অনুবাদ

চাঁদবদন

রাজর্ষি গুপ্ত Dec 20, 2020 at 7:52 am অনুবাদ

মূল গল্প – ‘মুন-ফেস’
লেখক - জ্যাক লন্ডন
(প্রথম কিস্তি)

চাঁদবদন বলতে যা ঠিক বোঝায়, জন ক্লেভারহাউস ছিল একদম তাই। আপনারা অনেক দেখেছেন এমন মুখ। ওই যে – চওড়া দুটো চোয়াল, কপাল আর হনুর হাড় যেন গলে নেমে এসে চোয়ালে মিশে মুখকে খাঁটি গোলাকার রূপ দিয়েছে; আর বৃত্তের পরিসীমা থেকে একেবারে জ্যামিতিক দূরত্ব মেপে ঠিক মাঝখানে একটা চ্যাপ্টা খাঁদা নাক – যেন ছাদের গায়ে ছুঁড়ে মারা একটা ময়দার ডেলা আটকে রয়েছে। ওই মুখের জন্যই বোধ হয় তাকে আমি এত ঘৃণা করতাম। সে আমার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল; পৃথিবীর ভার মনে হতে লেগেছিল তাকে আমার। হয়তো আমার মায়ের চাঁদের ব্যাপারে কোনও কুসংস্কার থেকে থাকবে, তিনি হয়তো কোনোদিন ভুল করে ভুল কাঁধের উপর দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ফেলেছিলেন – তাই আমি এমন ‘চন্দ্রাহত’ হয়েছিলাম।

সে যাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল আমি জন ক্লেভারহাউসকে ঘেন্না করতাম। ক্ষতি করা বা শত্রুতা করা বলতে সমাজের চোখে যা বোঝায় তা সে আমার প্রতি কোনোদিনই করেনি। এসব থেকে সে শতহস্ত দূরে। শয়তানিটা অন্য রকম – অনেক গভীর, অনেক সূক্ষ্ম। তার নাগাল পাওয়া যায় না, সে ধরাছোঁয়ার বাইরে অবর্ণনীয় এক ব্যাপার। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কোনও না কোনও সময়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। দু-সেকেন্ড আগে অবধিও যার কোনও অস্তিত্ব আছে বলে স্বপ্নেও ভাবিনি সেইরকম এক ব্যক্তি হঠাৎ উদয় হয় চোখের সামনে; কিন্তু তাকে দেখামাত্রই মন বলে ওঠে – “এ লোকটাকে আমার পোষাচ্ছে না”। কেন পোষাচ্ছে না? তা জানি না। কোনও কারণ নেই, কিন্তু পোষাচ্ছে যে না সেটা জানি। লোকটাকে আমার অপছন্দ হচ্ছে – ব্যাস, এইটাই শেষ কথা। জন ক্লেভারহাউসের ব্যাপারটাও ছিল ঠিক তাই।

