চাঁদবদন
(গত সংখ্যার পর)
আমার একটা আত্মশ্লাঘার বিষয় আছে। সবকিছু পরিপাটি করে করি আমি। জন ক্লেভারহাউসকে মেরে ফেলব বলে ঠিক করলাম যখন, এও ঠিক করলাম যে এমন নিপুণভাবে তাকে সরাতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কখনও নিজের কাজের কথা ভেবে লজ্জা না পেতে হয়। আমি ছড়িয়ে লাট করা পছন্দ করি না, মোটা দাগের হিংস্রতাও না। খালি হাতে কাউকে ঘুঁষি মারার কথা কল্পনা করলেও আমার গা পাক দিয়ে আসে। ইশ্, কী জঘন্য নোংরা একটা ব্যাপার! কাজেই জন ক্লেভারহাউসকে (ওহ্, আবার সেই বস্তাপচা দুর্গন্ধময় নাম!) গুলি করা, ছুরি মারা কিংবা পিটিয়ে মারায় আমার উৎসাহ জাগল না। আর শুধু খুনটাকে শুধু পরিপাটি করে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেই তো হবে না, এমনভাবে কাজ সারতে হবে যাতে এই শর্মার উপর সন্দেহের ছিটেফোঁটাও না পড়ে।
এইভাবে মনস্থির করে আমি ভাবতে বসলাম। দিন-রাত এক করে ভাবতে লাগলাম। এক সপ্তাহ মাথা ঘামিয়ে ঘামিয়ে শেষমেশ একটা ফন্দি বের করলাম। যেমন ফন্দি আঁটা, অমনি কাজে লেগেও পড়া। পাঁচ মাস বয়সের একটা ওয়াটার স্প্যানিয়েল জাতের মেয়ে-কুকুর কিনলাম। নাম রাখলাম ‘বেলোনা’। দিবারাত্রি তাকে ট্রেনিং দিতে থাকলাম। সেই সময় আমার উপর নজরদারি চালালে যে কেউ বুঝতে পারত যে আমি কুকুরটাকে শেখাচ্ছি কেবল একটাই কাজ – জল থেকে জিনিস তুলে আনা। জলে লাঠির টুকরো ছুঁড়ে দেওয়া মাত্রই সাঁতরে সেগুলো তুলে আনতে হবে– অনবরত এই শিখিয়ে যেতে থাকলাম কুকুরটাকে। আর শুধু তুলে আনা নয়, তৎক্ষণাৎ তুলে আনা। কোনও ইঙ্গিত বা আদেশের অপেক্ষা না করে, জিনিসটা নিয়ে কোনোরকম খেলা না করে সটান সেগুলো নিয়ে জল থেকে ফিরে আসা। কুকুরটা কোনোদিকে তাকাবে না, থামবে না কোথাও, শুধু যত তাড়াতাড়ি পারে ডাণ্ডার মতো জিনিসটা এনে হাতে তুলে দেবে। আর আমি তাকে দৌড় করাতাম। জল থেকে সে উঠলেই আমি ছুট লাগাতাম, আর লাঠির টুকরোটা মুখে নিয়ে সেও দৌড়াত আমার পিছনে যতক্ষণ না আমায় ধরে ফেলছে। এমনি করেই তার প্র্যাকটিস চলতে লাগল। চালাক-চতুর ছিল জন্তুটা, খুব তাড়াতাড়িই খেলাটা বুঝে ফেলল। আমিও শিগগিরই হৃষ্ট-সন্তুষ্ট হলাম।
তারপর এক শুভদিনে প্রথম সুযোগেই জন ক্লেভারহাউসের হাতে কুকুরটাকে তুলে দিলাম উপহার হিসাবে। ভাব দেখালাম এমন, যেন কোনোকিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে কোনোদিন। ক্লেভারহাউসের একটি দুর্বলতা আমি জানতাম, আর এ-ও জানতাম যে সেই দুর্বলতাজনিত একটি পাপকাজ সে নিশ্চিত আর নিয়মিতভাবে করে থাকে। তাই আমি যে কী করতে চলেছি, কী মতলব ঠাউরেছি, সে সম্পর্কে আমার খুব পরিষ্কার ধারণা ছিল।
কুকুরটার গলার দড়ির প্রান্তটা তার হাতে আমি ধরিয়ে দেওয়া মাত্রই সে বলে উঠল, “না… না না… সত্যি সত্যিই তুমি এটা আমায় উপহার দিচ্ছ না নিশ্চয়ই?” অলম্বুষটার চাঁদবদন হাসিতে একেবারে ফুটিফাটা হয়ে উঠল। “আমি… আমার কেমন জানি মনে হত তুমি আমায় ঠিক পছন্দ করো না”, অবাক গলায় সে বলল, “কী সব ভুলভাল ভাবি আমি! অ্যাঁ! কী করে এইসব ভুলভাল হাতির মাথা-ব্যাঙের ছাতা চিন্তা আমার মাথায় আসে বলো তো? হাঃ হাঃ!! হোঃ হোঃ হোঃ!!!” ক্লেভারহাউস হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে মাটিতে উল্টে পড়ে যায় আর কী! দম ফাটানো হাসির ফাঁকফোকরেই কোনোরকমে নিশ্বাস নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল, “কী – কী নাম – কুকুরটার?”
