মেসি, ইছাপুরের শিবশঙ্কর পাত্র এবং আমার-আপনার গল্প
মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কাতার বিশ্বকাপের রোমাঞ্চকর ফাইনাল শেষ হয়েছে। টাই-ব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে। গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন গ্লাভের পর এবার বিশ্বকাপের সেরা প্লেয়ারকে গোল্ডেন বল দেওয়া হবে। এর আগে ২০১৪ সালেও তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেবার ছিলেন পরাজিত। এবার আসবেন রাজার বেশে। তিনি এলেন। গোল্ডেন বল হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ‘আসল পুরস্কার’-টার দিকে। তিনি, লিওনেল মেসি আলতো করে চুমু খেলেন বিশ্বকাপ ট্রফিটার গায়ে। যেন নিজের অধিকারে শিলমোহর করে দিলেন। ঠিক এই দৃশ্যটা দেখার জন্য সারা বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মানুষ টিভি-মোবাইল-জায়েন্ট স্ক্রিনে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। আনন্দের কান্নায় ঝাপসা হয়ে এল অনেক চোখ। দক্ষিণ আমেরিকার এক দেশের এক নাগরিকের জন্য বাঙালি ঘরের চোখের জলকে আজ আর কেউ অস্বাভাবিক বলবে না। মূল্য নেই আর কোনো ফুটবলীয় শত্রুতার। এই জয় তো শুধু আর্জেন্টিনার নয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও যারা দীর্ঘদিন ধরে মেসিকে আগলে রেখেছিলেন, এই জয় তাদের ভালবাসার। মেসি বা আর্জেন্টিনার ফুটবল কক্ষপথ থেকে বহু দূরে থাকা এরকম বহু মানুষের ভালোবাসা আর প্রার্থনারই সুফল মিলল আজ। এরকম মানুষ ছড়িয়ে আছে এই বাংলাতেও, আমার-আপনার আশে-পাশে। আসুন, আজ পরিচয় করিয়ে দিই সেরকম একজনের সঙ্গে। তার নাম শিবশঙ্কর পাত্র বা শিবে পাত্র। পেশায় চা-বিক্রেতা এই মানুষটা মেসিকে নিজের ‘ভাই’ বলে মানেন।
শিবে পাত্রকে খুঁজতে হলে আপনাকে যেতে হবে ইছাপুর নবাবগঞ্জের গঙ্গার ঘাটে। যারা ইছাপুর চেনেন না, তাদের জন্য বলে দেওয়া ভালো যে কলকাতার উত্তরে, শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে ৪৫ মিনিটের দূরত্বে, গঙ্গার তীরে অবস্থিত একটা ছোট মফস্বল অঞ্চল ইছাপুর। এমনিতেও ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে নবাবগঞ্জের খ্যাতি রয়েছে। নবাব সিরাজদৌল্লার তাঁবু পড়েছিল বলেই জায়গাটার নাম নবাবগঞ্জ। এছাড়াও মণ্ডলদের পরীবাড়ির দুর্গা পুজো, ঝুলনমেলার ঐতিহ্য আর গঙ্গার ঘাটের সৌন্দর্য নবাবগঞ্জের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সে সব কিছুকে ছাপিয়ে আপাতত নবাবগঞ্জের নতুন আকর্ষণ শিবেদার চায়ের দোকান।
একবার নবাবগঞ্জ ঘাটে পৌঁছোলে শিবেদার চায়ের দোকান খুঁজে নেওয়া অত্যন্ত সহজ কাজ। বিশেষ করে যদি ফুটবল বিশ্বকাপের মরশুম হয়। দূর থেকেই দেখতে পাওয়া যায় যে গোটা রাস্তা জুড়ে ‘আই লাভ আর্জেন্টিনা’ লেখা নীল-সাদা বিরাট পতাকা আকাশটাকে ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সামিয়ানার নীচ দিয়ে দু-পা এগোলেই শিবশঙ্কর পাত্রের নীল-সাদা দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনেই রয়েছে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা লিওনেল মেসির ছ-ফুট উঁচু মূর্তি। গোলের পরে আকাশে দু-হাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার চিরাচরিত রূপ। নীল-সাদা ফুল দিয়ে পুরো জায়গাটা সাজানো। এর পাশেই রয়েছে মেসি, মারাদোনার ছবি আর আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো শিবেদার চায়ের দোকান। এখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু। সেটা এখন আর চায়ের দোকান নয়, হয়ে গেছে মেসিভক্তদের তীর্থক্ষেত্র। দোকানের উলটো ফুটে রয়েছে মেসি-মারাদোনার বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য ছবির কাট-আউট, রয়েছে এবারের বিশ্বকাপের প্রতিটা প্লেয়ারের বড়ো বড়ো পোস্টার। কোপা আমেরিকার ম্যাচের সময়ের আর্জেন্টিনার প্রথম একাদশের ছবি দিয়ে একটা দেওয়াল প্রায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায় সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপের ম্যাচের তালিকার দিকে। কোন পথ ধরে এসে মেসির হাতে বিশ্বকাপ উঠবে, তার ব্লু-প্রিন্ট তো শুধু আর্জেন্টিনাতেই তৈরি হয়নি, হয়েছে নবাবগঞ্জেও। শুধু বাড়ির বাইরে নয়, ভিতরের দেওয়াল থেকে শুরু করে সিলিং ফ্যান পর্যন্ত নীল-সাদাতে রাঙানো। এমনকি পাত্র পরিবারের পোষ্য সাদা কুকুরটির গলার বকলসটাও নীল রঙের।
