মশাদের পছন্দের মানুষ
মশা। ব্যস্ত সময়ের বিরক্তি বাড়াতে, শান্ত মনে হিংসা জাগাতে এই একটি প্রাণীই যথেষ্ট। মনোযোগ দিয়ে কাজ করার সময়ে বা রাতবিছানায় গায়ে লেপ টেনে নেওয়ার সময়ে যদি কানের কাছে শোনেন সেই গুনগুন প্রেমের গান, ভিতর থেকে কেমন একটা প্রতিহিংসা জেগে ওঠে না? এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মানুষ কত অস্ত্রই না বানিয়েছে – মশারি, কয়েল, ম্যাট, মায় ইলেকট্রিক টেনিস র্যাকেটও! কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি কিছুতেই, ঘরে তাদের একবার পা পড়লে সহজে নিস্তার মেলে না। আর এ তো আজকের কথা নয়, কলকাতার গোড়াপত্তনের আগে থেকে তাঁরা আছেন। সম্ভবত বিপ্লবীরা ছাড়া ব্রিটিশদের আর একটিই মাথাব্যথা ছিল – মশা। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ লর্ড মিন্টোকে তাঁর অ্যাডভোকেট জেনারেল পরামর্শ দিয়েছিলেন সদ্য ব্রিটেন থেকে আগত কারও পাশে বসতে, মশারা নতুন রক্তই বেশি ভালোবাসবে নিশ্চিত! কিন্তু মশারা আর সে যুক্তি মানলে তো। মেটকাফ হল যার নামে নামাঙ্কিত, সেই স্যর মেটকাফকে নাকি টানা তিরিশ বছর ধরে মশারা একইরকম ভালোবেসে গেছে। ঠিক এইখানেই উঠে আসে একটা জব্বর প্রশ্ন – মশারা কেন কিছু মানুষকে বাকিদের তুলনায় বেশি কামড়াতে পছন্দ করে?
প্রশ্নটা হেলাফেলার নয় কিন্তু, ভেবে দেখুন। বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা দিচ্ছেন, সেখানে মশারাও যোগদান করেছে, অথচ আপনিই যেন তাদের আহারের একমাত্র বাফে কাউন্টার; যে যখন পারছে এসে চোঁ করে কয়েক বিন্দু রক্ত শুষে নিচ্ছে। এমন ঘটনা অনেকেরই জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে ঘরোয়া যুক্তিরও কমতি নেই। পোশাকের রং, রক্তের গ্রুপ, রক্তে মিষ্টির পরিমাণ, উচ্ছে খায় কিনা, রসুন মাখে কিনা, ছেলে না মেয়ে, বাচ্চা না বুড়ো – এক এক বিজ্ঞের এক এক মতামত। কিন্তু কোনোটিই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মানে উত্তীর্ণ নয়। তাই রকেফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেসলি ভসহ্যাল আর তাঁর সহকারী মারিয়া ওবাল্ডিয়া লেগে পড়েছিলেন এই রহস্যের সমাধানে। সমাধান মিললে, মশাদের মানুষের প্রতি ক্ষেত্রবিশেষে বেশি আকর্ষিত হওয়ার কারণ জানা গেলে, তার উলটো পথে হেঁটে মশাদের বিমুখ করার রাস্তাও বেরোবে সহজে। লেসলি-মারিয়া তাই এই কাজের জন্য মাথা ঘামাতে বসলেন। পরীক্ষার জন্য তাঁরা বেছে নিলেন বিজ্ঞানীমহলে এই বিষয়ে সবচাইতে জনপ্রিয় যুক্তিটা – মানুষের ত্বক-নিঃসৃত ঘ্রাণই মশাদের প্রলুব্ধ করে। পরীক্ষা কোনও একটা নয়, তিন বছর ধরে একাধিক স্তরে হল। প্রাথমিক স্তরে তাঁরা বাবা-বাছা করে রাজি করিয়েছিলেন তিন স্বেচ্ছাসেবককে, তাদের আলাদা আলাদা ঘরে বসিয়ে মশাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন এমন জায়গায় যাতে তারা যে কোনও ঘরেই যেতে পারে। দেখা গেল, তিনজনের মধ্যে মশারা সুন্দর ভাবে একজনকে সেরা বেছে নিয়েছে, সে বেচারার অবস্থাই সবচাইতে করুণ। লেসলি-মারিয়া এগোলেন পরবর্তী স্তরের দিকে। এবার ওই তিনজন সমেত মোট আটজনকে দুইহাতের কনুইয়ের নিচ থেকে পরার জন্য নাইলনের আঁটোসাটো স্টকিং দিলেন, পরে থাকতে হবে দিনে ছয় ঘন্টা করে টানা কয়েক মাস। তারপর সবার থেকে স্টকিং সংগ্রহ করে, জোড়ায় জোড়ায় ভাগ করে রাখলেন দুটো স্বচ্ছ বাক্সর মধ্যে। বাক্স দুটো আবার দুটো আলাদা নল দিয়ে একটা বড়ো বাক্সের সঙ্গে জোড়া। সেই বড়ো বাক্সে একদিক থেকে ছেড়ে দেওয়া হল এডিস ইজিপ্টাই মশককুল, আর উলটোদিক থেকে স্টকিং রাখা বাক্স দুটোতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বজায় রাখা হল। মশারা যে বাক্সের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবে, সেই বাক্সের দিকেই ধেয়ে যাবে, এই ছিল লক্ষ্য। পুরো পরীক্ষাটা করা হয়েছিল বারংবার, বিভিন্ন রকম নাইলন জোড়া ব্যবহার করে – কখনও দুজন আলাদা মানুষের, কখনও একই মানুষের দুই