এমন মানুষের সুখী হওয়ার কোন অধিকার থাকতে পারে, অ্যাঁ? তাও এ চাষা সবসময়ই বুকভরা আশা নিয়ে বাঁচছে! মজাসে আছে, তার হাসির চোটে গগন ফাটছে! এর সব কিছুই সব সময় একদম ঠিকঠাক! কী করে হয়? মরণ হয় না? ওহ্‌, লোকটার সুখ যেন আমার বুকের ভিতরে করাত চালাত! কই, অন্য লোকে হাসলে তো আমার কোনও সমস্যা ছিল না। আমি নিজেও হাসতাম – জন ক্লেভারহাউসের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে অবিশ্যি। কিন্তু ওই লোকটার হাসি! সে হাসি আমায় বিরক্ত করে মারত, আমায় পাগল করে দিত – ধরাতলে আর কোনোকিছু আমাকে ওইরকম বিরক্ত আর উন্মাদ করে তুলত না। তার হাসি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, আমার গলা টিপে ধরত, কিছুতেই সেই মরণমুঠি ছাড়ানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। সে এক ভয়ানক বিকট প্রাণভরা অট্টহাস্য। আমার শয়নে-স্বপনে ঘুমে-জাগরণে সেই হাসি উদ্দাম অনধিকার প্রবেশ ঘটাত, আমার প্রতি নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে আর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির মধ্যে ধাঁই-ধপাধপ শব্দে এক্কা-দোক্কা খেলত! ভোর হল কি না হল, মাঠের ওপার থেকে তার অট্টহাসি ভেসে এসে দিল আমার সকালের ফুরফুরে শান্ত মেজাজের সাড়ে চোদ্দটা বাজিয়ে। ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরবেলায় যখন গাছপালা নুয়ে পড়েছে, পাখপাখালি গাছের ছায়ার আড়াল খুঁজে চুপচাপ হয়ে বসেছে, বিশ্বচরাচর জিভ বের করে ঝিমোতে লেগেছে – তখন আকশের প্রখর সূর্যের তেজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে তার রাবণমার্কা “হা হা! হো হো!” নিনাদিত হয়ে উঠবেই। মাঝরাতের অন্ধকারে চৌমাথার মোড় থেকে তার হাসির ছর্‌রা ছুটে এসে আমার শান্তির ঘুম ভাঙাবেই – ক্লেভারহাউস শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাঁক নেয় ওই চৌমাথায়, আর আমি নিষ্ফল ক্রোধে বিছানায় ছটফট করি। প্রতিশোধস্পৃহায় আমার মুঠোয় নখের দাগ বসে যায়।

এক রাতে চুপিসাড়ে গিয়ে তার গরুর পাল ছেড়ে দিলাম তারই খেতের মধ্যে। সকালে উঠে আবার শুনি সেই প্রাণখোলা হাসি! গরুগুলোকে তাড়িয়ে এককাট্টা করতে করতে হাসিমুখে সে বলল, “কী আর এমন হয়েছে? বেচারা জন্তুগুলো খাবারের লোভে ভরভরন্ত খেত দেখে ঢুকে পড়েছে – এতে আর ওদের দোষ কোথায়?”

ওর মার্স নামের একটা কুকুর ছিল। পেল্লায় জানোয়ার, দেখার মতো চেহারা। ডিয়ারহাউন্ড আর ব্লাডহাউন্ডের দোআঁশলা, কিন্তু দেখতে দুটোরই মতো। এই মার্স ছিল ক্লেভারহাউসের ‘প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি’। কখনও একটিকে ছাড়া অন্যটিকে দেখা যাবে না। আমি তক্কে-তক্কে ছিলাম। একদিন সুযোগ পেয়ে জানোয়ারটাকে ভুলিয়ে আনলাম বিফস্টেকের লোভ দেখিয়ে। তাতে সেঁকো বিষ মাখিয়ে রেখেছিলাম, খেয়ে ব্যাটা পটল তুলল। কিন্তু তাতেও ক্লেভারহাউসের মধ্যে কোনোই হেলদোল নজরে পড়ল না। তার ভরাট প্রাণের হাসি যেমন ঘন-ঘন শোনা যেত আগে, এখনও তেমনই শোনা যেতে থাকল। একইরকম নিটোল গোল রইল তার চাঁদবদন, তাতে কলঙ্কের চিহ্নটুকুও পড়ল না।

তারপর আমি তার খড়ের গাদায় আর গোলাবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলাম। পরের দিন ছিল রবিবার। ও বাবা, দেখি হৃষ্টমনে সদানন্দ কোথায় যেন চলেছে।

“চললে কোথায়?” চৌরাস্তার মোড়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

“ট্রাউট ধরতে,” চাঁদপানা মুখে যেন ঝিলিক খেলে গেল, “ট্রাউট আমি বড় ভালোবাসি।”

