পরিবেশ ও প্রাণচক্র

নদিয়ার নদী-আন্দোলন: ইছামতি

বিবর্তন ভট্টাচার্য Nov 18, 2020 at 5:37 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

নদিয়া জেলার নদী আন্দোলন অত্যন্ত প্রাচীন। বরদাকান্ত সান্তাল অঞ্জনা নদী সংস্কার নিয়ে প্রথম প্রতিবাদী মানুষ। সে ১৮৮৫ সালের কথা। তখন অঞ্জনার উৎসমুখ বন্ধ হলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। একটি ক্ষীণ প্রবাহ তখনও ছিল। তিনিই প্রথম বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তবে এই আন্দোলনকে সুসংহত রূপ দেন সুনীলচন্দ্র দাস (নেতাজী পার্ক, চাকদহ)। তিনি ছিলেন চাকদহ বিডিও অফিসের একজন কর্মী, তাই অফিসের কাজে তাঁকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হত। তাই তিনি বিল-বাঁওর-নদীগুলোকে হাতের তালুর মতো চিনতেন। এই নিয়ে লেখা তাঁর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই ‘কাঁদে মরালি কাঁদে যমুনা’ এখনও রিভার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা রেফারেন্সের কাজে ব্যবহার করেন। নদিয়া জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ইছামতি ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জন-আন্দোলন নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।

উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ইছামতির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৪ কিমি। এই নদীটি নিয়ে বহু কবিতা-গান-কথাসাহিত্য রচিত হয়েছে। পদ্মা নদী থেকে বেরিয়ে মাথাভাঙা বা কুমার নদী মাজদিয়ার রেলব্রিজের কাছে এসে ভেঙে দুটি গতিপথ তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে একটি শাখা ইছামতি, অন্যটি চূর্ণি। ইছামতি শুধু ভারতেই প্রবাহিত নয়, মাজদিয়া থেকে বেরিয়ে ২০ কিমি অতিক্রম করে মোবারকপুরের কাছে বাঁক নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর বাংলাদেশে ৩৫ কিমি পথ প্রবাহিত হয়ে আবার দত্তপুলিয়াতে ভারতের ভূখণ্ডে ফিরে এসেছে। তারপর নদিয়া ছেড়ে উত্তর চব্বিশ পরগণায় ৪৩ কিমি পেরিয়ে বনগাঁয় ঢুকেছে এবং সেখান থেকে দক্ষিণদিকে আঙরাইল থেকে বেড়িগোপালপুর পর্যন্ত ২১ কিমি পথ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর আরও ১০ কিমি প্রবাহের পর টিপি-তে যমুনা নদী এসে ইছামতিতে মিশেছে। এরপর টিপি থেকে তেঁতুলিয়া-বসিরহাট-গোয়ালপাড়া-টাকি হয়ে হাসনাবাদে এসে ইছামতি দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। পশ্চিম শাখাটি হাসনাবাদ খাল নামে দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে বিদ্যাধরীর সঙ্গে মিশে মালঞ্চ ও রায়মঙ্গল হয়ে সাগরে মিশেছে। আর প্রধান ধারাটি হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে সুন্দরবনের কালিন্দী নদীর মোহনার কাছে সাগরে এসে মিশেছে। এত দীর্ঘ পথ চলার সময় বহু নদী ইছামতির সঙ্গে এসে মিলেছে, যেমন নাওভাঙ্গা, হাকার, সোনাই, শরৎখাল, দাতভাঙা ইত্যাদি। মাজদিয়া থেকে বেড়িগোপালপুর ১৩৩ কিমি গতিপথে ইছামতী এখন স্রোতহীন, কচুরিপানায় ভরা। তবু শুধু নদীয়াতেই ইছামতির পাড়ে প্রায় ৫০০০ মৎস্যজীবীর বাস। তাঁরা পাটা, ঘুনিজাল, ভেচাল, বাধাল ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে সুন্দরলাল বহুগুণা ও পান্নালাল দাশগুপ্ত যৌথভাবে নদী বাঁচানোর জন্য গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত একটি পদযাত্রা করেন। সেই সময় নদিয়ার নদী-আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শ্রীমা মহিলা সমিতির বাণী সরস্বতী। তাঁরা ঠিক করেন, দত্তপুলিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃতপ্রায় ইছামতী নদীকে নিয়ে তাঁরা আন্দোলন গড়ে তুলবেন। মাজদিয়া রেলব্রিজ ১৯৪২ সালে তৈরী হওয়ার পর থেকেই মাথাভাঙ্গার জল ইছামতিতে ঢোকা বন্ধ হতে থাকে তাই উৎসমুখ সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় ১০০০ মানুষের স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে ‘ইছামতি বাঁচাও কমিটি’ নদীমুখ খানিকটা ছাড়িয়ে দিলেও রেলওয়ের পিলার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বর্ষার সময় ইছামতিতে জল কিছুটা আসলেও সারা বছর শুখাই থাকে ইছামতির উৎসমুখ। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এই নদীতে কোনও এক সময় ইলিশ মাছও পাওয়া যেত। এছাড়া চিতল, শোল, পুঁটি, চিংড়ি, রুই প্রভৃতি পাওয়া যায়। তাই পান্নালাল দাশগুপ্ত ও বাণী সরস্বতীরা ভাবলেন, একটা মাছ ছাড়ার অনুষ্ঠান করবেন। পান্নাবাবু এই উদ্যোগের নাম দিলেন ‘মীনমঙ্গল’। ১৯৯৪ সালে ২৩ নভেম্বর দত্তপুলিয়ায় ইছামতি ব্রিজের কাছে প্রথমবার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্ষায় প্রতি বছর ‘মীনমঙ্গল’ নামে এই মাছ ছাড়ার অনুষ্ঠান করেন। এই নদীকে কচুরিপানা-মুক্ত করা এবং এর উৎসমুখ নিয়মিত সংস্কারের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিছু কিছু অঞ্চলে খানিকটা হলেও সেই কাজ হয়েছে বলেই এবারের বর্ষায় দত্তপুলিয়া থেকে খাগড়াডাঙা পর্যন্ত টলটলে জল ইছামতিতে। এই নদী বাঁচলে বাঁচবে মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী ও এলাকার মানুষ। বাঁচবে নদীর ওপর নির্ভরশীল অজস্র জীব। এলাকার জলস্তরও ঠিক থাকবে। 






ছবি : অন্তর্জাল 

#বাংলা #নদিয়া #ইছামতি #অঞ্জনা #বরদাকান্ত সান্যাল #সুনীলচন্দ্র দাস #রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট #মাথাভাঙা নদী #মাজদিয়া #চূর্ণি #মোবারকপুর #বাংলাদেশ #আঙরাইল #বেড়িগোপালপুর #যমুনা #তেঁতুলিয়া #বসিরহাট #গোয়ালপাড়া #টাকি #হাসনাবাদ #বিদ্যধরী #মালঞ্চ #রায়মঙ্গল #হিঙ্গলগঞ্জ #সুন্দরবন #সুন্দরলাল বহুগুণা #পান্নালাল দাশগুপ্ত #বাণী সরস্বতী #ইছামতি বাঁচাও কমিটি #মীনমঙ্গল #দত্তপুলিয়া #নাওভাঙ্গা #হাকার #সোনাই #শরৎখাল #দাতভাঙা #কালিন্দী #পরিবেশ ও প্রাণচক্র #নদী বাঁচাও #নিবন্ধ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

56

Unique Visitors

181977