মারি কুরির প্রেমপর্ব : নোবেল কমিটি তাঁকে বারণ করেছিল পুরস্কার নিতে যেতে
পত্রপত্রিকা কেচ্ছার খবর পেলে সহজে ছাড়ে না, এ আজ মিডিয়ালালিত যুগে যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি ছিল একশো বছর আগেও। আর ব্যাপারটা কোনো ফিলমস্টার বা রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে আগে, তেমনই অন্তত একবার ঘটেছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেও।
হ্যাঁ, আমরা মারি কুরির কথাই বলছি। স্বামী পিয়ের কুরি আর দুই মেয়ের সঙ্গে তাঁর সুন্দর দাম্পত্য জীবন কাটছিল। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণায় সফল হচ্ছিলেন, স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেলও পেয়ে গিয়েছিলেন ততদিনে, এরকম একটা সময়ে এক বৃষ্টিক্লান্ত দিনে হঠাৎই পিয়ের কুরি রাস্তা পার হওয়ার সময় এক ঘোড়ার গাড়ির নিচে পড়ে গেলেন, আর সেখানেই মৃত্যু হল তাঁর। মুহূর্তের মধ্যে মারি কুরির জীবনে লেগে গেল বিষাদের গাঢ় রঙ তবে তিনি মনেপ্রাণে শক্ত মহিলা, দ্রুত সামলে উঠে আবার গবেষণায় লেগে পড়লেন দিন কয়েকের মধ্যেই।
কিন্তু আসল ব্যাপার ঘটল এরপর। পিয়ের কুরির কাছে গবেষণা করতেন এক ফরাসী ছাত্র পল ল্যাজাঁভা। তাঁর সঙ্গে বেশ অন্যরকম এক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল মারির, যে সম্পর্ককে আজকের দিনে আমরা প্রেম বলতেই পারি। তেতাল্লিশের বিধবা মারি আর উনচল্লিশের পলের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে অতটা হইচই হয়তো হত না, যদি না পল চার সন্তানের বাবা এবং এক ঘ্যানঘেনে স্ত্রীয়ের স্বামী হতেন। পরিবারের দিকে নজর না দিয়ে সারাক্ষণ বিজ্ঞান-গবেষণায় লেগে থাকার জন্য যাঁকে প্রায় সারাক্ষণই শুনতে হয় স্ত্রীয়ের গঞ্জনা। স্ত্রীয়ের হাত থেকে নিস্তার পেতেই হয়তো পল বেছে নিয়েছিলেন মারির হাত।
সম্পর্কটাকে গোপন রাখতে দুজনের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না যদিও। দুজনে মিলে প্যারিস শহরে একটা আলাদা ফ্ল্যাটই ভাড়া নিয়েছিলেন যাতে দুজনে সেখানে নিভৃতে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারেন। পল অন্যদিকে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন স্ত্রীয়ের থেকে বিচ্ছেদ নেওয়ার, কিন্তু স্ত্রী রাজী হচ্ছিলেন না।
এরকম একটা অবস্থায় পলের স্ত্রী কোনোভাবে সন্ধান পেয়ে যান ওই ফ্ল্যাটের, সেখানে হানা দিয়ে তিনি উদ্ধার করেন স্বামীকে লেখা মারির বেশ কিছু চিঠি। যা থেকে জানাজানি হয়ে যায় সব কিছু। পল তখন মারি এবং আরও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে গিয়েছেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলস-এ, একটি সম্মেলনে। এইরকম একটা সময় পলের স্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দিলেন স্বামীর কীর্তির খবর, আর রাতারাতি সংবাদপত্রগুলির পাতা ভরে উঠল দুজনের সম্পর্ক নিয়ে কাটাছেঁড়ার খবরে, বা গসিপে। স্বামী প্রয়াত হয়েছেন যাঁর এমন একজন মহিলা, সে তিনি যতই বিখ্যাত হন, কীভাবে এক বিবাহিত পুরুষকে ফাঁসিয়ে সংসার ভেঙে দেওয়ার পথে হাঁটতে পারেন, এই ছিল সেসব লেখালিখির মূল থিম, আর মারি যেহেতু ফরাসি নন, পোল্যান্ড থেকে আসা এক মেয়ে, এটাও ফরাসিদের কাছে আরও বেশি জ্বালা ধরিয়েছিল। যার প্রভাবে এক বিখ্যাত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী থেকে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয় অনেক নিচু স্তরে, পরকীয়া করলে যেন সেই মানুষটির আর অন্য কোনো পরিচয় থাকেই না। পত্রিকায় এমনকি এরকমও লেখা হতে থাকল যে পিয়ের বেঁচে থাকাকালীনই নাকি মারি আর পল গোপনে প্রেমপর্ব চালাচ্ছিলেন, আর এই খবর জেনে পিয়ের নাকি আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন!
