ফিচার

আধুনিক বাংলা প্রকাশনা-দুনিয়ার প্রথম নারী : সিগনেটের কর্ত্রী নীলিমা গুহঠাকুরতা

মৃণালিনী ঘোষাল Sep 29, 2022 at 11:25 am ফিচার

বিশ্বযুদ্ধের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের জেরে কিছু ক্ষেত্রে বাড়ির মহিলাদেরও বাইরের কাজ করতে দিতে বাধ্য হয়েছিল ভারতীয় তথা বাঙালি পরিবারগুলো। কিন্তু তলে-তলে ছিল তুষের আগুনের মতো ছিল হাজার চোখরাঙানি আর বিধিনিষেধ। মেয়েদের চাকরি করার বিষয়টাই যেখানে খুব কষ্টে ঢোঁক গিলে মেনে নিতে হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়েও মেয়েদের বাইরে কাজ করা মেনে নিচ্ছে না পরিবার - সেখানে মেয়েদের স্বাধীন ব্যবসা করার ইচ্ছে স্বীকৃতি পাবে? সে তো প্রায় ভাবাই যায় না। কিন্তু সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন নীলিমা গুহঠাকুরতা (১৯০৩-১৯৮২)। বাংলা প্রকাশনা ব্যবসায় নেমে বাংলা বইয়ের দুনিয়াটাকেই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। প্রকাশনা জগতে সুবিদিত সিগনেট প্রেসের কর্ণধার হিসেবে ডি.কে. ওরফে দিলীপকুমার গুপ্তই সকলের কাছে পরিচিত। সে তুলনায় নীলিমাদেবীর নাম জানেন না অনেকেই। কিন্তু সিগনেটের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন তিনি।

বই যে একটা নির্মাণ, এ ধারণা বাংলা বাজারে আসতে আসতে কেটে গেছে বহুদিন। উপেন্দ্রকিশোরের ইউ রায় অ্যান্ড সন্স ছাপাখানার কল্যাণে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ সাবালক হতে শুরু করে। তবে সম্ভবত প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা বই বিষয়টার আলাদা একটা শিল্পমাধ্যমকে আবিষ্কার করেছিল। ফলে শুধু প্রচ্ছদ না, তাঁদের বিবেচনায় বইয়ের সাইজ, বাঁধাই, হরফের ধরন, বিন্যাস, পঙক্তি-বিন্যাস, পৃষ্ঠা-বিন্যাস ইত্যাদি সমস্ত কিছুই গুরুত্ব পেয়েছিল। পুলিনবিহারী সেনের তত্ত্বাবধানে নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ভাবনায় তৈরি হয়েছিল বিশ্বভারতীর বইয়ের প্রচ্ছদ। বইয়ের এই নির্মাণকলাকে এক আলাদা মাত্রায় নিয়ে গেল সিগনেট প্রেস। নীলিমাদেবী আর দিলীপকুমার গুপ্ত। সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন শাশুড়ি ও জামাই। দিলীপকুমার যে-সময় বিজ্ঞাপন সংস্থা ডিজে কিমারে যোগ দিয়েছিলেন, তখন সেখানে অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিলেন নীলিমা দেবী। তাঁর মেয়ে নন্দিনীর সঙ্গে দিলীপকুমারের বিয়ে হয়। 


ছাপাখানা তো কতই ছিল। কিন্তু কী লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই নতুন প্রকাশনা? সে উত্তর দিয়েছেন নীলিমা দেবী। তাঁর কথায়, সিগনেট প্রেস চেয়েছিল পাঠক তৈরি করতে। চেয়েছিল রুচি তৈরি করতে। তিনি বলেছিলেন, "ভাল লেখা ছাড়া ভাল বই হয় না— এ কথাটা হয়তো এতই স্বতঃসিদ্ধ যে বিশদ করার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে: বইটা কী ভাবে পরিবেশন করা হবে, সেটাও জরুরি। বই তৈরি করাটাও একটা শিল্প।” সেই শিল্পের সাধনাকে এমন উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা যে, জওহরলাল নেহরু-র ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ কিংবা বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ‘প্রিজ়ন ডায়েরিজ' প্রকাশ পেয়েছিল সিগনেট থেকেই। সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল', বিভূতিভূষণের 'আম আঁটির ভেঁপু', জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন'-এর মতো নামকরা বইগুলিকে অদ্ভুত সুন্দর প্রচ্ছদ ও ছবিসহ, নির্ভুল বানানে প্রকাশ করেন তাঁরা। পাশাপাশি ছিল সমসাময়িক নতুন লেখকদের বই। বইয়ের প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে নীলিমা দেবীর পরামর্শ মেনে চলতেন দিলীপকুমার।  

আরও পড়ুন : স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠক সাইদা বানো / পূরবী রায়

আসলে নীলিমা কোনও দিনই ছক মেনে চলেননি। এলাহাবাদে জন্ম তাঁর। বড় হয়েছিলেন স্কটিশ গভর্নেসের কাছে, সাহেবি আদবকায়দায়। পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ চলত নিয়মিত। এদিকে হাল ফ্যাশনের টু-সিটার চালিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহর। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নীলিমার, কিন্তু মনের মিল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক প্রভু গুহঠাকুরতার প্রেমে পড়ে সংসার ছাড়েন তিনি। একজন দুর্দান্ত বাগ্মী, অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে সাংবাদিক, সেখান থেকে বিজ্ঞাপনের জগতে এসেও সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন। একইসঙ্গে লেখক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই লিখেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ান স্টেট রেলওয়ে ম্যাগাজিন, দ্য হিন্দু, অমৃতবাজার পত্রিকা, ম্যাড্রাস মেলের মতো প্রথম সারির সমস্ত পত্রপত্রিকায় একসময় নিয়মিত লিখেছেন।  

আরও পড়ুন : প্রথম এভারেস্টজয়ী মহিলা : জুনকো তাবেই / মন্দিরা চৌধুরী 

১৯৪৩ সালে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে প্রভুর মৃত্যুর পরে একা হাতে সংসার সামলাতে থাকেন নীলিমা। অন্যদিকে নতুন প্রকাশনা সিগনেটেরও অধিকাংশ ভার তুলে নেন নিজের কাঁধেই। অনেকটা একা হাতেই বাংলা প্রকাশনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি নিজস্ব লেখালিখি, সাবলীল অনুবাদ, বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র নিয়ে বাংলা সংস্কৃতির জগতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন তিনি। সব মিলিয়ে সে-সময়ের এক উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী চরিত্র নীলিমা গুহঠাকুরতা। 

..................... 

সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র 

# নীলিমা গুহঠাকুরতা #সিগনেট প্রেস #silly পয়েন্ট #নারীপক্ষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

6

Unique Visitors

219109