শিবেদার এই ‘পাগলামি’ শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে মারাদোনাকে দেখে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মেসি-র উত্থানের সময় থেকেই তিনি মেসির অন্ধভক্ত। ২০১১ সালে মেসির কলকাতায় আসার উন্মাদনার মধ্যে শিবেদা নিজের বাড়িটা নীল-সাদা করে ফেলেছিলেন। ২০১৪-র বিশ্বকাপের সময়ে নিজের বাড়ির ভিতরটাকেও মেসির মোড়কে বদলে নিলেন। তারপর থেকে মেসির জন্মদিনে কেক কাটা বা ‘আর্জেন্টিনা ফ্যানস ক্লাব’-এর উদ্যোগে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মানুষদের জন্য রক্তদান শিবির আয়োজনের মতো ঘটনা এখানে প্রায়ই হয়ে থাকে। শিবেদার খুব ইচ্ছা ছিল এবার কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার। বিভিন্ন কারণে সেটা সম্ভব না হওয়ায় বাড়ির সামনে মেসির একটা মূর্তি বসিয়ে নিলেন।
এত কিছুর মধ্যেও কি মনের মধ্যে কাঁটা ছিল না? এটাই যে মেসির শেষ বিশ্বকাপ। এবার যদি না জেতা যায়, তবে যে মেসির প্রাপ্তির ঝুলি অপূর্ণ থেকে যাবে। তুলনা চলবে মারাদোনার সঙ্গে। কথা হবে বড়ো প্রতিযোগিতায় মেসির পারফরমেন্স সম্পর্কে। নিন্দুকের গালমন্দের বোঝা নিয়ে ভালোবাসাকে বুকে করে একা গুমরে কাঁদতে হবে। কিন্তু মেসি কথা রেখেছেন। কারোর সঙ্গে তুলনা নয়, তিনি নিজের মহাকাব্য লিখেছেন। নিজের ভাষায়, নিজের মায়াবী স্পর্শের সম্মোহনী শক্তিতে। বিশ্বকাপ ট্রফি তিনি তুলে নিলেন; তুলে দিলেন শিবেদার হাতে, আমার-আপনার মতো কোটি কোটি ভক্তের হাতে।
বিশ্বকাপ জয় শিবে পাত্র কীভাবে সেলিব্রেট করেছিলেন আমরা জানি না। উনি বলেছিলেন যে, তিনি সাধারণত একা খেলা দেখা পছন্দ করেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় জয়ের পর উনি আর একা ছিলেন না। অসংখ্য মানুষের ঢল তাকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল। গল্পের এই অংশ থেকে আমরা শিবেদাকে বিদায় দিতে পারি। তখন আমি, আপনি, শিবশঙ্কর পাত্র কিংবা কাতার-আর্জেন্টিনায় থাকা ভক্তদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আসলে শিবেদার গল্পটা আমি-আপনিও লিখতে পারতাম। হয়তো আমাদের বাড়ি নীল-সাদা রঙে রাঙানো নয়, আমাদের বাড়ির সামনে মেসির মূর্তি নেই। হতেই পারে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে দাগিয়ে দিচ্ছে, সে অর্থে আমি-আপনি ‘সিজনাল সাপোর্টার’। কিন্তু কিছু যায়ে আসে কি? কাউকে ভালোবাসতে গেলে, কারোর সাফল্যের আনন্দ-উৎসবে ঢুকে পড়ার জন্য সারা বছর রাত জেগে ‘রেগুলার সাপোর্টার’ হওয়ার মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। অন্তত ফুটবল তো দেয়ইনি। সে শুধু দিয়েছে স্বপ্ন দেখার সাহস, লড়াই করার আত্মবিশ্বাস। সে বলেছে জীবনকে আর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মানুষগুলোকে ভালোবাসতে। ভাবুন তো, আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে কেউ যদি বলত লিওনেল মেসি বিশ্বকাপ জিতবে, তাহলে কি বিশ্বাস করতে মন চাইত? ২০১৪-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হার, কোপা আমেরিকার ফাইনালে দু-বার হার। প্রবাদের মত ছড়িয়ে পড়ল- ক্লাব ফুটবলে মেসি যতটা সফল, আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ততটাই ব্যর্থ। গত কয়েক বছরে ক্লাব ফুটবলেও সেই সাফল্য নেই। শুধু প্রতিভা থাকলে হয় না, চাই শক্তপোক্ত মানসিকতা, চাই অধিনায়কসুলভ মনোভাব ইত্যাদি কথায় ক্রমাগত কান ভারি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনার থেকেও চোখের জলে মর্মান্তিক বিদায় নিতে হল।
আর আজ বিশ্বকাপের ট্রফিটায় মেসির চুমু খাওয়া দেখে মনে হতেই পারে জীবন কী সুন্দর! সে কাউকে ফেরায় না। জীবন যেন লিওনেল মেসি-কে ব্যবহার করল একটা উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সে বলল ভালোবেসে কাছে ধরে রাখতে জানতে হয়, তাহলে অন্তমিলে রাজপুত্র বা রাজকন্যার জয় নিশ্চিত। সেটা ফুটবল হোক বা জীবনের অন্য কোনো খেলায়। হার মানা যাবে না, বিশ্বাস হারানো যাবে না। একদিন না একদিন জীবন আপনার জন্য গোলের পাস বাড়িয়ে দেবে, আপনাকে শুধু বিশ্বাস রেখে যেতে হবে। শিবশঙ্কর পাত্র-র কাছে বিশ্বাসের সেই শক্তির নাম লিওনেল মেসি, আর আপনার কাছে?
আরও পড়ুন : চুরি যাওয়া বিশ্বকাপ ট্রফি এবং একটি কুকুরের গোয়েন্দাগিরি / অর্পণ দাস
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : দেবাঞ্জন মুখার্জি।