিক মতবাদের কথা বলে থাকেন কেউ কেউ। তরল করে বললে, রিয়ালিজমেরও এক কাঠি ওপরে যে-রিয়ালিজম, সেটাই ন্যাচারালিজম। রবীন্দ্রনাথ এর বাংলা নাম দিয়েছিলেন 'যথাস্থিতবাদ'। এই বইয়ের বেশ কিছু গল্পকে সেই ব্র্যাকেটে রাখা চলে। আমি পরপর গল্প ধরে প্রথামাফিক আলোচনায় যাচ্ছি না। গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে ঝিকিয়ে ওঠা কিছু উদ্ভাস কথায় ধরে রাখার চেষ্টা করছি মাত্র।
'চড়াই পাখির মাংস' এখানে আমার সবচেয়ে ভালোলাগা গল্প। গল্পের পর গল্প সাজিয়ে এ-গল্পের কায়া গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে পারিবারিক কাঠামোয় পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ধারক-বাহক হয়ে থেকেছেন মহিলারাই, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় কই! "মেয়েদের ছোটো ছোটো সুখের ঘেঁটি মুচড়ে না দিলে মায়ের বলা গল্পদের শান্তি হত না"। এ-লাইন বহুকাল আমার মনে থেকে যাবে। মালা-ডি, দেবী আর সর্পগন্ধা জটিল মনস্তত্ত্বের গল্প। নারীর গল্প। 'মালা-ডি' প্রথম কয়েক লাইন পড়েই তারাশঙ্করের 'নারী ও নাগিনী'-র পথে এগোবে বলে ভেবে নিয়েছিলাম। প্রতিভা সরকার অন্য এক স্তর উন্মোচিত করলেন। ছিঁড়ে যাওয়া তারে টান পড়ার অপূর্ব এক আখ্যান 'ভাইবোন'। চীন-যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প 'কোর্ট মার্শাল' আর মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরের টানাপোড়েন নিয়ে গল্প 'দাঙ্গা-পরবর্তী'। এই দুটি গল্পেই ঘটনাপ্রবাহ অপ্রাপ্তবয়স্কের চোখে দেখানো হয়েছে। প্রথমটির ফোকাস অচরিতার্থ প্রেমে, পরেরটিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ক্লেদ-মালিন্য পেরিয়ে আরও বড় দিগন্তের দিকে তাকাতে শিখছে বাচ্চা মেয়েটি।
'ফাঁসি কা ফান্দা' আরেকটা চমকে দেবার মতো গল্প। বক্সার সেন্ট্রাল জেলের টাওয়ার থেকে বাইরে গঙ্গায় শয়ে শয়ে লাশ ভেসে যেতে দেখে পেগলে যায় কয়েদি মুন্নু। করোনায় মৃত সব মুর্দার মুখে নিজের আদল দেখতে পায় সে। এত বড় রাষ্ট্রীয় অপরাধের কী করে স্বাভাবিকীকরণ ঘটে যায়, বুঝে উঠতে পারে না সে। ‘সীমানা’ গল্পে বুড়ির হঠাৎ কান্না পেয়ে যায় বালবাচ্চাসমেত ইঁদুরের জন্য। সে ভুলে যায় ইঁদুরের দৌরাত্ম্যের কথা। আগাছা-বেষ্টিত জীর্ণ ঘরে ছেঁড়া কাঁথা গায়ে খাঁ খাঁ করে ওঠে তার ভয়ংকর একাকীত্ব। 'খাটা পায়খানা' গল্পের ধাঙড় তিলোয়া যখন বালক রঙ্কিনাথকে বারণ করে দেয় তাকে 'পিসি' ডাকতে, মধ্যবিত্তের আলগা পিরিত মোক্ষম খোঁচা খায়। এসব গল্পে ডিটেলিং এত নিখুঁত, একটা ফোঁড়ও বেমানান মনে হয় না। 'প্রেম' বা 'খেড়া'-র মতো গল্পে ন্যারেটিভ আদ্যন্ত আঞ্চলিক উপভাষায়। প্রান্তিক জীবন নিয়ে লেখা এই গল্পগুলোর সাবটেক্সটে একজন অ্যাক্টিভিস্ট-লেখকের বীক্ষণ ধরা পড়ে। এ-কিন্তু নিছক লেখার টেবিলের অ্যাক্টিভিজম নয়। সেটা হলে জীবনকে এভাবে নানা দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার সুযোগ পেতেন না তিনি, বা পারতেন না মধ্যবিত্তের সিলেবাসের বাইরের জগৎ থেকে এমন সব প্লট খুঁজে আনতে। প্রান্তিক মানুষের অবমূল্যায়নকে অব্যর্থভাবে চিহ্নিত করার কাজটি তিনি করেন মধ্যবিত্ত মেধাজীবীর জায়গা থেকেই। তাঁর কথনে ডিক্লাসড হবার ভান নেই।
আরও পড়ুন : হাত ধরতে শেখার বই : জয়া মিত্রের 'চার পাঁচজন বন্ধু' / রোহন রায়
কিছু বই ভিতরে আলো জ্বেলে দেয়। সাহিত্য-শিল্পের জগৎ কেন 'অধিকতর সত্য', তা বুঝিয়ে দেয়। 'সদাবাহার' সেই গোত্রের বই। এ-বই যদি আজ অনেক পাঠক না-ও পায়, একদিন পাবেই। লেখার জগতে নিয়মিত হয়েছেন বলে প্রতিভা সরকারকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
.......................