“বেলোনা”, উত্তর দিলাম।
“হিঃ হিঃ হিঃ! হাঃ হাঃ হাঃ!” দুলতে দুলতে হাসতে হাসতে বলল, “এমন মজার নাম জীবনেও শুনিনি।”
ব্যাটার উল্লাস দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে বললাম, “বেলোনা ছিল যুদ্ধের দেবতা মার্সের বৌয়ের নাম, শোনোনি?”
তৎক্ষণাৎ চাঁদমুখে সেই জ্যোৎস্নার আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। গোটা মুখ জ্বলজ্বলিয়ে উঠল একেবারে। উল্লসিত গলায় সে বলল, “সে তো আমার আগের কুকুরটার নাম ছিল। তাহলে তো এ বিধবা হয়েছে বলতে হয়, অ্যাঁ? হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ!! ও হোঃ হোঃ হোঃ!!!” স্থান-কাল ভুলে নিজের রসিকতায় নিজেই মগ্ন হয়ে পেটে খিল-ধরানো হাসি হাসতে লাগল সে। পারলে আমায় কোলে তুলে নাচে। আমি চটপট পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে পিঠটান দিলাম।
সপ্তাহখানেক কেটে গেল। শনিবার বিকেলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি তো সোমবার শহরে চলে যাও, তাই না?”
তার দাঁত বেরিয়ে এল। মুণ্ডু উপর-নিচে নড়ল।
“তাহলে এ হপ্তায় আর তোমার ‘পছন্দের’ ট্রাউটমাছের শ্মশান বাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া হল না, কী বলো?”
আমার কথার মধ্যে খোঁচাটা সে খেয়ালই করল না। ফিকফিক করে হেসে উত্তর দিল, “না না, তা কেন? কালকেই সকালেই মাছ ধরতে যাব তো। মাছ পাব না মানে? জান লড়িয়ে দেব।”
এ তো আশ্বাস নয়, স্বয়ং আশ্বাসের ঠাকুরদাদা! আমি আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। নিজেকে কোলাকুলি করতে ইচ্ছে করছিল আমার।
পরের দিন সক্কাল-সক্কাল দেখি সে মাছ ধরার ছোট জাল আর একটা চটের থলে হাতে করে চলেছে, আর তার পায়ে-পায়ে নেটিপেটি করতে করতে চলেছে বেলোনা। ওরা কোথায় যাবে তা আমি জানতাম। পিছনের মাঠ পেরিয়ে, ঝোপঝাড় ভেঙে, বনবাদাড়ের তলা দিয়ে আমি চললাম পাহাড়ের মাথার দিকে। গা ঢাকা দিয়ে দিয়ে পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে প্রায় মাইলদুয়েক চলে যেখানে এসে পৌঁছালাম সে জায়গাটাকে পাহাড়ের গায়ে একটা প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটার বললে খুব ভুল বলা হবে না। এইখানে একটা ছোট নদী পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে সামনের উপত্যকায় উপচে পড়ে একটা ছোটখাটো পাথরে-ঘেরা শান্ত হ্রদ তৈরি হয়েছে। যেন এতক্ষণ পাহাড়ের ভিতরকার সরু খাতের গলিপথে হু-হু করে দৌড়ে এসে হঠাৎ একটা খোলা জায়গা পেয়ে নদী গা এলিয়ে জিরিয়ে নিতে বসেছে। এই হল অকুস্থল। আমি পাহাড়ের মাথায় নিচে যা যা ঘটছে সবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা যায় এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে ধীরেসুস্থে পাইপ ধরিয়ে বসলাম।
খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই নদীখাতের মধ্যে জল ঠেলতে ঠেলতে চাঁদমামার উদয় হল। তার পেছনে জল ছপছপিয়ে দৌড়ে-সাঁতরে আসছে বেলোনা। দুজনেরই চালচলনে ভারি ফুর্তির ছাপ। ক্লেভারহাউসের হাঁফ ছাড়ার সাঁই-সাঁই শব্দে মিশে যাচ্ছে বেলোনার মাঝেমধ্যে ছাড়া উল্লাসের ভুক-ভুক ডাক। হ্রদের কাছে পৌঁছে ক্লেভারহাউস জাল আর চটের থলে মাটিতে ফেলে দিয়ে হিপ পকেট থেকে টেনে বের করে আনল হোঁৎকা লম্বা মোমবাতির মতো একটা বস্তু। ওটা কী আমি জানি। মোমবাতি নয়, ওটা ডিনামাইটের একটা গোবদা স্টিক। ওইভাবেই ট্রাউট ধরে ও। ট্রাউট মারে। বেআইনিভাবে। গোবদা ডিনামাইটের স্টিকটাকে ভালো করে তুলোয় জড়িয়ে চাঁদবদন লম্বা করে সলতে লাগাল তাতে। তারপর সলতেয় আগুন লাগিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল হ্রদের মধ্যে বেশ কিছুটা দূরে।
