মাইকেলের শেষকৃত্য ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
অমিতব্যায়িতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের গোটা দ্বিতীয়ার্ধটাই কেটেছে অর্থকষ্ট, রোগব্যাধি, ও নানা সমস্যায়। বিশেষত তাঁর শেষ কয়েক বছর যে মর্মান্তিক কষ্টে কেটেছে, তা ভাবলে মন ভারী হয়ে আসে। ১৯৭৩ সালের মে মাসে কিছুদিন আগেই রীতিমতো মরিয়া হয়ে মাত্র তেরো বছর সাত মাস বয়সেই মেয়ে শর্মিষ্ঠার বিয়ে দিয়ে দেন। তারপরেই ছিন্নভিন্ন মন আর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে পরিবারসহ উত্তরপাড়ায় গিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির ওপরতলায়। কিওছুদিনের মধ্যেই ভর্তি হতে হয় আলিপুর জেনারেল হসপিটালে। প্রথম কয়েকদিন একটু ভালো থাকলেও অবস্থার অতি দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এরই মধ্যে ২৬ জুন তারিখে রোগজর্জর হেনরিয়েটার মৃত্যু হয়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মুমূর্ষু কবি সে খবর পান। তার তিন দিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৯ জুন বেলা দুটো নাগাদ মাইকেলের প্রাণবায়ু শরীর ত্যাগ করে। মহাকবির শেষকৃত্য নিয়ে দেখা দেয় মহা গোলযোগ। তিনি জন্মসূত্রে যে-সমাজের বাসিন্দা ছিলেন সেই বাঙালি হিন্দুদের তরফ থেকে কোনোরকম সহানুভূতি তো পেলেনই না, আশ্চর্যজনকভাবে কলকাতার খ্রিস্টান সমাজও তাঁর প্রতি চরম উপেক্ষা আর অবহেলা প্রদর্শন করল। মাইকেলের জীবনীকার গোলাম মুরশিদ লিখছেন, "ইংলিশম্যানের মতো পত্রিকাগুলো তাঁর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত ছাপল না - যদিও সে সপ্তাহে কলকাতায় মোট কজন দেশীয় এবং খৃষ্টান মারা যান এবং আগের সপ্তাহের তুলনায় তা বেশি, না কম - সে পরিসংখ্যান নিয়েও আলোচনা করে।" মিশনারিদের কাগজ 'ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া' খুব সংক্ষেপে, দায়সারাভাবে তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপল এবং মূলত আলোচনা করল তাঁর অনিয়মে ভরা জীবন নিয়ে। তিনি যে তাঁর নিজের পৈতৃক সম্পত্তি কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন এবং তিন সন্তানের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলেন না, সেই নিয়েও মন্তব্য করা হল। অথচ তাঁর কবিকৃতি নিয়ে কোথাও একটি শব্দও উচ্চারিত হল না। এমনকি কলকাতায় খ্রিস্টানদের গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করার অনুমতি অবধি যথাসময়ে পাওয়া গেল। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গিয়ে লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যানের কাছে দরবার করা সত্ত্বেও লাভ হল না। মহাকবির মৃতদেহ সারারাত পড়ে রইল দুর্গন্ধে-ভরা মর্গে। শেষপর্যন্ত রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোও নামে এক সহৃদয় যাজক এগিয়ে আসেন। কলকাতার গোটা খ্রিস্টান সমাজ এবং স্বয়ং লর্ড বিশপের বিরাগকে উপেক্ষা করে তিনি কবির মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্ব নেন। যতদূর জানা যায়, অ্যাংলিকান চার্চে তাঁর শেষকৃত্যে অন্য কোনও পাদ্রী যাননি। এমনকি কৃষ্ণমোহনও না।
পরের দিন, অর্থাৎ ৩০ জুন, কবির বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানের যান। এদিন প্রায় হাজারখানেক লোক ছিলেন। কলকাতার বাইরে থেকেও কেউ-কেউ এসেছিলেন বলে জানা যায়। মাইকেলের একদা-সুহৃদ অনেক স্বনামধন্য বাঙালিকে কিন্তু এদিন পাওয়া গেল না। দিনকয়েক আগে হেনরিয়েটাকে সেই গোরস্থানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তার পাশেই সমাধিস্থ করা হল মাইকেলকে। কিন্তু গোরস্থানের রেজিস্টারে নাম তোলা হলেও তাঁর নাম নথিভুক্ত করা হল না চার্চের বেরিয়াল রেজিস্টারে।
এ-ব্যাপারে সনাতন হিন্দুধর্মের লোকজনের সহায়তা পাবার রাস্তা নাহয় মাইকেল নিজেই বন্ধ করে গেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টান সমাজের এরকম নজিরবিহীন বিদ্বেষের মুখোমুখি কেন হতে হল তাঁর প্রাণহীন দেহটিকে? খুনি, অধর্মাচারী, অপরাধীদের ক্ষেত্রেও খ্রিস্টান সমাজ এহেন বিদ্বেষ দেখায়নি। এমনকি মাইকেলের ঘরনি হেনরিয়েটার ক্ষেত্রেও না। তাহলে মাইকেলের প্রতি কেন এই চরম আক্রোশ? গোলাম মুরশিদের অনুমান, "তাঁর বিরুদ্ধে অন্য যেসব অভিযোগই থাক না কেন, তিনি যে-শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করেছিলেন অথবা শ্বেতাঙ্গিনীকে নিয়ে ঘর করেছিলেন - এটাকে শ্বেতাঙ্গরা বিবেচনা করতেন তাঁর অমার্জনীয় অপরাধ হিশেবে। ... একজন শ্বেতাঙ্গিনীর পাণিপীড়ন করবে এক কালা আদমী - এটা তাঁরা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না।" তাছাড়া মাইকেল সারাজীবন চার্চে যাননি। খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাঁর আলাদা করে খুব বেশি অনুরাগ অন্তত জনসমক্ষে দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু মাইকেলের প্রতি সত্যি কতটা ঘৃণা তাঁদের মনে জমে ছিল, তা বোঝা গেল তাঁর মৃত্যুর পর। বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এক সাহিত্যিকের প্রতি সেদিন কলকাতা যে আচরণ করেছিল, তার বেশিরভাগ দায় অবশ্যই বিদেশিদের। কারণ স্বভাবতই কলকাতার খ্রিস্টানসমাজ পরিচালিত হত তাঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে। কিন্তু এই ঘটনা লজ্জায় মাথা হেঁট করে দেয় আমাদের সবার।
.....................
ঋণ : আশার ছলনে ভুলি, গোলাম মুরশিদ
#Michael Madhusudan Dutt #bicentenary #silly পয়েন্ট #মাইকেল মধুসূদন দত্ত