সম্মেলন থেকে ফিরে মারি দেখেন তাঁর ফ্ল্যাটের বাইরে প্রচুর উত্তেজিত জনতা ভিড় জমিয়েছে, আর তাঁর দুই মেয়ে, একজন চোদ্দ আর অন্যজনের সাত, ঘরের ভেতর কাঁপছে আতঙ্কে। অনেক কষ্টে মেয়েদের নিয়ে সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলেন মারি।
অনেক বিজ্ঞানীই মারির বিপক্ষে কথা বললেও সেসময় তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন এক সুইস-ইহুদি বিজ্ঞানী, তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন, নিজের বিবাহিত জীবন নিয়ে জেরবার ছিলেন বলেই হয়তো এরকম একটা অবস্থায় তিনিই সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন মারি এবং পলের মনের অবস্থা। সেই বছরেই ব্রাসেলস অধিবেশনে তাঁদের সাক্ষাৎ, আর সাক্ষাতের পরে মারির ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন আইনস্টাইন। কারও বাইরের কাজের জীবন আর ব্যক্তিগত জীবনকে যে আলাদাভাবে বিচার করা উচিত, এবং ব্যক্তিগত কাজকর্মের ওপর ভিত্তি করে সেই মানুষটির কৃতিত্বকে বিচার করা উচিত না, এটা মারির মতো বিশ্বাস করতেন আইনস্টাইনও।
কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স মারির পাশে দাঁড়ায়নি সেদিন। ইতিহাসে মারি কুরিই প্রথমবার একজন মানুষ যিনি দু-দুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছিলেন, এবং সেই দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে জানাজানি হয় মারির প্রেম-সংবাদ। আর সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে সুইডিশ অ্যাকাডেমি থেকে মারিকে জানানো হয়, তাঁর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আসবার দরকার নেই, কারণ সে দেশের রাজা কোনো পরকীয়ায় লিপ্ত নারীর সঙ্গে করমর্দন করতে আগ্রহী নন!
কিন্তু না, মারি এই মানা মানেননি, উপস্থিত হয়েছিলেন নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে। হাত পেতে গ্রহণ করেছিলেন দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার, যে কৃতিত্ব তাঁর পরে আর কেউ অর্জন করতে পারেন নি আজও।
নিছক নারী হওয়ার জন্য মারি কুরিকে একদিন ফরাসি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের অধ্যাপক পদ থেকে প্রত্যাখ্যাত করা হয়েছিল, আর নারী হওয়ার জন্যেই ওই প্রেম-ঘটিত খবর ছড়ানোর সময়কালে সবচেয়ে বেশি নিন্দা সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকেই। তবু সব সহ্য করে তিনি নিজের কাজের ক্ষেত্রে থেকেছেন অবিচল, কোনো সমালোচনা তাঁকে গবেষণার কাজ থেকে বিচলিত করতে পারেনি। হয়তো এই জন্যেই তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা-বিজ্ঞানীর তকমা জিতে নিতে পেরেছেন।
#silly point #Marie Curie #Nobel prize #webportal #অর্পণ পাল # ফিচার #মারি কুরি #নোবেল #সিলি পয়েন্ট