এ কী অসম্ভব রকমের বিটকেল লোক রে বাবা! তোর সারা বছরের ফসল খড়ের গাদার সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেল – তার কোনও বিমাও করানো ছিল না, জানি আমি – আর তুই কিনা পেটে কিল মেরে সারা শীতকাল কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁত বার করে চললি ট্রাউট ধরতে – হ্যাঁ মাছ ধরতে – কারণ তুই ট্রাউট “বড় ভালোবাসিস”? তার কপালে যদি একফোঁটাও দুরাশার কালো মেঘের উদয় হতে দেখতাম, কিংবা দেখতাম তার গরুর মতো চাঁদবদন দুশ্চিন্তায় একটু হলেও ঝুলে পড়েছে, নিটোল গোল টাল খেয়েছে – তবে তার বেঁচে থাকার অপরাধ ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু না। তার কপাল যতই পুড়তে থাকল, তার হাসিও ততই চওড়া হতে থাকল।

আমি ক্লেভারহাউসকে অপমান করলাম। ঘোর অপমান। সে অবাকদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল, তার ঠোঁটে অবোধ হাসি। “তোমার সঙ্গে লড়ব? কেন?” আস্তে আস্তে আমায় সে জিজ্ঞাসা করল। আর তারপরই ফেটে পড়ল ঠা ঠা হাসিতে। আর ফাঁকে ফাঁকে দম নিতে নিতে বলতে থাকল, “তুমি বাপু অদ্ভুত লোক! ওহ্‌ হো হো হো!! তুমি আমায় মারবে দেখছি!!! হা হা হা!! হে হে হে হে!!!”

আর কীই বা করার থাকতে পারে এমনধারা হলে? ব্যাপারটা ক্রমেই অসহ্য থেকে অসহ্যতর হয়ে উঠছিল। ঈশ্বর জানেন আমার মনে ক্লেভারহাউসের প্রতি কী পরিমাণ ঘৃণা জমা হয়েছিল! আর ওই একখানা অসহ্য নাম – ক্লেভারহাউস! নামের কী বা ছিরি! ‘ক্লেভারহাউস’! এটা ঘোড়ার ডিম একটা নাম হল? মানে, ঈশ্বরের দিব্যি, এতকিছু থাকতে ‘ক্লেভারহাউস’ কেন শুনি? এই প্রশ্নটা আমি বারবার নিজেকে করেছি। স্মিথ, ব্রাউন কিংবা অন্য কিছু হলে আমার থোড়াই কিছু যেত-আসত – কিন্তু ক্লেভারহাউস? আপনারাই বিচার করে দেখুন। মনে মনে উচ্চারণ করুন নামটা – “ক্লে-ভা-র-হা-উ-স”। এবার দেখুন কেমন বিশ্ববোকাটে রকমের শোনাচ্ছে না নিজের কানেই, অ্যাঁ? – ‘ক্লেভারহাউস’! হুঁহ্‌!! এই নামধারী একটা লোকের কি বেঁচে থাকা আদৌ উচিত? কোনও অধিকার আছে তার বাঁচার? আপনারাই বলুন না। কী বললেন? “না” বললেন তো? আমিও ঠিক তাই বলেছিলাম – “না”।

