মণিপুর, নেকড়ে-মানুষ আর অরণ্যের অধিকার
দু মাসের উপর হয়ে গেল, মণিপুর জ্বলছে। মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ মিলিটারির দল অবধি। অবশেষে চূড়াচাঁদপুরে দুই কুকি মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ছবি দেখে শিউরে উঠেছে গোটা দেশ, নিন্দার ঝড় উঠেছে গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে। কতকটা বাধ্য হয়েই মুখ খুলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
প্রাথমিকভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, গণ্ডগোলের সূত্র বেশ গভীরে। মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকা অঞ্চলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি মেইতেইদের দখলে, সেখানে দোকানপাট সিনেমাহল বড় বড় অফিস প্রভৃতি আধুনিক সভ্যতার উপকরণ ভর্তি। এই উপত্যকাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রয়েছে পাহাড় ও জঙ্গল, যেখানে মূলত কুকি নাগা প্রভৃতি উপজাতিদের বাস। সংখ্যালঘু উপজাতির স্বার্থরক্ষার কারণে কুকি বা নাগারা যখন ইচ্ছে ইম্ফল উপত্যকায় আসতে পারলেও মেইতেইরা ইচ্ছেমত পাহাড় জঙ্গলে যেতে পারে না। সমস্যা শুরু হয়, যখন মেইতেইরা নিজেদের সংরক্ষিত সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য একটি বিল আনবার বন্দোবস্ত শুরু করে (মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ নিজে হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ)। নাগা কুকিরা সিঁদুরে মেঘ দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাদের আশঙ্কা এই সুবিধা পেয়ে গেলে মেইতেইরা যখন ইচ্ছে পাহাড় জঙ্গলে আনাগোনা করে উপজাতিদের চিরাচরিত জীবনযাত্রা ধ্বংস করে দেবে, মণিপুরের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র চলে যাবে কর্পোরেট হাতের মুঠোয়। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে নাকি এই এলাকায় বিরাট পরিমাণ খনিজ সম্পদের হদিশ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে মহামূল্যবান প্ল্যাটিনাম গ্রুপের ধাতুও। তড়িঘড়ি নাকি বেসরকারি সংস্থাদের জায়গা লিজ দেওয়াও শুরু হয়েছে। তাই কি ‘বিশেষ সুবিধা’ দিয়ে মেইতেইদের এই অঞ্চলে অবাধ প্রবেশাধিকার দেবার জন্য এই তৎপরতা?
ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র বছর দেড়েক আগে খোদ বলিউডের একখানা মূলধারার ছবিতে এই বিষয়খানা উঠে এসেছিল কাহিনীর প্রধান উপজীব্য হয়ে। অমর কৌশিকের ‘ভেড়িয়া’ ছবির প্রেক্ষাপট অবশ্য ঠিক মণিপুর নয়, অরুণাচল প্রদেশ। ভাস্কর তার ভাই জনাকে নিয়ে রাস্তা তৈরির কাজে এসে হাজির হয় অরুণাচলের এক ঘুমপাড়ানি শহরে। তার লক্ষ্য উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে স্থানীয় মানুষদের নিজের দলে টেনে নির্বিচারে জঙ্গল সাফ করে রাস্তা বানানোর কাজ শুরু করে দেওয়া। এমন সময়ে ঘটে যায় গোলমাল, ভাস্করের পশ্চাদ্দেশে মোক্ষম কামড় দিয়ে বসে এক পেল্লায় নেকড়ে। হরর ছবির চেনা ছক অনুযায়ী চাঁদনী রাতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জাঙ্গিয়া টাঙ্গিয়া ফাটিয়ে অতিকায় নেকড়ে হয়ে যায় সে। শিগগিরি বোঝা যায়, এ নেকড়ের মূল লক্ষ্য জঙ্গলকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো, বেছে বেছে সে মারতে থাকে ভাস্করের রাস্তা বানানোর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মুনাফালোভীদের। এ ছবির আরেক মোক্ষম চাল হল, উদ্ধত কর্পোরেট পৌরুষের আগ্রাসন থেকে অরণ্য রক্ষা করবার দায়িত্বে থাকা ‘বিষাণু’ বা প্রাচীন নেকড়েটি আদতে একজন মহিলা। এভাবেই হালকা কমেডির মোড়কে ‘ভেড়িয়া’ দিয়ে দেয় ইকোফেমিনিজমের পাঠ। জঙ্গল বাঁচিয়ে রাস্তা তৈরি করবার শেষ সিদ্ধান্তটিতে অবাস্তব ইচ্ছেপূরণের গন্ধ থাকলেও, মুনাফার ব্যাপারীদের থেকে উত্তর পূর্ব ভারতবর্ষের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করবার গুরুত্বপূর্ণ (এবং অবশ্যই সাহসী) প্রসঙ্গ উঠে আসে এই ছবিতে।
বর্তমান মণিপুরে যা ঘটে চলেছে তার সঙ্গে এর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না কি? মেইতেইদের সঙ্গে কুকিদের বিরোধের মূলে কিন্তু রয়েছে সেই অরণ্য এবং আদিবাসী জীবনযাত্রা ধ্বংসের আশঙ্কা। মেইতেইরা ইম্ফল উপত্যকার আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত, তায় হিন্দু। কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সরকারের অনুমোদিত কর্পোরেট প্রকল্পগুলি রূপায়ণ করতে মণিপুরের পাহাড় জঙ্গলের খোলনলচে বদলে দেবার দরকার হলে মেইতেইরা কোন পক্ষে থাকবে, আন্দাজ করা শক্ত নয়। সম্প্রতি বাদল অধিবেশনের পঞ্চম দিনে লোকসভায় পাশ হয়েছে নতুন বন সংরক্ষণ বিল, যার ফলে ভারতবর্ষের হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার অরণ্যভূমি প্রায় বিনা বাধায় শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকার। এবং মণিপুরের সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যেমন রয়েছে বনাঞ্চল, তেমনই নির্যাতিতের প্রধান মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন দুই কুকি মহিলা। এমন একটা সময়ে কি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসতে পারত না ‘ভেড়িয়া’? সেই সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যুর পর থেকেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, বলিউডের ছবিতে নাকি সামাজিক বাস্তবতার অভাব। মণিপুর প্রসঙ্গে ‘ভেড়িয়া’ ছবির বক্তব্য উল্লেখ করে তো সেই কথাকেও খণ্ডানো যেত! অবশ্য ছবির নির্মাতা হোক বা কলাকুশলী, কারোর এ ব্যাপারে বিশেষ গরজটরজ দেখা যাচ্ছে না। সত্যিকারের দুনিয়ায় ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা যে বড়ই কঠিন কাজ! অবশ্য জিও স্টুডিওজ যে সিনেমার প্রযোজক, তার ক্রু বাস্তব জীবনে কর্পোরেট স্বার্থের বিপক্ষে মুখ খুলবেন আশা করাই হয়তো বাড়াবাড়ি। হিরণ্ময় নীরবতার মাঝে তাই ‘ভেড়িয়া’ ছবির তাৎপর্য ‘আপনা বনা লে’ গানের সাথে বানান বাহারি রিলেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে যায়, জ্বলতে থাকে মণিপুরের পাহাড়, জঙ্গল, আর মানুষের দেহ।
..................
#manipur #meitei #kuki #Bhediya #silly পয়েন্ট