‘সিধুজ্যাঠা’ থেকে ভারতের লোকসভার সদস্য : একশো তেইশ ছুঁলেন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
আজ আমাদের অচেনা রাস্তা থেকে অজানা ইতিহাস জানার জন্য একজনের কাছে উপস্থিত হলেই চটজলদি মিলে যায় আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর। গুগল। এই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় গুগলবাবার কৃপায় পৃথিবীর প্রায় সব তথ্যকেই আমরা করে ফেলেছি আমাদের পকেটে বন্দি। কিন্তু গুগলের টিকির দেখাও ছিল না যখন, তখন যে মানুষটি গুগলসম হয়ে উঠেছিলেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের সকলের পরিচিত সিধুজ্যাঠা। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গল্পের বিখ্যাত চরিত্র সিধুজ্যাঠাই হয়ে উঠেছিলেন ফেলুদা আর আমাদের কাছে আজকের গুগল। আর সেলুলয়েডের পর্দায় এই চরিত্রে অভিনয় করবার সুবাদেই যাঁর খ্যাতি পৌঁছেছিল শিখরে, তিনি হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা পেরিয়ে এলাম তাঁর একশো তেইশতম জন্মদিন।
অভিনেতা হিসেবে ঝকঝকে হরীন্দ্রনাথের পোর্টফোলিও। কখনও ‘সোনার কেল্লা’-র সিধুজ্যাঠা চরিত্রে আবার কখনো ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এর জাদুকরের চরিত্রে অভিনয়ের জাদু দিয়ে তিনি আমাদের মাতিয়ে রাখলেও এইটুকুতেই কিন্তু শেষ হয় না তাঁর সামগ্রিক পরিচয়। অভিনেতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সুরকার এবং সর্বোপরি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ রা এপ্রিল তেলেঙ্গানায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপট রচনা হয়েছিল তার পরিবার থেকেই। ভারতের সর্বপ্রথম ডি.এস.সি অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হরীন্দ্রনাথের পিতা। তাঁর বড়দা বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট। বিপ্লবী মহলে 'চট্ট' নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। ‘দ্য নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া’ তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর ভগ্নী। হারীন্দ্রনাথ বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন কৃষ্ণা রাওয়ের সঙ্গে, পরবর্তীকালে যিনি কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় নামে একজন সমাজ সেবিকা হিসেবে পরিচিতি পান। ক্ষুদিরামের ফাঁসির প্রতিবাদে মাত্র ১০ বছর বয়সেই হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখে ফেলেন একটি ইংরেজি কবিতা ‘ডাইং পেট্রিয়ট’। মাত্র ১১ বছর বয়সে লেখা তাঁর নাটক আবুল হাসান মঞ্চস্থ করেন। এবং সেই নাটক থেকে উঠে আসা অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল অ্যানি বেসান্তের ন্যাশনাল এডুকেশন ফান্ডে।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ইংরেজি কবিতার বই 'দ্য ফিস্ট অফ্ ইউথ'। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এই বইয়ের। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি দেন লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা বিচার করে গবেষকদের সুযোগ দেওয়ার নিয়ম ছিল। হরীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ফিস্ট অফ ইয়ুথ’ কবিতা সংকলনের জন্যই এখানে গবেষণার সুযোগ পান। বিদেশে পড়াশোনা চলাকালীন তার ইংরেজি কবিতা দেশ ও বিদেশের নানা পত্রপত্রিকায় যেমন The journal of the National Indian Association, The journal of the Theosophical - influenced Britain and India Association ইত্যাদিতে প্রকাশিত হতে থাকে।
ব্রিটেন থেকে হরীন্দ্রনাথ দেশে ফেরেন গান্ধীজীর আমন্ত্রণে। দেশে ফিরে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে তিনি নানা ভারতীয় ভাষায় গান লিখতে ও সুর দিতে শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান গীতিকারদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। 'শুরু হুই জং হামার’ গানটির জন্য তাকে ছ’ মাস জেল খাটতে হয়েছিল। কিন্তু তা তাঁর এমন উদ্যম প্রাণশক্তিকে দমন করে রাখতে পারেনি। কমিউনিস্টদের বহুল পরিচিত সংগীত 'ইন্টারন্যাশনাল’ গানের হিন্দি তরজমা 'উঠো জাগো ভুখে বন্দি অব খেঁচ লাল তলোয়ার' তৈরি করেছিলেন তিনি। এছাড়াও লাল মার্সাইয়ের সুরে বেঁধেছিলেন 'অব কোমর বাঁন্ধ, তৈয়ার হো লক্ষ কোটি ভাইয়ো।' গণনাট্য সংঘের হয়ে তাঁর তৈরি 'সূর্য অস্ত হো গয়া' সে সময় প্রভূত সাড়া ফেলেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেবার পাশাপাশি থেমে ছিল না তাঁর নিজের কলমও। এই বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির ইংরেজি ভাষায় অনেকগুলি বই লিখেছিলেন। সেগুলির মধ্যে দি কফিন, এনসিয়েন্ট উইং, ডার্ক ওয়েল, দি ডিভাইন ভ্যাগাবন্ড, ব্লাড অফ স্টোনস, স্প্রিং ইন উইন্টার, দি উইজার্ড মাস্ক, ফাইভ প্লেজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে হরীন্দ্রনাথ অভিনয়ে পরিচিতি পান। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সিধু জ্যাঠা চরিত্রটি তাকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা দিলেও তাঁর অভিনীত স্মরণীয় চরিত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বাংলায় সত্যজিৎ রায়ের সীমাবদ্ধ, গুগাবাবার মতো ছবি তো বটেই, তাছাড়াও পরবর্তীকালে মুম্বাইতে থাকাকালীন ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও তিনি নিজের অভিনয়দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য হিন্দি ছবিগুলি হল আশীর্বাদ, সাহেব বিবি অউর গুলাম, রাত অউর দিন, তেরে ঘর কে সামনে, চল মুরারী হিরো বননে, বাবুর্চি, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি। ‘আজাদ’ নামে একটি ছবির প্রযোজনাও করেন তিনি। সেকালে সংগীতশিল্পী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। সিনেমার জন্য প্রচুর গান লিখেছিলেন।
আরও পড়ুন : আলোকশিল্পী তাপস সেনের স্ত্রী গীতা সেন : বাংলা নাট্যগানের প্রথম গবেষক
হরীন্দ্রনাথের বহুবিচিত্র জীবনধারার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাঁর রাজনৈতিক জীবন। জওহরলাল নেহরুর প্রতি তিনি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম লোকসভা নির্বাচনে কমিউনিস্টদের সমর্থনে তৎকালীন অবিভক্ত মাদ্রাজের বিজয়ওয়াড়া কেন্দ্র থেকে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের লোকসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন হরীন্দ্রনাথ মারা যান। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন। তবে এমন একজন কর্মোদ্যোগী বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষের যতটা প্রচারের আলো প্রাপ্য ছিল, তা তিনি পাননি। সিধু জ্যাঠা চরিত্রে তাঁর মুখেই ফুটে ওঠে যে সংলাপ তা যেন হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের সারমর্ম। "আমি শুধু মনের জানলা খুলে দিয়ে বসে আছি যাতে আলো আর বাতাস ঢুকে মনটাকে তাজা রাখে। নিজের মনটাকে অন্ধকার হতে দিওনা ফেলু।"
….……………..