আমার মনে খেলে গেল – ওর জমি-ঘর-দোর ঋণের দায়ে বাঁধা পড়ে আছে। ফসলের গোলা তো গোল্লায় গেছে, বন্ধকি কারবারের পাঁক থেকে নিজেকে টেনে তোলার ক্ষমতা আর বাছাধনের নেই। আমি করলাম কী, এক মক্ষিচুষ (কিন্তু মুখটেপা) মহাধুরন্ধর মহাজনের সঙ্গে ষড় করে তার হাতে বন্ধকের মালিকানা এনে দিলাম। তারপর নিজে মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে অতর্কিতে ক্লেভারহাউসের যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক করে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করে ফেললাম। জান-মাল-গরুর পাল নিয়ে মানে মানে সরে পড়ার জন্য বেচারার হাতে রইল মাত্র কয়েকটা দিন – যে কটা দিন আদালত বরাদ্দ করেছিল সেই কটা দিনই শুধু, তার বেশি এক মিনিটও নয়। তারপর ছড়ি দুলিয়ে বেড়াতে বেড়াতে গিয়ে হাজির হলাম দেখতে, যে ব্যাটার বেলুন এইবারে কতখানি চুপসেছে। হাজার হলেও এখানে ব্যাটা মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছিল তা বছর বিশেকের ওপর হবে। কিন্তু আমার সামনে মূর্তিমান যখন এসে দাঁড়ালেন, দেখি পিরিচমার্কা চোখে ঝিলমিল করছে হাসি, মুখে পূর্ণিমার আভা। ধীরে ধীরে সে আলোর ছটা তার সারা মুখে ছড়িয়ে গেল – মনে হল যেন স্বয়ং পূর্ণচন্দ্র দু-কান এঁটো করে আমার ঠিক সামনে উদ্ভাসিত হলেন।

“হাঃ হাঃ হাঃ!” হেসে উঠল ক্লেভারহাউস, “আমার ছোট ছেলেটা বেড়ে মজার হয়েছে, জানো তো। যা সব অদ্ভুত মজার মজার কথা বলে না! শোনো শোনো বলি। নদীর ধারে খেলা করছিল, এমন সময় পাড় থেকে মাটির একটা চাঙড় ঝপাস্‌ করে নদীর জলে খসে পড়ে বেশ খানিকটা জল ছিটিয়ে গেছে আর বেচারিকে একদম চান করিয়ে দিয়েছে। আর ছেলে আমার কাঁদতে লেগেছে – “বাবা, বাবা, একটা ডোবা থেকে কতটা জল উড়ে এসে আমায় ভিজিয়ে দিল!”

ক্লেভারহাউস থেমে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবখানা এই যে আমিও যেন তার এই হতচ্ছাড়া রকমের রঙ্গরসে যোগ দিয়ে হাসতে থাকি। আমি ছোট্ট করে গম্ভীর গলায় শুধু বললাম, “এতে তো হাসির কিছু আমি দেখছি না”। বুঝতে পারলাম, বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মুখটা কালো হয়ে উঠেছে। 

অবাক হয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল সে। তারপর আবার সেই হাড়-জ্বালানে জ্যোৎস্নার আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার মুখে যতক্ষণ না সে মুখ ‘মাধবীনিশির পূর্ণশশী’ হয়ে ওঠে। আহা, কী নরম উষ্ণতা সে চাঁদমুখে! তারপর আবার শুরু হল তার হাসি – “হাঃ হাঃ! বেড়ে মজা তো! দেখছ না - অ্যাঁ? হাসির কিছু দেখছ না? হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা! এই দ্যাখো – বলে কিনা হাসির কিছু দেখছে না!! হোঃ হোঃ হোঃ!!! আরে শোনো শোনো, ডোবা হল গিয়ে –”

আমি মুখ ফিরিয়ে সটান হাঁটা লাগালাম। এই শেষ – ব্যাস্‌, আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। যথেষ্টর বেশি হয়েছে। আমার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ এইবার ভেঙে গেল। এবার একটা হেস্ত-নেস্ত হওয়া দরকার – হতভাগার বড্ড বাড় বেড়েছে। ভূভার হরণের একটা ব্যবস্থা এবার না করলেই নয়। টিলার ওপরের রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতে আসতে শুনলাম আকাশের গায়ে রন্‌রনিয়ে উঠছে তার বিদঘুটে রাক্ষুসে অট্টহাসি। 



(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য) 



[কভার ছবি: gettyimages]

#বাংলা #অনুবাদ #রাজর্ষি গুপ্ত #Moon face #Jack London

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

66

Unique Visitors

220045