হাতের, কখনও অব্যবহৃত স্টকিং সমেত – এইভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে আটজনের সবার সঙ্গে সবার জুটি বানিয়ে যাচাই করা হল। কার্যত দেখা গেল, মশারা প্রতিবার সেই আগের সেরা খাবার, থুড়ি মানুষটির স্টকিং-এর কাছেই সবচাইতে বেশি ভিড় জমাচ্ছে! তারপরে যারা বাকি রইল, তাদের মধ্যেও নিজেদের মতো র্যাঙ্কিং করে নিয়েছে মশারা এবং প্রত্যেকবার, প্রত্যেকরকম জুটির নাইলনের মধ্যে তারা সেই র্যাঙ্কিং মেনেই হামলে পড়ছে। অব্যবহৃত স্টকিং-এর প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র টান নেই, ডান হাত আর বাঁ হাতের স্টকিং-এও তারা ভেদাভেদ করে না। লেসলি-মারিয়া সর্বশেষ স্তরে আরও ছাপ্পান্ন জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে স্টকিং পরীক্ষা করলেন। এবারেও সাম্যের জয়গান না গেয়ে মশারা পছন্দের স্টকিং বেছে নিল, তবে সেরার শিরোপা সেই একজনেরই মাথায়। মশাদের তার প্রতি আকর্ষণের বহর কত বেশি? দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর চাইতে প্রায় চারগুণ আর সর্বনিম্ন স্থানাধিকারীর চাইতে প্রায় একশো গুণ বেশি!
এতটা পরিষ্কার ফলাফল বিজ্ঞানীরা আশাও করেননি। তাঁরা এবার প্রত্যেকটা স্টকিং-এর রাসায়নিক বিশ্লেষণে বসলেন, প্রায় পঞ্চাশ রকমের রাসায়নিক যাচাই করে দেখা গেল মশাদের সবচাইতে পছন্দের মানুষটির স্টকিং-এ লেগে আছে সবচাইতে বেশি পরিমাণ কার্বক্সিলিক অ্যাসিড, যা কিনা আমাদের ত্বকগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত দেহরসের অন্যতম উপাদান। শুধু তাই নয়, এই কার্বক্সিলিক অ্যাসিড বা ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যবহার করেই মানুষের ত্বকে বসবাসকারী ব্যাক্টেরিয়ারা নিজেদের পুষ্টিসাধন করে, যার ফলে প্রত্যেক মানুষের দেহে নির্দিষ্ট গন্ধ তৈরি হয়। এতদিন পর্যন্ত এই ঘ্রাণকে মশাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ভাবা হত, লেসলি-মারিয়া সে কথাকে হাতেনাতে প্রমাণ করে ছাড়লেন। যেহেতু পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট বাক্সে তাপমাত্রা আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মান সবসময় একই রাখা ছিল, তাই এদের তারতম্য না হলেও যে মশারা গন্ধবিচার করে মানুষ খুঁজে নেবে সেটাও প্রমাণিত হল। সেই সঙ্গে জানা গেল মশাদের পছন্দের রহস্য, যার শরীরে কার্বক্সিলিক অ্যাসিড নিঃসরণের মাত্রা যত বেশি, সে তত বেশি করে মশাদের আকৃষ্ট করবে। তবে কি তার বাঁচার কোনও উপায় নেই?
লেসলি মানতে চাইলেন না। তিনি বললেন, কেমন হয় যদি মশাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়টাই নষ্ট করে দেওয়া যায়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঘ্রাণ শনাক্তকরণের জন্য এডিস মশার দুই ধরনের গ্রাহক প্রোটিন থাকে – Orco এবং IR, বিজ্ঞানীরা সেই দুই প্রোটিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে মিউট্যান্ট মশা বানিয়ে আবার একই পরীক্ষা করলেন। এবারের ফলাফলের চমকের জন্যও তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না। দেখা গেল, Orco মিউট্যান্টরা মানুষকে তো চিনতে পারছেই এমনকি তাদের মধ্যে আকর্ষণের কম-বেশির তফাতও করতে পারছে। উলটোদিকে IR মিউট্যান্টরা কম-বেশির তফাত করার ক্ষমতা হারালেও মানুষের গন্ধ চিনতে ভুল করছে না। অর্থাৎ নাক কেটে দিলেও মশারা আমাদের খুঁজে বের করে পেট ভরাবে ঠিকই!
এই ক্ষুদ্র জীবনে বোধ করি আর শান্তি পাওয়া গেল না।
আরও পড়ুন:ছোট্ট একটা ‘ক্লিক’!/ সায়নদীপ গুপ্ত
………
তথ্যসূত্র:
১) সেকালের কলকাতার মশা, কৌশিক মজুমদার, সিলি পয়েন্ট
২) Differential mosquito attraction to humans is associated with skin-derived carboxylic acid levels, Obaldia et al., Cell, 2022
#মশা #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #প্রাণিবিদ্যা #সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #সায়নদীপ গুপ্ত