একঝলক বিদ্যুতের মতো লাফ মেরে বেলোনা ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের মধ্যে, তড়িৎগতিতে সাঁতরে চলল ভাসমান স্টিকটার দিকে। ক্লেভারহাউস চিৎকার করে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ডাকতে থাকল – কিন্তু কে কার কথা শোনে? ক্লেভারহাউস মাটির ঢেলা, পাথরের টুকরো ছুঁড়তে লাগল কুকুরটাকে আটকাতে। কিছুতেই কিছু হওয়ার নয় – তিরবেগে জল কেটে সোজা লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বেলোনা কামড়ে ধরল স্টিকটা, তারপর পিছন ফিরে সাঁতরে আসতে লাগল পাড়ের দিকে। এইবার প্রথম ক্লেভারহাউস তার বিপদের বহরটা আঁচ করল। সেও পিছন ফিরে লাগাল টেনে দৌড়। আমার দেওয়া ট্রেনিং বিফলে গেল না, আমার আঁটা মতলব কাজ করল কাঁটায় কাঁটা মিলিয়ে। বেলোনা জল থেকে উঠেই ধেয়ে চলল ক্লেভারহাউসের পিছনে, ঠিক যেমনটি আমি ভেবেছিলাম। আহা, কী আনন্দ! আগেই বলেছি, হ্রদটা অবস্থিত একটা অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো খোলা জায়গায়। তার আগে-পিছে ধাপে ধাপে উঠেছে আর নেমেছে পাহাড়ের ঢালু গা, নদী তাই বেয়েই ওপর থেকে নিচে কুলকুলিয়ে বয়ে গেছে। নদীর বুকে এখানে-ওখানে প্রচুর ছোট-বড় পাথর ছড়িয়ে আছে, সেগুলোর ওপর পা ফেলে ফেলে অল্প আয়াসেই নদী পারাপার করা যায়। এই সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে, উপরে উঠে, নিচে গোঁৎ খেয়ে, জলের ওপর ছপছপিয়ে আর পাথরের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ক্লেভারহাউস আর বেলোনা দৌড়ে বেড়াতে লাগল – যেন ধরাধরি খেলছে! ওইরকম গোবরগণেশ চেহারার একটা লোক যে এমন জোরে দৌড়নোর ক্ষমতা রাখে তা আমি জানতাম না। সে কী ছুট রে ভাই চাঁদবদনের! কিন্তু বেলোনার সঙ্গে দৌড়ে পারে কখনও? সে প্রায় ধরে ফেলেছে। দুজনের মধ্যে ব্যবধান আর নেই প্রায়। ক্লেভারহাউসের ঠ্যাংদুটো মাটিতে আর ঠেকছে না বললেই চলে, বেলোনার নাক তার পলায়নপর হাঁটু ছুঁই-ছুঁই। ঠিক তখনই আগুনের একটা চোখ ঝলসানো ঝলকের সঙ্গে একটা গগনভেদী বিস্ফোরণের আওয়াজে আমার কানে প্রায় তালা লেগে গেল, আর কালো ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী তাল পাকিয়ে উঠে গিলে ফেলল মনিব-কুকুরের জুটিকে। ধোঁয়া কাটলে দেখলাম – নদীর ধারে একটা বিরাট গর্ত বিকট হাঁ করে রয়েছে ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে মুহূর্তখানেক আগেই দাঁড়িয়েছিল একটা মানুষ আর একটা কুকুর।
করোনারের জুরি রায় দিলেন: “বে-আইনিভাবে মাছ ধরার সময়ে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু”। হুঁ হুঁ বাবা! সাধে কি জন ক্লেভারহাউসকে সরিয়ে ফেলার কথায় আমার বুক ফুলে ওঠে? কী পরিপাটি, কী নিখুঁত কাজ দেখুন দেখি! কোনও ছড়িয়ে লাট করার ব্যাপার নেই, কোনও মোটা দাগের হিংস্রতা নেই। গোটা কাজটার মধ্যে এমন কিছু নিন্দনীয় নেই যাতে ভবিষ্যতে এটার কথা ভাবলে আমায় লজ্জা পেতে হয়। আপনারাও নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন? কী, তাই তো? ক্লেভারহাউসের অট্টহাসি আর পাহাড়ের মধ্যে থেকে ঠিকরে ওঠে না, চাঁদমুখটিরও আর উদয় হয় না আমার প্রভূত বিরক্তি উৎপাদন করে। আমার দিন এখন কাটে অনাবিল শান্তিতে, আর রাত্রি নিবিড় সুখনিদ্রায়।